প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা জি-২০ জোটের সামনে ছয়টি প্রস্তাব রেখে বলেছেন, টেকসই বৈশ্বিক অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি এবং ‘বৈশ্বিক দক্ষিণ’ (গ্লোবাল সাউথ)-এর উন্নয়নের লক্ষ্যে এসব প্রস্তাব সম্মিলিতভাবে সমাধান করা প্রয়োজন।
তিনি বলেন, ‘বর্তমান বৈশ্বিক অর্থনীতিকে (রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ এবং কোভিড-১৯ মহামারির প্রেক্ষাপট) বিবেচনায় নিয়ে-একটি ন্যায্য ও গ্রহণযোগ্য অর্থনৈতিক ব্যবস্থার জন্য সম্মিলিতভাবে কাজ করার এখনই উপযুক্ত সময়।’
প্রধানমন্ত্রী ভারতের নয়াদিল্লিতে অনুষ্ঠিত ‘ভয়েস অব দ্য সাউথ সামিট ২০২৩’-এর উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে গণভবন থেকে গতকাল ভার্চুয়ালি যোগদান করে দেয়া ভাষণে এ কথা বলেন। এই গুরুত্বপূর্ণ শীর্ষ সম্মেলনে বাংলাদেশকে অতিথি দেশ হিসেবে আমন্ত্রণ জানানোর জন্য প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ভারত সরকারকে ধন্যবাদ জানিয়ে বলেন, এই সম্মেলন তাদের বিশ্বজুড়ে তাদের সমকক্ষদের সঙ্গে যুক্ত হওয়ার এক অনন্য সুযোগ করে দেবে। এরই পরিপ্রেক্ষিতে তিনি বলেন, বাংলাদেশ গ্লোবাল সাউথের একটি দেশ, ‘এক পৃথিবী, এক পরিবার, এক ভবিষ্যৎ’ ধারণার আওতায় অন্তর্ভুক্তিমূলক উন্নয়ন নিশ্চিত করার জন্য জি-২০ এর প্রেসিডেন্ট হিসেবে ভারতের দৃষ্টিভঙ্গিকে স্বাগত জানায়।
‘আসুন আমরা একটি সুন্দর ভবিষ্যৎ এবং একটি উন্নত বিশ্বের জন্য একসঙ্গে কাজ করি,’ তিনি যোগ করেন। টেকসই বৈশ্বিক অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি অর্জনের জন্য তার প্রথম প্রস্তাবে তিনি বলেন, মানবতার বৃহত্তর স্বার্থে বিশ্ব শান্তি ও স্থিতিশীলতা বজায় রাখতে হবে। দ্বিতীয়ত, তিনি বলেন, একটি নতুন দৃষ্টান্ত প্রয়োজন. যা এসডিজির সমান্তরালে সামগ্রিকভাবে বৈষম্যকে মোকাবিলা করবে।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, তৃতীয়ত, স্বল্পোন্নত দেশ, জলবায়ু ঝুঁকিপূর্ণ দেশগুলোসহ সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ দেশগুলোর জন্য বিশেষ অর্থায়নের প্রয়োজন, তাদের উত্তরণের সময় এটি পূরণ করতে হবে।
তার চতুর্থ প্রস্তাবে, তিনি নারীসহ সকলের জন্য সমান সুযোগ নিশ্চিত করতে ‘ডিজিটাল ডিভাইডস’ সেতুবন্ধন রচনার প্রয়োজনীয়তার ওপর জোর দেন। তরুণ জনগোষ্ঠীর মধ্যে বিনিয়োগ করে চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের সুবিধা নিন যার জন্য অর্থায়ন এবং প্রযুক্তি হস্তান্তর সমর্থন অত্যাবশ্যক- তিনি যোগ করেন।
পঞ্চমত, তিনি বলেন, সব মানুষেরই ভালোভাবে জীবনযাপনের সমান অধিকার থাকা উচিত। তিনি বলেন, ‘বৈশ্বিক সম্প্রদায় দুর্ভাগ্যজনকভাবে জোরপূর্বক বাস্তুচ্যুত মিয়ানমারের নাগরিকদের মিয়ানমারে প্রত্যাবর্তন নিশ্চিত করতে যেন ভুলবেন না।’
প্রধানমন্ত্রী বলেন, বৈশ্বিক মানব উন্নয়ন নিশ্চিত করতে সাউথ-সাউথ ও ত্রিপক্ষীয় সহযোগিতা জোরদার করুন। তিনি বলেন, ‘এখানে, অংশীদার, আন্তর্জাতিক আর্থিক প্রতিষ্ঠান, বেসরকারি খাত, থিঙ্ক-ট্যাঙ্ক এবং অন্যান্য স্টেকহোল্ডারদের কাছ থেকে সমর্থন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।’ শেখ হাসিনা বলেন, প্রায় পাঁচ দশক আগে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ‘মহান অর্থনৈতিক উত্থান’র মুখে একটি ন্যায়সঙ্গত আন্তর্জাতিক অর্থনৈতিকব্যবস্থা গড়ে তোলার জন্য জরুরি বোধ তৈরি করার আহ্বান জানিয়েছিলেন। প্রধানমন্ত্রী জি-২০ প্রেসিডেন্ট হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণের জন্য ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি এবং ভারত সরকারকে আন্তরিক অভিনন্দন জানান।
তিনি বলেন, ‘অন্তর্ভুক্তিমূলক উন্নয়নের বিষয়ে পরামর্শমূলক কার্যক্রমের মাধ্যমে জি-২০ প্ল্যাটফর্মকে আরও অর্থবহ করার জন্য তার দৃঢ় প্রতিশ্রুতিকে আমি গভীরভাবে উপলব্ধি করি।’
তিনি ‘ভয়েস অব দ্য সাউথ সামিট’ আহ্বান করার জন্য এবং ‘মানবকেন্দ্রিক উন্নয়ন’ বিষয়ক উদ্বোধনী নেতাদের অধিবেশনে তাকে আমন্ত্রণ জানানোর জন্য প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদিকেও অভিনন্দন জানান।
শেখ হাসিনা বলেছেন, বাংলাদেশে, তারা টেকসই উন্নয়নের স্তম্ভ হিসেবে মানব উন্নয়নের প্রকৃত মূল্যে বিশ্বাস করেন এবং এটা তাদের নীতিতে প্রতিফলিত হয়। তিনি বলেন, ‘আমরা বিশ্ব নেতাদের সঙ্গে সহযোগিতায় মানবকেন্দ্রিক উন্নয়নকে ত্বরান্বিত করার জন্য আপনার (মোদির) জোরাল উদ্যোগে অবদান রাখতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ।’
প্রধানমন্ত্রী বলেন, সাম্প্রতিক কোভিড-১৯ মহামারি এবং নিষেধাজ্ঞা ও পাল্টা নিষেধাজ্ঞা নিয়ে চলমান রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ বিশ্বজুড়ে বিপর্যয় সৃষ্টি করেছে। তিনি আরও বলেন, বিশ্বব্যাপী মন্দা, খাদ্য, জ্বালানি ও সারের সংকট জলবায়ু পরিবর্তনের ক্রমবর্ধমান প্রভাবকে যুক্ত করে মানুষের জীবনকে অসহনীয় করে তুলেছে।
জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৭৪ সালে ইউএনজিএতে তার যে প্রথম ভাষণ দেন তা উদ্ধৃত করে, তিনি বলেন, ‘একটি আন্তর্জাতিক দায়িত্ব¡ রয়েছে, নিজের এবং তার পরিবারের প্রত্যেকের স্বাস্থ্য ও সুস্থতার জন্য পর্যাপ্ত মানসম্মত জীবনযাপনের অধিকার নিশ্চিত করার।’ এই দৃষ্টিভঙ্গি আজও প্রাসঙ্গিক। এই চেতনা সামনে রেখে, আমরা কেন্দ্রে মানুষের সাথে অন্তর্ভুক্তিমূলক উন্নয়ন নিশ্চিত করার জন্য যথাসাধ্য চেষ্টা করছি- তিনি যোগ করেন।
তিনি বলেন, গত একদশকে বাংলাদেশ সবার জন্য সামাজিক ন্যায়বিচার নিশ্চিত করে দ্রুত অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি অর্জন করেছে।
তিনি বলেন, ‘বাংলাদেশ বিশ্বের দ্রুত বর্ধনশীল অর্থনীতির একটি হিসাবে স্বীকৃত’ প্রধানমন্ত্রী বলেন, বাংলাদেশে গত ১৪ বছরে দারিদ্র্যের হার ৪১ দশমিক ৫ শতাংশ থেকে ২০ শতাংশে নেমে এসেছে, যেখানে মাত্র একদশকে মাথাপিছু আয় তিনগুণ হয়েছে। তিনি বলেন, বাংলাদেশ এলডিসি স্তর থেকে উন্নয়নশীল দেশে উন্নীত হওয়ার জন্য সব শর্ত পূরণ করেছে।
‘এটি সন্তোষজনক যে বাংলাদেশ বিশ্বের পঞ্চম সেরা কোভিড প্রতিরোধী দেশ এবং দক্ষিণ এশিয়ার সেরা পারফরমার হিসাবে স্থান পেয়েছে’ বলেন তিনি। আর্থিক এবং অন্যান্য প্রণোদনার জন্য, ২ কোটি মার্কিন ডলারের বেশি মূল্যের ২৮টি প্যাকেজ সরাসরি ৭ কোটি ৩ লাখ লোক এবং ২ লাখ ১৩ হাজার সংস্থার কাছে পৌঁছেছে- বলেন তিনি। তিনি বলেন, ‘আমরা একটি শক্তিশালী অর্থনীতির ভিত্তি হিসেবে উন্নত ভৌত অবকাঠামো দিয়ে ‘স্মার্ট বাংলাদেশ’ গড়তে আকাঙ্ক্ষা রাখি।’ শেখ হাসিনা বলেন, গত বছর তারা স্ব-অর্থায়নে পদ্মা বহুমুখী সেতু উদ্বোধন করেছেন, যা জিডিপি বাড়াবে। প্রধানমন্ত্রী বলেন, কয়েক দিন আগে ঢাকায় প্রথম মেট্রোরেল সার্ভিস চালু হয়েছে। তিনি বলেন, শিগগিরই আমরা চট্টগ্রামের কর্ণফুলী নদীর তলদেশে ৩ দশমিক ২ কিলোমিটার বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান টানেলের কাজ শেষ করব, যা দক্ষিণ এশিয়ায় প্রথম।
এরই মধ্যে, বাংলাদেশের অব্যাহত ‘আশ্রয়ণ প্রকল্প’ ৩৫ লাখ মানুষকে বিনা খরচে ঘর এবং জীবিকার উপায় প্রদান করেছে বলেও তিনি উল্লেখ করেন। ‘আমাদের জনগণের জীবনযাত্রার মান বাড়ানোর জন্য, আমরা আরও কয়েকটি মেগা প্রকল্প হাতে নিচ্ছি। এসব প্রকল্পের জন্য, আমাদের উন্নত বিশ্বের কাছ থেকে ব্যাপক আর্থিক এবং প্রযুক্তিগত সহায়তা প্রয়োজন। এই বিষয়ে, আমি আশা করি জি-২০ সহায়ক হবে। তিনি বলেন, তাদের আশঙ্কা হচ্ছে ২০৪১ সালের মধ্যে বাংলাদেশকে একটি জ্ঞানভিত্তিক দেশে রূপান্তরিত করা এবং ২১০০ সালের মধ্যে একটি সমৃদ্ধ ও জলবায়ু সহনশীল ব-দ্বীপ গড়ে তোলা। ‘আমরা টেকসই অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি নিশ্চিত করার জন্য এবং সবার জন্য সুযোগ সৃষ্টির মাধ্যমে এই লক্ষ্যগুলো অর্জন করার প্রত্যাশা করি,’ তিনি যোগ করেন।