ঢাকা ২০ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ৫ আশ্বিন ১৪৩১ | বেটা ভার্সন

অনৈতিক লেনদেনে টিকে আছে স্পা সেন্টারগুলো

অনৈতিক লেনদেনে টিকে আছে স্পা সেন্টারগুলো

রাজধানীতে গড়ে ওঠা স্পা সেন্টারের আড়ালে মাদক ও দেহ ব্যবসার অভিযোগ পুরোনো। সাম্প্রতিক সময়ে গুলশানের ‘অল দ্য বেস্ট’ নামে স্পা সেন্টারে অভিযানকে কেন্দ্র করে দুই তরুণীর মৃত্যু হয়েছে। অভিযানকালে পরিচয় লুকানোর চেষ্টা করতে গিয়ে বহুতল ভবন থেকে পড়ে তাদের মৃত্যুর ঘটনায় ফের নেতিবাচক খবরের শিরোনামে জায়গা করে নিয়েছে রাজধানীর স্পা সেন্টারগুলো।

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, প্রায় এক দশক আগ থেকে অভিজাত এলাকা গুলশান-বনানীতে একটি-দুটি করে গড়ে উঠে এসব স্পা সেন্টার। সেগুলো ধীরে ধীরে ছড়িয়ে গেছে রাজধানীর অলিগলিতেও। সিটি করপোরেশন থেকে সেলুন, বিউটি পার্লার, ব্যায়ামাগার বা ফিটনেস সেন্টার ও ক্ষুদ্র ব্যবসার লাইসেন্সের আড়ালে গড়ে তোলা হয় এসব কথিত স্পা সেন্টার। সেগুলোর অধিকাংশের বিরুদ্ধে মাদক ও দেহব্যবসার অভিযোগ রয়েছে। সেই সঙ্গে উঠতি বয়সের তরুণীদের দিয়ে গ্রাহকদের স্পা করানোর নামে অশ্লীল কর্মকাণ্ড এবং স্বল্প পোশাকে সেবা দেয়ার সময়ের ছবি ধারণ করে পরবর্তীতে চলে ব্ল্যাকমেইলও।

থানা পুলিশ, সংশ্লিষ্ট সিটি করপোরেশনের কর্মকর্তা ও স্থানীয় প্রভাবশালী নেতাদের মাসোয়ারা দিয়ে এ ব্যবসা নির্বিঘ্নে চালানোর তথ্য পাওয়া গেছে। নিয়মিত মাসোযাারায় টান পড়লে অভিযানের নামে হয়রানি করার অভিযোগও রয়েছে সংশ্লিষ্টদের বিরুদ্ধে। রাজধানীর দুই সিটি করপোরেশনের আওতাধীন এলাকায় মোট কতগুলো এমন স্পা সেন্টার আছে, তার সঠিক হিসেব নেই। তবে তা হাজারের কম নয় বলে ধারণা সংশ্লিষ্টদের। এর মধ্যে কয়েকশ স্পা সেন্টারে তরুণীদের দিয়ে অনৈতিক ম্যাসেজ পার্লার ও দেহ ব্যবসা চালানোর ঘোরতর অভিযোগ রয়েছে। কিন্তু তাদের বিরুদ্ধে প্রকৃতভাবে কোনো পদক্ষেপ নিতে দেখা যায়নি। বরং অবৈধ লেনদেনের বিনিময়ে নির্বিঘ্নে অনৈতিক কর্মকাণ্ড চালিয়ে নিতে দেখা যাচ্ছে বছরের পর বছর।

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, আর্থিকভাবে সচ্চল পরিবারের কিছু উঠতি বয়সের কিশোর-যুবক থেকে শুরু করে সব বয়সি মানুষ এসব স্পা সেন্টারের সেবা গ্রহীতা। তাদের সেবা দেয়ার জন্য দরিদ্র পরিবারের গৃহবধূ থেকে শুরু করে স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া তরুণীদের ভাড়া করে আনা হয় এসব কথিত স্পা সেন্টারে। এর মধ্যে অনৈতিক কাজ চালানো সেন্টারগুলোর অধিকাংশ গড়ে উঠেছে বাণিজ্যিক এলাকার আবাসিক ভবনে। তবে সাম্প্রতিক রাজধানীর অভিজাত এলাকা গুলশান-২ গোল চত্বরের পাশে আবাসিক ভবনে অবৈধভাবে হাসান নামে এক প্রভাবশালীর গড়ে তোলা ‘অল দ্য বেস্ট’ নামে স্পা সেন্টারে অনৈতিক কর্মকাণ্ডের অভিযোগ উঠে। বিষয়টি ভবনের অন্য বাসিন্দা ও স্থানীয়রা টের পেয়ে বিভিন্ন সময়ে অপকর্ম বন্ধ করতে বললে উল্টো হুমকি দিতেন হাসান। এমনকি অনৈতিক কর্মকাণ্ড পরিচালনার জন্য ভবনের আশপাশে বখাটে-সন্ত্রাসীদেরও লালন-পালন করতেন তিনি। পরে ওই ভবনে ১১ জানুয়ারি অভিযান চালায় ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের (ডিএনসিসি) একটি টিম। তবে গুলশানের ওই স্পা সেন্টারে অভিযান চালানোর নেপথ্যে মাসোয়ারা নিয়ে বিরোধ বলে অভিযোগ উঠেছে। জানা যায়, স্পা বা রেস্ট হাউসগুলোয় সিটি করপোরেশন কোনোদিনই অভিযান পরিচালনা করেনি। এবারই প্রথম এ ধরনের অভিযানে যায় তারা। স্বাভাবিকভাবেই তাদের এ অভিযান নিয়ে সাধারণ মানুষের মধ্যে ব্যাপক প্রশ্নের জন্ম দিয়েছে।

সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, দীর্ঘদিন ধরেই গুলশান বনানী এলাকায় পরিচালিত স্পা সেন্টারগুলো থেকে মাসিক বড় অঙ্কের মাসোয়ারা যায় সব জায়গায়। এই মাসোয়ারা ডিএনসিসির একজন কর্মকর্তার কাছেও যায় বলে অভিযোগ রয়েছে। মাসোয়ারার টাকা সময়মতো না পাওয়ায় ওই স্পা সেন্টারে অভিযান চালানো হয়। আর ওই অভিযানের সময় নিজেদের সম্মান বাঁচাতে ৭তলা থেকে লাফিয়ে পড়ে মারা যান দুই তরুণী। ডিএনসিসির জনসংযোগ কর্মকর্তা মকবুল হোসাইন জানান, স্বাচ্ছন্দ্যে জনগণের চলাচল নিশ্চিত করতে ফুটপাথ দখলমুক্ত করার জন্য অভিযান পরিচালনা করা হচ্ছিল। সেই সঙ্গে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের ট্রেড লাইসেন্স খতিয়ে দেখা, আবাসিক এলাকায় বিনা অনুমতিতে কোনো ব্যবসা পরিচালনা করা হচ্ছে কি না তা দেখতেই অভিযানটি পরিচালিত হয়েছিল। আভিযানিক দলটি পৌঁছানোর সঙ্গে সঙ্গে ভবনের ভেতর থেকে দরজা বন্ধ করে দেয়া হয়। এমন সময় হঠাৎ ছাদ থেকে দুজন তরুণী পড়ে যান। তাৎক্ষণিক বিষয়টি দেখতে পেরে ওই দুই তরুণীকে হাসপাতালে পাঠানো হয়। ওই ঘটনায় দুটি মামলা করা হয়েছে বলে জানান গুলশান থানার ওসি বি এম ফরমান আলী। তিনি বলেন, স্পা সেন্টারে অভিযানের সময় সেখান থেকে লাফিয়ে পড়ে কর্মীর মৃত্যুর ঘটনায় অপমৃত্যুর মামলা করা হয়েছে। আর প্রতিষ্ঠানের মালিক হাসানুজ্জামান, তার স্ত্রী ও স্পা সেন্টারের ব্যবস্থাপক সাইনুর আক্তার (পায়েল) এবং ফ্ল্যাটের মালিক এটিএম মাহাবুবুল আলমের বিরুদ্ধে অনৈতিক কর্মকাণ্ড চালানোর অভিযোগে ডিএনসিসির পক্ষ থেকে আরেকটি মামলা করা হয়। মামলার বাদী হয়েছেন ডিএনসিসির প্রসিকিউশন কর্মকর্তা আবদুস সালাম। ওসি ফরমান আলী বলেন, লোকলজ্জার ভয়ে লাফিয়ে পড়ে ওই দুই তরুণী মারা গেছেন বলে পুলিশ প্রাথমিকভাবে জানতে পেরেছে। তিনি জানান, অভিযানের সময় স্পা সেন্টার থেকে ছয়জন নারী ও তিন যুবককে আটক করা হয়েছিল। মামলার বাকি আসামিদের গ্রেপ্তারের চেষ্টা চলছে। এদিকে খোঁজ নিয়ে আরও জানা যায়- গুলশান, বনানী, নিকেতন, উত্তরা ও মিরপুরে এমন অনৈতিক কর্মকাণ্ড চালানো শতাধিক স্পা সেন্টার রয়েছে। এরমধ্যে কয়েকটি ঘুরে দেখা যায়, বিভিন্ন রংয়ের আলোয় ঝলমল করছে স্পা সেন্টারগুলো। বাইরে থেকে ভেতরের পরিবেশ অনুমান করা কঠিন। ভেতরে গেলেই চোখে পড়বে ছিমছাম পরিপাটি সেলুন। অথচ এর মধ্যে চলছে অনৈতিক কর্মকাণ্ড। রয়েছে স্কুল-কলেজ ও ভার্সিটি পড়ুয়া তরুণীদের আনাগোনা। ভেতরে ছোট ছোট কেবিন করা হয়েছে। স্কুল-কলেজের উঠতি বয়সি ছেলেরাসহ যুব সমাজের একটি বড় অংশ এদের খদ্দের।

ফেসবুকে চলে চটকদার বিজ্ঞাপন : সূত্র জানায়, খদ্দের আকর্ষণ বাড়াতে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে প্রচারও চালাচ্ছে তারা। ঢাকা শহরে বেশ কিছু স্পা সেন্টার অশ্লীল বিজ্ঞাপন আর সুন্দরি তরুণীদের প্রলোভন দেখিয়ে ব্যবসা পরিচালনা করছে। অথচ তাদের কাছে নেই, কোনো বৈধ কাগজ কিংবা ট্রেড লাইসেন্স। সিটি করপোরেশনের কাছ থেকে হোটেল, বিউটি পার্লার, সেলুন আর ব্যায়ামাগারের ট্রেড লাইসেন্স নিয়ে চলছে এ ব্যবসা। অশ্লীলতার ইঙ্গিত দিয়ে বিজ্ঞাপন তৈরি করে তরুণ ও বয়স্ক পুরুষদের আকর্ষণ করা হয়। একটি স্পার বিজ্ঞাপনে স্পার সঙ্গে ‘কমপ্লিট ফান’র ব্যবস্থার কথা উল্লেখ করা হয়েছে। পোস্ট করা হয়েছে অশ্লীল ভিডিও।

এদিকে বেশ কয়েকবার স্পার নামে ব্ল্যাকমেইলের ঘটনা ঘটিয়েছে কয়েকটি স্পা সেন্টারে। ধনী ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে তারা হাতিয়ে নিয়েছে লাখ লাখ টাকা। এসব অভিযোগে এর আগেও গুলশান-বনানীতে একাধিক স্পা সেন্টারে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী বিভিন্ন সময় অভিযান চালায় এবং বন্ধও করে দেয়। পরে আবার সেগুলো চালুও হয়। এর মধ্যে উল্লেখ্যযোগ্য হলো- ম্যাঙ্গো স্পা, লাইভ স্টাইল হেল্থ ক্লাব অ্যান্ড স্পা সেলুন, রেডিডেন্স সেলুন-২ অ্যান্ড স্পা। মাঝে মধ্যে বিভিন্ন স্পা সেন্টারে অভিযান চালিয়ে শতাধিক নারী-পুরুষকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ। এর মেেধ্য ২০১৮ সালের অক্টোবরে গুলশান ও বনানী এলাকার ডব্লিউ বিউটি অ্যান্ড স্পা, মহাখালী ডিওএইচএসের ফনিক্স হেলথ কেয়ার, গুলশানের হোয়াইট বিউটি সেলুন অ্যান্ড স্পা সেন্টার এবং ডায়মন্ড বিউটি অ্যান্ড স্পায় অভিযান চালিয়ে ৪০ জনকে আটক করেছিল গোয়েন্দা পুলিশ (ডিবি)। তাদের বিরুদ্ধে তরুণীদের দিয়ে স্পা করানোর পর সে সময়ের ছবি ধারণ করে পরবর্তীতে ব্ল্যাকমেইলিংয়ের অভিযোগ ছিল। তবে পুলিশের দাবি, এসব স্পা সেন্টারে চলে মাদক সেবনও। বারবার অভিযান চালানো হলেও আইনি দুর্বলতার কারণে বন্ধ করা যাচ্ছে না এসব অপকর্ম। ডিএমপির গুলশান জোনে কর্মরত একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা বলেন, ভালো পরিবারের ছেলে যারা নিজেদের বাসায় মাদক সেবন করতে পারছে না, তারা এখানে আসছে। এসব জায়গা তারা বেছে নিয়েছে। প্রচলিত আইনানুসারে তাদের বিরুদ্ধে যে ব্যবস্থা নেয়া হয়, তা তাদের জন্য পর্যাপ্ত নয়। এক সপ্তাহ বা ১৫ দিন বা একমাস পর জামিনে মুক্ত হয়ে অন্যত্র যায় তারা।

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত