রাজধানীসহ ১০ বিভাগে যুগপৎ গণঅবস্থান পালিত

১৬ জানুয়ারি দেশব্যাপী বিক্ষোভ কর্মসূচি

আওয়ামী লীগ জনবিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে : মির্জা ফখরুল

প্রকাশ : ১২ জানুয়ারি ২০২৩, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ

  নিজস্ব প্রতিবেদক

যুগপৎ আন্দোলনের অংশ হিসেবে আগামী ১৬ জানুয়ারি দেশব্যাপী বিক্ষোভ সমাবেশ ও মিছিলের কর্মসূচি ঘোষণা করেছে বিএনপি। বর্তমান সরকারের পদত্যাগ, সংসদ বিলুপ্ত করা ও নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে নির্বাচনসহ ১০ দফা দাবির পাশাপাশি গ্রাহক পর্যায়ে বিদ্যুতের দাম ১৫ শতাংশ বৃদ্ধির সরকারি উদ্যোগের প্রতিবাদে এ বিক্ষোভ করবে দলটি। গতকাল বুধবার রাজধানীর নয়াপল্টনে অনুষ্ঠিত ‘গণঅবস্থান’ কর্মসূচিতে প্রধান অতিথির বক্তব্যে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর এ কর্মসূচি ঘোষণা করেন। এসময় বিএনপির মহাসচিব বলেন, সরকার অন্যায়ভাবে গ্যাস, বিদ্যুতের দাম বাড়াচ্ছে। জনগণ আর পারছে না। ১৬ জানুয়ারি বিদ্যুতের দাম বাড়ানোর প্রক্রিয়ার প্রতিবাদে কেন্দ্রসহ জেলা-উপজেলা, মহানগর, পৌরসভায় সমাবেশ ও বিক্ষোভ মিছিল করা হবে। ১০টি বিভাগীয় শহরে (সাংগঠনিক বিভাগ) বিএনপি ঘোষিত যুগপৎ কর্মসূচির অংশ হিসেবে নয়াপল্টনে দলের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের সামনের সড়কে এ গণঅবস্থানের আয়োজন করা হয়। বেলা সাড়ে ১০টায় শুরু হওয়া গণঅবস্থানে সভাপতিত্ব করেন দলের স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন। প্রায় ৪ ঘণ্টাব্যাপী এ কর্মসূচিতে দলের কেন্দ্রীয় ও মহানগর নেতারা বক্তব্য দেন। ১০ দফা দাবিতে বিএনপির নেতৃত্বে বিভিন্ন দল ও জোট গত ২৪ ডিসেম্বর থেকে যুগপৎ আন্দোলন শুরু করেছে। গতকালের গণঅবস্থান ছিল তাদের দ্বিতীয় যুগপৎ কর্মসূচি। এর আগে গত ২৪ ডিসেম্বর ৮ বিভাগীয় শহরে এবং ৩০ ডিসেম্বর ঢাকা ও রংপুরে প্রথম কর্মসূচিতে গণমিছিল করেছিল বিএনপিসহ সমমনা দলগুলো।

নয়াপল্টনের গণঅবস্থানে প্রধান অতিথির বক্তব্যে মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, সারা দেশের জনগণ জেগে উঠেছে। আন্দোলন শুরু হয়ে গেছে। এই আন্দোলন আজকের নয়; এই আন্দোলন শুরু হয়েছে তখন থেকে, যখন থেকে বেআইনিভাবে দুই-দুইবার ভোট ব্যবস্থাকে ধ্বংস করে বেআইনিভাবে জোর করে তারা ক্ষমতা দখল করেছে। আওয়ামী লীগ দল হিসেবে দেউলিয়া হয়ে গেছে বলে মন্তব্য করে তিনি বলেন, আমরা জানি, আওয়ামী লীগ একটি অত্যন্ত পরিচিত পুরোনো দল। কিন্তু আওয়ামী লীগ এখন সম্পূর্ণভাবে রাজনৈতিক ঐতিহ্য হারিয়ে ফেলেছে; আওয়ামী লীগ জনবিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে। তাদের এখন পুলিশের ওপর নির্ভর করে, আমলাদের ওপর নির্ভর করে রাষ্ট্রক্ষমতায় থাকতে হচ্ছে। সব রাজনৈতিক দল একত্র হয়েছে-উল্লেখ করে বিএনপি মহাসচিব বলেন, এই সরকারকে সরিয়ে দেয়ার জন্য, গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করার জন্য, মানুষের ভোটের অধিকার ফিরিয়ে আনার জন্য সব দল একমত হয়েছে। তারা ১০ দফা কর্মসূচির মাধ্যমে এই আন্দোলন সফল করবে। তিনি বলেন, অবিলম্বে সরকারকে পদত্যাগ ও সংসদ বিলুপ্ত করতে হবে। নির্দলীয়-নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে নির্বাচনের ব্যবস্থা করতে হবে।

মির্জা ফখরুল বলেন, সাধারণ মানুষ আজ বলছে, তারা আর পারে না। চাল কিনতে পারে না। খাদ্য কিনতে পারে না। সরকার লুটের রাজ্য গড়ে তুলেছে। তাদের লক্ষ্য হচ্ছে সবকিছু নিয়ন্ত্রণ করে আবারও একদলীয় শাসন কায়েম করা। আমরা সেটা হতে দেব না। আমরা খালেদা জিয়াকে মুক্ত করব। আমাদের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যানকে দেশে ফিরিয়ে আনতে হবে। আজকে জনগণ জেগে উঠেছে; সুশীল সমাজের প্রতিনিধিরা জেগে উঠেছে। গণমাধ্যমও ভূমিকা রাখছে। বিএনপির চলমান সরকারবিরোধী আন্দোলনে এখন পর্যন্ত ১৫ জন নিহত হয়েছেন জানিয়ে মির্জা ফখরুল বলেন, গত ৭ ডিসেম্বর এই নয়াপল্টনে মকবুলের লাশ পড়ে ছিল। সরকারের লেলিয়ে দেয়া পুলিশ বাহিনীর গুলিতে শত শত কর্মী আহত হন। বহু নেতাকর্মীকে গ্রেপ্তার করা হয়। কেরানীগঞ্জের কেন্দ্রীয় কারাগারে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা আন্দোলনের ৬ শতাধিক কর্মীকে অমানবিকভাবে রাখা হয়েছে। গত ১০ ডিসেম্বর ঢাকায় বিএনপির গণসমাবেশের দুদিন আগে মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরকে ধরে নিয়ে যায় পুলিশ। তিনি বলেন, সব ষড়যন্ত্রকে নস্যাৎ করে ১০ ডিসেম্বর গোলাপবাগে সফল সমাবেশ হয়েছে। যারা কারাগারে রয়েছেন, তারা দেশের জন্য ত্যাগ স্বীকার করছেন। বিএনপি মহাসচিব বলেন, আমাদের নেতাকর্মীদের গ্রেপ্তার করেও ১০ ডিসেম্বর ঢাকার গণসমাবেশ বানচাল করা যায়নি; ঢাকাসহ দেশের মানুষ সফল করেছেন। আসুন, আমরা ৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বাস্তবায়ন করার লক্ষ্যে নতুন প্রজন্মের জন্য বাসযোগ্য দেশ গড়তে ঐক্যবদ্ধ হই। জামিনে মুক্তি পাওয়ার দুই দিন পরই বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর ঢাকার এ গণঅবস্থানে প্রধান অতিথি হিসেবে অংশগ্রহণ করেন। বেলা সাড়ে ১১টায় তিনি কর্মসূচিস্থলে পৌঁছাছে নেতাকর্মীরা স্লোগান ও করতালিতে তাকে স্বাগত জানান। সদ্য কারামুক্ত আরেক নেতা মির্জা আব্বাসও উপস্থিত ছিলেন গণঅবস্থান কর্মসূচিতে। সকাল ১০টায় গণঅবস্থান কর্মসূচি শুরু হওয়ার কথা থাকলেও তার আগে থেকেই নয়াপল্টনে বিএনপির কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের সামনে নেতাকর্মীরা জড়ো হওয়া শুরু করেন। সাড়ে ১০টায় আনুষ্ঠানিকভাবে কর্মসূচি শুরুর সময় নেতাকর্মীতে ভরে যায় নয়াপল্টনের সড়ক। এসময় তাদের হাতে নানা স্লোগান সম্বলিত ব্যানার ও ফেস্টুন ছিল। দলের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের সামনে ছোট মঞ্চ থেকে নেতারা বক্তব্য দেন। এসময় স্লোগান দিয়ে পুরো এলাকা সরব করে রাখেন নেতাকর্মীরা। অনুষ্ঠান পরিচালনা করেন সাংগঠনিক সম্পাদক আবদুস সালাম আজাদ, ঢাকা মহানগর উত্তরের সদস্য সচিব আমিনুল হক ও দক্ষিণের সদস্য সচিব রফিকুল আলম মজনু। বক্তব্য দেন বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য মির্জা আব্বাস, ভাইস চেয়ারম্যান আব্দুল্লাহ আল নোমান, এ জেডএম জাহিদ হোসেন, সহ-দপ্তর সম্পাদক তাইফুল ইসলাম টিপু, মহিলা দলের সভাপতি আফরোজা আব্বাস, স্বেচ্ছাসেবক দলের সাধারণ সম্পাদক রাজিব আহসান, যুবদলের সাধারণ সম্পাদক আব্দুল মোনায়েম মুন্না, মহিলা দলের ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক হেলেন জেরিন খান, ছাত্রদলের সভাপতি কাজী রওনকুল ইসলাম শ্রাবণ, সাধারণ সম্পাদক সাইফ মাহমুদ জুয়েল প্রমুখ। একই সময়ে দলের স্থায়ী কমিটির সদস্যদের মধ্যে চট্টগ্রামে আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী, রাজশাহীতে ড. আবদুল মঈন খান, সিলেটে গয়েশ্বর চন্দ্র রায়, বরিশালে সেলিমা রহমান, ময়মনসিংহে নজরুল ইসলাম খান, রংপুরে ইকবাল হাসান মাহমুদ টুকু, ভাইস চেয়ারম্যানের মধ্যে কুমিল্লায় বরকত উল্লাহ বুলু ও খুলনায় শামসুজ্জামান দুদু এবং ফরিদপুরে আহমেদ আজম খান অবস্থান কর্মসূচিতে অংশ নিয়ে বক্তব্য দেন।

ঢাকায় এই গণঅবস্থান কর্মসূচির জন্য মঙ্গলবার সন্ধ্যায় পুলিশের অনুমতি পায় বিএনপি। এ কর্মসূচি ঘিরে নয়াপল্টনের পুরো এলাকায় বিপুল সংখ্যক পুলিশ সতর্ক অবস্থান নেয়। কাকরাইল ও ফকিরাপুল মোড়ে জলকামান নিয়ে পুলিশ সদস্যরা অবস্থান নিতে দেখা যায়। এর বাইরেও বিভিন্ন সড়কের মোড়ে মোড়ে পুলিশ মোতায়েন ছিল। নেতাকর্মীদের ভিড় একপাশে ফকিরাপুল ছাড়িয়ে দৈনিক বাংলা মোড়, আরেকপাশে কাকরাইলের নাইটিঙ্গেল মোড় ছাড়িয়ে যায়। এসময় নয়াপল্টনের সড়কে যানচলাচল বন্ধ ছিল।

এদিকে জাতীয় প্রেসক্লাবের সামনে গণতন্ত্র মঞ্চ, পূর্বপ্রান্তে গণতান্ত্রিক বাম ঐক্য, আরামবাগের ইডেন কমপ্লেক্সে কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের সামনে গণফোরাম, বিজয়নগরের পানির ট্যাংকের কাছ থেকে ১২ দলীয় জোট, পুরানা পল্টনে সমমনা জাতীয়তাবাদী জোট এবং কারওয়ান বাজারে এফডিসির কাছে কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের সামনে এলডিপিও আলাদা আলাদাভাবে একই কর্মসূচি পালন করে। তবে এসব দল ও জোটের কর্মসূচিতে উপস্থিতি ছিল খুবই কম। ঢাকার বাইরে ফরিদপুর ও ময়মনসিংহে বিএনপির অবস্থান কর্মসূচিতে হামলার অভিযোগ করা হয়েছে দলটির পক্ষ থেকে। ঢাকার গণঅবস্থানে দেয়া বক্তব্যে মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর এ অভিযোগ করেন।

পরে দলের মিডিয়া সেলের সদস্য শায়রুল কবির খান জানান, ফরিদপুরে বিএনপির গণঅবস্থানে আওয়ামী ছাত্রলীগ, যুবলীগ লাঠিসোটা ও আগ্নেয়াস্ত্র নিয়ে হামলা করে। এতে অর্ধশত নেতাকর্মী আহত হন। পুলিশ টিয়ারগ্যাস নিক্ষেপ ও লাঠিচার্জ করে বিএনপির অনেক নেতাকর্মীকে গ্রেপ্তার করে।