ঢাকা ২০ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ৫ আশ্বিন ১৪৩১ | বেটা ভার্সন

জেঁকে বসেছে শীত

২০ জেলায় বইছে শৈত্যপ্রবাহ

*শীতে শিশুমৃত্যু বেড়েছে * কুয়াশায় ঢাকা সারা দেশ * বাড়ছে রোগব্যাধি * হাসপাতালগুলোয় শয্যা সংকট
২০ জেলায় বইছে শৈত্যপ্রবাহ

গত দুই বছরের চেয়ে এবার শীতের মৌসুমে তাপমাত্রা বেশি ওঠাণ্ডনামা করছে। আবহাওয়ার এমন অবস্থায় স্বস্তিতে নেই মানুষ। সর্দি-জ্বর, কাশি ও নিউমোনিয়াসহ বিভিন্ন শীতজনিত রোগে ভুগছে শিশু ও বয়স্করা। তীব্র ঠাণ্ডায় কয়েক দিনে সারা দেশে শিশু মৃত্যুর হারও বেড়েছে। সরকারি হাসপাতালগুলোর শিশু ওয়ার্ডে শয্যার চেয়ে রোগী বেশি ভর্তি হয়েছে। হাসপাতালে শয্যা সংকটে বাধ্য হয়ে মেঝে ও বারান্দাতেও চিকিৎসা নিতে হচ্ছে।

জানা গেছে, গত এক সপ্তাহ ধরে সারা দেশে শীতে শিশুদের ঠাণ্ডাজনিত রোগ বাড়তে শুরু করেছে। এতে বিভিন্ন হাসপাতালে ঠাণ্ডাজনিত রোগের প্রভাবে ২৮ জনের বেশি শিশুর মৃত্যু হয়েছে। রংপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের দুটি শিশু ওয়ার্ডে শয্যা ১৭৮টি। সেখানে ৪৫০ রোগী ভর্তি। খুলনা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে শয্যা রয়েছে ৫০০টি। সেখানে রোগী ভর্তি ছিল ১ হাজার ২২০ জন। দেশের প্রায় প্রতিটি হাসপাতালে শিশু ওয়ার্ডে শয্যা সংকট রয়েছে। তীব্র শীতে রোগ বালাইয়ের মধ্যে রয়েছে সর্দি-কাশি, নিউমোনিয়া, ডায়রিয়া, হাঁপানি, টনসিলাটাইসিস, ব্রংকিওলাইটিস, সাইনোসাইটিস, বাত, আর্থ্রাইটিস ও চামড়ার শুষ্কতা অন্যতম। এসব রোগ থেকে রেহাই পেতে হলে শীত এড়িয়ে চলতে হবে। প্রয়োজনে চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হবে।

ঢাকা শিশু হাসপাতালের সহযোগী অধ্যাপক ডা. সারাবন তহুরা বলেন, শীতের মৌসুমে হাসপাতালে রোগীর সংখ্যা বাড়ছে। সাড়ে ৭০০ বেডের হাসপাতালটিতে কোনো সময়ই শয্যা খালি থাকছে না। শীতে নিউমোনিয়া, ডায়রিয়া অ্যাজমা ও ব্রঙ্কিওলাইটিস বেশি আক্রান্ত হচ্ছে শিশুরা।

গতকাল রবিবার রাজধানীতে সকালে হাড়কাঁপানো শীতের অনুভূতি হলেও দুপুরে কিছুটা উষ্ণ আবহাওয়া ছিল। তবে বেলা গড়ার সঙ্গে শীতের মাত্রা বেড়ে যায়। ঢাকা, সিলেট ও পার্বত্য অঞ্চলে শীত কমলেও সীমান্তবর্তী জেলাগুলোয় শৈত্যপ্রবাহ বয়ে যায়। শীতের এমন বৈচিত্রতা আগামী ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত থাকতে পারে বলে জানিয়েছে আবহাওয়া অধিদপ্তর। বিশেষ করে হিমালয় পাদদেশীয় পঞ্চগড়সহ উত্তরের সব এলাকায় বেশ কয়েকদিন শৈত্যপ্রবাহ চলবে।

গতকাল দেশের মধ্যে যশোরে সর্বনিম্ন তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয়েছে। এ জেলায় সকালে দেশের সর্বনিম্ন তাপমাত্রা ৭.৮ ডিগ্রি সেলসিয়াস রেকর্ড করা হয়েছে। আবহাওয়ার সিনপটিক অবস্থা, উপমহাদেশীয় উচ্চচাপ বলয়ের বর্ধিতাংশ পশ্চিমবঙ্গ ও তৎসংলগ্ন বাংলাদেশের উত্তরপশ্চিম এলাকায় অবস্থান করছে। মৌসুমের স্বাভাবিক লঘুচাপ দক্ষিণ বঙ্গোপসাগরে অবস্থান করছে, যার বর্ধিতাংশ উত্তর বঙ্গোপসাগর পর্যন্ত বিস্তৃত রয়েছে। পূর্বাভাসে বলা হয়েছে, অস্থায়ীভাবে আংশিক মেঘলা আকাশসহ সারাদেশের আবহাওয়া শুষ্ক থাকতে পারে। তবে আগামী তিন দিনে দেশের আবহাওয়া পরিস্থিতি সামান্য পরিবর্তন হতে পারে।

আবহাওয়া অধিদপ্তরের আবহাওয়াবিদ মো. বজলুর রশিদ বলেন, ২০ জেলায় শৈত্য প্রবাহ বয়ে যাচ্ছে। রংপুর, রাজশাহী, বগুড়া, চাঁপাই নবাবগঞ্জ, জয়পুরহাট, পাবনা, নওগাঁ, নাটোর, রাজশাহী, সিরাজগঞ্জ, কুড়িগ্রাম, লালমনিরহাট, গাইবান্ধা, দিনাজপুর, পঞ্চগড়, ঠাকুরগাঁও, নীলফামারী, যশোর, চুয়াডাঙ্গার ওপর দিয়ে শৈত্যপ্রবাহ বয়ে গেছে।

আবহাওয়াবিদ বজলুর রশিদ বলেন, গতকাল রাজধানী ঢাকার তাপমাত্রা কিছুটা বেড়েছে। সকালে ঢাকাতে সর্বনিম্ন তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয়েছে ১২.৩ ডিগ্রি সেলসিয়াস। গত শনিবারের তুলনায় গতকাল রাজধানীর তাপমাত্রা কিছুটা বেড়েছে। তবে ঢাকায় কুয়াশা সেভাবে কমার কোনো আভাস নেই। কুয়াশা খুবই সামান্য পরিমাণে কমলেও ঢাকার আকাশ পরিষ্কার হবে না।

রংপুর: গত এক সপ্তাহ রংপুর অঞ্চলের ওপর দিয়ে বইছে শৈত্যপ্রবাহ। এর ফলে শীতজনিত রোগে আক্রান্ত হচ্ছে শিশু ও বয়স্করা। শীতে ৫ জনের বেশি শিশু ও নবজাতকের মৃত্যু হয়েছে। এ ব্যাপারে রংপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের শিশু ওয়ার্ডের বিভাগীয় প্রধান সুজাউদ্দৌলা বলেন, শীতের প্রকোপে শিশুরা কাহিল হয়ে পড়ছে। কারণ এতে নবজাতকদের শ্বাসকষ্ট, নিউমোনিয়া দেখা দেয়। নবজাতকের ক্ষেত্রে অপরিপক্ব ও কম ওজনের শিশু জন্মের সময় মাথায় আঘাত পাওয়ায় শিশুদের মৃত্যু হয়েছে। গত এক সপ্তাহে বেশ কয়েকজন শিশু ও নবজাতকের মৃত্যু হয়েছে।

মাদারীপুর: মাদারীপুরে গত কয়েকদিনে বেড়েছে শীতজনিত রোগাক্রান্তের সংখ্যা। গত এক সপ্তাহে জেলা সদর হাসপাতালে ডায়রিয়া, নিউমোনিয়া ও শ্বাসকষ্ট নিয়ে ভর্তি হয়েছেন পাঁচশতাধিক রোগী। মাদারীপুর জেলা সদর হাসপাতালের মেডিকেল অফিসার ডা. রিয়াদ মাহমুদ বলেন, ঠাণ্ডা বাতাস যেন না লাগে সেদিকে সবাইকে খেয়াল রাখতে হবে। শিশু ও বৃদ্ধদের গরম পোশাক পড়ে থাকতে হবে। অসুস্থ হলে তাৎক্ষনিক হাসপাতালে এসে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হবে।

চুয়াডাঙ্গা: চুয়াডাঙ্গায় টানা তিন দিন ধরে দেশের সর্বনিম্ন তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয়েছে। চুয়াডাঙ্গা সদর হাসপাতালে গত তিন দিনে ডায়রিয়া ওয়ার্ডে শিশুসহ ভর্তি হয়েছে ১০৩ জন রোগী। শিশু ওয়ার্ডে ভর্তি হয়েছে ৬৮ শিশু, এর মধ্যে নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত ১৯ শিশু। এছাড়া প্রতিদিন বহির্বিভাগে শ্বাসকষ্ট, ডায়রিয়াসহ শীতজনিত বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত প্রায় চার শতাধিক শিশু, বয়োবৃদ্ধ চিকিৎসা নিচ্ছেন। চুয়াডাঙ্গা সদর হাসপাতালের তত্ত্বাবধায়ক ডা. মো. আতাউর রহমান বলেন, তীব্র শীতে রোটা ভাইরাসের কারণে ডায়রিয়া ও নিউমোনিয়া রোগীর সংখ্যা বাড়ছে। বেশিরভাগই শিশু রোগী। শ্বাসকষ্ট, ডায়রিয়াসহ শীতজনিত বিভিন্ন রোগে হাসপাতালের আউটডোরে প্রায় সাত শতাধিক বয়োবৃদ্ধ চিকিৎসা নিচ্ছেন। এছাড়া প্রতিদিন প্রায় ৪শ শিশু আউটডোরে চিকিৎসা নিচ্ছে। শীতজনিত কারণে নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা বাড়ছে।

শৈত্যপ্রবাহ শেষ হলেও মাসব্যাপী থাকবে শীত। গতকাল ঢাকায় সর্বনিম্ন তাপমাত্রা ১২ ডিগ্রি সেলসিয়াসের নিচে ছিল। এছাড়া অন্যান্য বিভাগের মধ্যে সর্বনিম্ন তাপমাত্রা ছিল খুলনা বিভাগের যশোর ও চুয়াডাঙ্গা ৭ দশমিক ৮ ডিগ্রি সেলসিয়াস। ময়মনসিংহে ১০ দশমিক ৬, চট্টগ্রামে ১৫ দশমিক ৫, সিলেটে ১৫ দশমিক ৬, রাজশাহীতে ৮ দশমিক ৫, রংপুরে ১০ দশমিক ২ এবং বরিশালে ১১ দশমিক ৭ ডিগ্রি সেলসিয়াস।

আবহাওয়া অধিদপ্তরের সূত্র জানায়, এ বছর জানুয়ারি জুড়ে তীব্র শীতের প্রকোপ থাকবে। ফেব্রুয়ারির মাঝামাঝি ধীরে ধীরে শীত বিদায় নেবে এবং তাপমাত্রা বাড়তে থাকবে। প্রায় প্রতি বছর ডিসেম্বর ও জানুয়ারি দেশজুড়ে ঘন কুয়াশার চাদরে মুড়ে থাকে। সকাল-বিকেল এমনকি সারাদিনও কুয়াশাচ্ছন্ন থাকে। এ বছরও ডিসেম্বরের শেষের দিকে কয়েকদিন সকাল-বিকেল ঘন কুয়াশা দেখা গেছে। ২০২১ সালের নভেম্বর ডিসেম্বরে শীত জেঁকে বসতে পারেনি। কিন্তু এবার ডিসেম্বরে শীত জেঁকে বসেছে। তাপমাত্রা স্বাভাবিকের চেয়ে বেশি কমেছে।

ঢাকা শিশু হাসপাতালের পরিচালক অধ্যাপক ডা. মোহাম্মদ জাহাঙ্গীর আলম বলেন, প্রত্যেক বছরে শীতে সর্দি, ঠাণ্ডা, কাশি, জ্বর হাঁপানি, গলাব্যথা ও নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা বাড়ে। এবারও শীতের মৌসুমে হাসপাতালে রোগীর চাপ বেড়েছে। শীতের সময়ে শিশুদের মাথা ঢেকে রাখতে হবে, কাপড় পরিয়ে রাখতে হবে। ছয় মাসের কম বয়সী শিশুর ঠ-া লাগলেই ঘন ঘন বুকের দুখ খাওয়াতে হবে। শিশুদের নাক সবসময় পরিষ্কার রাখতে হবে। কুসুম গরম পানি খাওয়াতে হবে।

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত