ঢাকা ২০ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ৫ আশ্বিন ১৪৩১ | বেটা ভার্সন

বই সংকটে ব্যাহত নতুন বছরের শিক্ষা কার্যক্রম

নতুন কারিকুলাম নিয়েও অন্ধকারে শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা
বই সংকটে ব্যাহত নতুন বছরের শিক্ষা কার্যক্রম

জানুয়ারির প্রথম দিন দেশব্যাপী উৎসবের মধ্যদিয়ে শুরু হয়েছে নতুন বই বিতরণ পর্ব। আর ২ জানুয়ারি থেকেই মূলত অধিকাংশ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে নতুন শিক্ষাবর্ষের ক্লাস শুরু হয়েছে। তবে ছাপা কাজ শেষ না হওয়ায় এখনো শিক্ষার্থীদের হাতে সব বই তুলে দেয়া সম্ভব হয়নি। যে কয়টি বই হাতে পেয়েছে তা নিয়েই ক্লাসে উপস্থিত হচ্ছে শিক্ষার্থীরা। এতে নতুন বছরের প্রথম সপ্তাহ পার হলেও পুরোদমে ক্লাস শুরু করা সম্ভব হয়নি স্কুলগুলোতে। বই পেতে আরও দেরি হলে শিক্ষা কার্যক্রম বেশ ব্যাহত হবে বলে সংশ্লিষ্টরা আশঙ্কা করছেন।

এদিকে চলতি বছর থেকে প্রথম, ষষ্ঠ ও সপ্তমণ্ডএই তিনটি ক্লাসে চালু হয়েছে নতুন কারিকুলাম। অথচ এখনও শিক্ষকদের প্রশিক্ষণ কার্যক্রমই শেষ হয়নি। গতকাল জেলা-উপজেলা পর্যায়ে ৫ দিনের শিক্ষক প্রশিক্ষণ শুরু হলেও অনেকে শিক্ষক গাইড বা সহায়িকা এবং নতুন কারিকুলামের বই হাতে পাননি। এতে মাধ্যমিক শিক্ষকদের এ প্রশিক্ষণ কার্যক্রম ফলপ্রসূ হচ্ছে না বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে। তৃণমূল শিক্ষকদের প্রশিক্ষকদের জন্য যাদেরকে প্রশিক্ষক করা হয়েছে তাদেরও যোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে। আগামী সপ্তাহের রোববার তথা ১৫ জানুয়ারি ৫ দিনের এ প্রশিক্ষণ শেষ হবে। প্রাথমিক পর্যায়ের শিক্ষকদের প্রশিক্ষণ এখনও শুরুই হয়নি।

এদিকে শিক্ষকদের প্রশিক্ষণ জটিলতার পাশাপাশি শিক্ষার্থীরাও সব বই হাতে পায়নি। এ অবস্থায় নতুন কারিকুলাম নিয়ে শিক্ষার্থীদের পাশাপাশি অনেকটা অন্ধকারে আছে শিক্ষার্থীও অভিভাবকরা। শিক্ষকদের জন্যও এই কারিকুলাম বুঝে শিক্ষার্থীদের বোঝানো বেশ চ্যালেঞ্জের বিষয় বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা। এর আগে সৃজনশীল পদ্ধতি আয়ত্ব করতেও শিক্ষকদের বেশ বেগ পেতে হয় বলে জানা গেছে।

রাজধানীর মিরপুর এলাকার নামকরা একটি স্কুলের অভিভাবক জানান, ১ জানুয়ারি তার সন্তানের হাতে সপ্তম শ্রেণির মাত্র তিনটি বই তুলে দেয়া হয়। একসপ্তাহ পার হলেও আর কোন বই দেয়া হয়নি। এ অবস্থায় নতুন বছরের ক্লাস চরম ব্যাহত হচ্ছে। তাছাড়া নতুন কারিকুলামের যে কয়টি বই আছে-তা পড়ানো নিয়েও শিক্ষকরা বেশ জটিলতায় আছেন বলে জানা গেছে। কারণ এখনো তারা এ বিষয়ে প্রশিক্ষণই শেষ করেননি। অনেক শিক্ষার্থী নুতন বই বুঝতে না পারায় আগের কারিকুলামের পুরানো নিয়ে পড়ালেখা করছে বলে জানা গেছে। তাছাড়া নতুন কারিকুলামে কোচিং-প্রাইভেট লাগবে না বলে শিক্ষামন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে বলা হলেও বছরের শুরু থেকেই শিক্ষার্থীদের অনেকে আগাম কোচিং-প্রাইভেট বা ব্যাচে পড়া শুরু করেছে বলে খবর পাওয়া গেছে। এখনো শিক্ষার্থীদের হাতে বই না পৌঁছানোর বিষয়ে জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ডের (এনসিটিবি) চেয়ারম্যান অধ্যাপক ফরহাদুল ইসলাম বলেন, গত ৩১ ডিসেম্বরের মধ্যে ৮২ শতাংশ বই সারাদেশে পাঠানো হয়েছে। কোথাও কোথাও হয়তো থানা-জেলা শিক্ষা কর্মকর্তারা বিতরণ করতে বিলম্ব করছেন বলে সেখানে বই যাচ্ছে না। এবিষয়ে খোঁজ নেয়া হবে। আগামী ১৫ জানুয়ারির মধ্যে সারা দেশে শতভাগ বই পৌঁছে দিতে নির্দেশনা সব প্রেসগুলোকে দেয়া হয়েছে। এ সময়ের পরও যদি কেউ বই পাঠাতে ব্যর্থ হয় তবে তাদের ছাড় দেওয়া হবে না।

এদিকে শিক্ষার্থীরা যেসব বই পেয়েছে তার কাগজ খুব নিম্নমানের বলে অভিযোগ উঠেছে। এ বিষয়ে এনসিটিবি চেয়ারম্যান বলেন, কাগজ সংকটের কারণে বইয়ের ব্রাইটনেস বা উজ্জ্বলতার বিষয়ে কিছুটা ছাড় দেয়া হলেও জিএসএম (কাগজের পুরুত্ব) বিষয়ে কোনো ছাড় দেওয়া হয়নি। আমরা যে এজেন্সির মাধ্যমে বইয়ের মান তদারকির কাজ করিয়েছি, তাদের বিষয়ে আমাদের কাছে অভিযোগ এসেছে। অভিযোগগুলো খতিয়ে দেখা হচ্ছে। নিম্নমানের কাগজের কারণে আমরা অনেক ছাপাখানার বই নষ্ট করেছি। এরপরও কারো বিরুদ্ধে এ ধরনের কাজের প্রমাণ পাওয়া গেলে তাদের বিল আটকসহ আইনি ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

সূত্র মতে, প্রায় একযুগ আগে সৃজনশীল পদ্ধতি চালুর সময় বলা হয়েছিল, এতে মুখস্থবিদ্যা কমবে, শিক্ষার্থীদের বুঝে শেখার দক্ষতা বাড়বে। কিন্তু ফল হয়েছে উলটো। শিক্ষকরাই ঠিকমতো এ পদ্ধতি আয়ত্ব করতে পারেননি। এসময়ে অর্ধেকের বেশি শিক্ষক এ পদ্ধতিতে প্রশ্নই করতে পারেননি। শিক্ষকদের যথাযথ প্রশিক্ষণ না দেওয়ার ফলেই এমনটি হয়েছে। ফলে উদ্দেশ্য সফল হয়নি। এরইমধ্যে ২০২৩ শিক্ষাবর্ষে নতুন শিক্ষাক্রমে প্রবেশ করছে বাংলাদেশের প্রাথমিক ও মাধ্যমিকের শিক্ষাব্যবস্থা। এ বছর প্রথম, ষষ্ঠ ও সপ্তম শ্রেণিতে এ পদ্ধতি চালু হয়েছে। তিন বছরের মধ্যে সব শ্রেণিতে চালু হবে। তবে শিক্ষকদের প্রশিক্ষণ দেয়ার আগেই নতুন কারিকুলাম চালু নিয়ে সংশ্লিষ্ট মহলে বেশ হতাশা দেখা দিয়েছে।

সূত্রমতে, গত ডিসেম্বরে নতুন কারিকুলাম বিষয়ে প্রশিক্ষকদের প্রশিক্ষণ দেয়া হয়। আর সাধারণ শিক্ষকরা সরাসরি প্রশিক্ষণ নেয়ার আগে মাত্র দুটি অনলাইনে প্রশিক্ষণ পেয়েছেন। সরাসরি প্রশিক্ষণ না নিয়েই এসব শিক্ষক নতুন শিক্ষাক্রমের আলোকে পাঠদানের জন্য ক্লাসে গিয়ে বিপাকে পড়ছেন। যদিও গতকাল শুক্রবার থেকে সারাদেশে ৫ দিনের শিক্ষক প্রশিক্ষণ শুরু হয়েছে। তবে যে শিক্ষকরা এ প্রশিক্ষণের প্রশিক্ষকের দায়িত্ব পালন করছেন তারাই এখনও ঠিকমতো বিষয়টি বুঝে উঠতে পারেননি বলে জানা গেছে।

এ বিষয়ে একজন প্রশিক্ষক জানান, প্রশিক্ষক বাছাইয়ের ক্ষেত্রে তেমন যোগ্যতা যাচাই করা হয়নি। তাই প্রক্ষিকদের অনেকেই তেমন দক্ষ নন। তাছাড়া প্রশিক্ষক ও প্রশিক্ষণার্থীদের হাতে সব বিষয়ের শিক্ষক সহায়িকা ও পাঠ্যবই দেয়া হয়নি। এতে প্রশিক্ষণ কার্যক্রম বেশ ব্যহত হচ্ছে। অনলাইনে এসব সহায়িকা থাকলেও সবার পক্ষে তা ব্যবহার করা সম্ভব হচ্ছে না বলেও তিনি উল্লেখ করেন।

সংশ্লিষ্টরা বলেছেন, নতুন কারিকুলামে পাঠ্যসূচি বদলেছে, বদলেছে পাঠ্যবই এবং পরীক্ষা পদ্ধতিও। শিখনকালীন মূল্যায়ন করবেন শ্রেণি শিক্ষকরা। যে শিক্ষকরা শ্রেণিকক্ষে পড়াবেন তারা এ পদ্ধতি কতটা রপ্ত করতে পারলেন এটাই মুখ্য বিষয়। নতুন শিক্ষাক্রমে শ্রেণিকক্ষের বিভিন্ন কাজের মধ্য দিয়ে শিক্ষার্থীরা নির্ধারিত যোগ্যতাগুলো অর্জন করার চেষ্টা করবে। নতুন পদ্ধতিতে শিক্ষক সরাসরি কোনো বিষয় বা টপিক পড়ানো শুরু করবেন না। চারটি ধাপ অনুসরণ করে শিক্ষক পাঠদানের কাজটি করবেন।

এ বিষয়ে মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদপ্তরের (মাউশি) সাবেক মহাপরিচালক অধ্যাপক সৈয়দ মো. গোলাম ফারুক বলেন, এ শিক্ষাক্রমের মূল চ্যালেঞ্জ শিক্ষকদের প্রশিক্ষণ দেওয়া। শিক্ষকদের ওপর মূল্যায়নের অনেক ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে এ শিক্ষাক্রমে। তাই শিক্ষাক্রমের জন্য শিক্ষকদের প্রশিক্ষণের পাশাপাশি মানসিকতার পরিবর্তনও করতে হবে। বর্তমানে শিক্ষকরা পাঁচ দিন প্রশিক্ষণ পাবেন। শিক্ষকদের আরো প্রশিক্ষণের প্রয়োজন হবে।

অভিভাবকরা বলছেন, নতুন কারিকুলাম বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে শিক্ষকদের নির্ভরতা বাড়বে। নতুন কারিকুলামে প্রাক-প্রাথমিক থেকে শুরু করে তৃতীয় শ্রেণি পর্যন্ত শ্রেণিকক্ষে মূল্যায়ন হবে। এদের কোনো বার্ষিক পরীক্ষা হবে না। ৪র্থ থেকে ৮ম শ্রেণি পর্যন্ত ৬০ শতাংশ শ্রেণিকক্ষে মূল্যায়ন এবং ৪০ শতাংশ বার্ষিক পরীক্ষার মাধ্যমে মূল্যায়ন হবে। ৯ম ও দশম শ্রেণিতে ৫০ শতাংশ শ্রেণিকক্ষে মূল্যায়ন ও বাকি ৫০ শতাংশ পরীক্ষার মাধ্যমে মূল্যায়ন করা হবে। আর একাদশ-দ্বাদশে ৩০ শতাংশ শ্রেণিকক্ষে মূল্যায়ন ও ৭০ শতাংশ পরীক্ষার মাধ্যমে মূল্যায়ন হবে। অর্থাৎ শ্রেণিকক্ষেই মূল্যায়নেই বেশি গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। যা নির্ভর করবে শিক্ষকদের ওপর। আর যে শিক্ষার্থী ওই শিক্ষকের কাছে প্রাইভেট টিউশনি বা কোচিংয়ে পড়বে, এক্ষেত্রে ওই শিক্ষার্থীকে বেশি নম্বর পাওয়ার সুযোগ থেকেই যায়।

একজন প্রশিক্ষক বলেন, উন্নত বিশ্বে প্রচলিত এ কারিকুলাম তড়িঘড়ি করে বাংলাদেশে চালু করা হলেও সেখানে শিক্ষক-শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের যেসব সুযোগ-সুবিধা আছে, তা এদেশে নিশ্চিত করা হয়নি। উন্নত বিশ্বে এত ঘনঘন কারিকুলাম পরিবর্তনও হয় না। তাই নতুন কারিকুলামের ফল পেতে হলে অবশ্যই উন্নত বিশ্বের মতো অন্যান্য বিষয়গুলোও নিশ্চিত করতে হবে।

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত