করোনা মহামারির ভয়াল থাবা কাটিয়ে দুই বছর পর মুসলিম বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম জমায়েত বিশ্ব ইজতেমার প্রথম পর্ব গতকাল আখেরি মোনাজাতের মধ্যদিয়ে শেষ হয়েছে। দুই পর্বের বিশ্ব ইজতেমা প্রথম পর্ব গত শুক্রবার শুরু হয়। দ্বিতীয় পর্ব শুরু হবে ২০ জানুয়ারি। প্রতি বছরের মতো এবারও বিশ্ব ইজতেমাকে কেন্দ্র করে মৌসুমি ব্যবসায়ীদের বেচাকেনা বেড়েছে। দেদারসে বিক্রি হয় কম্বল ও শীতের পোশাকসহ বিভিন্ন ধরনের পণ্যসামগ্রী। ইজতেমায় আগত মুসল্লিদের উপচেপড়া ভিড় ছিল দোকানগুলোয়। ইজতেমা ময়দানে জায়গা না হওয়ায় অনেকেই কম্বল ও পলিথিন কিনে তাঁবু টানিয়ে সড়ক-মহাসড়কের পাশে তিন দিনের প্রথম পর্বে আলেমদের বয়ান শুনে এবং জিকির করাসহ নামাজ পড়ে সময় কাটান। অল্প সময়ে অধিক বিক্রির সঙ্গে লাভের হিসাব ভারী হওয়ায় ব্যবসায়ীরা বলেছেন, সব মিলিয়ে শত কোটি টাকার কাছাকাছি বাণিজ্য হয়েছে। তারা বলেন, করোনার ধাক্কা কাটিয়ে সুদিন ফিরেছে এবারের ইজতেমা কেন্দ্রিক ব্যবসা-বাণিজ্যে। দুই পর্বে প্রায় ২০ থেকে ২৫ লাখ মুসল্লি সমবেত হয়ে থাকেন। ইজতেমাকে কেন্দ্র করে তুরাগ নদীর আশপাশে উত্তরা বেড়িবাঁধ, টঙ্গী, আব্দুল্লাপুর ও কামারপাড়া কাঁচাবাজারে বেচাকেনার হিড়িক পড়ে যায়। তবে এই বেচাকেনার সঠিক পরিমাণ নির্ণয় করা কঠিন হলেও ব্যবসায়ীরা আগামী কয়েক মাস স্বস্তিতে কাটাবেন।
ইজতেমার ময়দান ঘুরে দেখা গেছে, টঙ্গী-কামারপাড়া, উত্তরা বেড়িবাঁধ-আব্দুল্লাপুর ছাড়াও ইজতেমা ময়দানের চারপাশে কাপড়, আববাসপত্র, কাঁচাবাজার, কম্বল, পাঞ্জাবী, তসবিহ, টুপি, আতর ও চায়ের দোকানসহ বিভিন্ন ধরনের ব্যবসা গড়ে উঠে। এসব অস্থায়ী দোকানে বেচাকেনা ছিল জমজমাট। গরম পোশাক বিশেষ করে জ্যাকেট, কম্বল ও সুয়েটারের পাশাপাশি পাঞ্জাবী, টুপি, আঁতর, জায়নামাজ, রান্নার চুলা, চাল, ডাল, থালাবাসন, মাছ, মাংস, কাঁচাবাজার ও ফল বিক্রি ছিল চোখে পড়ার মতো। নক্শা ও কাপড় ভেদে জায়নামাজ ২০০ থেকে ১০ হাজার টাকায় বিক্রি হয়েছে। দেশীয় জায়নামাজের পাশাপাশি পাকিস্তান, ভারত, চীন, তুরস্ক ও সৌদি আরবের তৈরি জায়নামাজ মিলেছে দোকানগুলোয়। দৈনিক এক থেকে দেড় লাখ টাকা বিক্রি হয় ইলিশ মাছ। শীতের পিঠা ও খাবারের দোকান, পলিথিন শিট ও পাটির দোকানে ছিল মানুষের ভিড়।
১৯৬৭ সালে টঙ্গীর তুরাগ নদীর তীর সংলগ্ন ১৬০ একর জমির ওপর ‘বিশ্ব ইজতেমা’র যাত্রা শুরু হলেও ১৯৯৫ সালে জমির স্থায়ী বরাদ্দ দেয় সরকার। গাজীপুর সদর উপজেলার মাছিমপুর মৌজার ৯০ দশমিক ৮৮ একর ও টঙ্গী মৌজার ৬৯ দশমিক ১২ একর জমি নিয়ে ইজতেমা ময়দান। ময়দানের দক্ষিণ-পশ্চিমে তুরাগ নদ, উত্তরে টঙ্গী-আশুলিয়া বাইপাস সড়ক, পূর্বে ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়ক। লাখো মুসল্লির উপস্থিতিতে ২০১০ সাল থেকে বিশ্ব ইজতেমা দুই পর্বে সম্পন্ন হচ্ছে। বিশ্ব ইজতেমার প্রথম পর্বে দেশের বিভিন্ন জেলার মুসল্লি ছাড়াও দুই শতাধিক দেশ থেকে মুসল্লিরা এসেছেন। তারা বাংলাদেশে আসায় বিপুল পরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রার সংযোজন হয়েছে দেশের অর্থনীতিতে।
বিক্রেতারা বলেছেন, ইজতেমার পরের দিনও বেচাকেনা চলে। ইজতেমা শেষ হওয়ার পরের দিন অল্প দামে শীতের পোশাকসহ বিভিন্ন ধরনের পণ্য কিনতে আসেন স্থানীয়রা। গাইবান্ধা থেকে ইজতেমার ময়দানে এসেছেন চান মিয়া। তিনি বলেন, এর আগেও তিনবার ইজতেমায় এসেছিলেন। তখনো কম্বল কিনেছেন, এবারও তিনি কম্বল কিনেছেন। এই কম্বল তিনি গ্রামে নিয়ে যাবেন। নেত্রকোনা থেকে আসা মুসল্লি মাজহারুল হক ৫০০ টাকা দিয়ে আতর ও তসবিহ কিনেছেন। তিনি বলেন, নেত্রকোনায় এসব আতর ও তসবিহ পাওয়া যায় না। সেজন্য একটু বেশি দাম হলেও এসব কিনছি। মাজহারুলের মতো লাখো মুসল্লি ইজতেমায় এসে খাবার, শীতের কাপড় ও বিভিন্ন ধরনের পণ্য কিনেছেন।
ব্যবসায়ী লতিফুর রহমান বলেন, করোনা মহামারির কারণে গত ২ বছর কোনো ব্যবসা করতে পারিনি। এবার বিশ্ব ইজতেমার দুই পর্বের ৬ দিনে প্রায় দেড় মাসের বেচাকেনা হয়ে যাবে। মুসল্লিরা ইজতেমার আশেপাশ থেকেই খাবার সংগ্রহ করেন। পুরান ঢাকায় কম্বলের দোকানি জিহাদ চৌধুরী জানান, তিনি নিজ এলাকায় দৈনিক ৪০ থেকে ৫০ হাজার টাকার কম্বল বিক্রি করলেও ইজতেমায় দৈনিক প্রায় সাড়ে ৩ লাখ টাকার কম্বল বিক্রি করেছেন। তিনি বলেন, শীতে কম্বলের চাহিদা বেড়ে যাওয়ায় ইজতেমাস্থলে অস্থায়ী কম্বলের দোকান বসেছে। ইজতেমায় আসা অনেক মুসল্লি কম্বল কিনে গ্রামে নিয়ে যান। জিহাদ চৌধুরীর মতোই সজল মিয়ার টঙ্গী বাজারে কম্বলের দোকান থাকলেও ইজতেমার তিন নম্বর গেটের সামনে কম্বলের দোকান বসান। তিনি বলেন, বিশ্ব ইজতেমায় ছয় দিনে প্রায় ১২ লাখ টাকার কম্বল বিক্রির টার্গেট তার। দোকানের বেচাকেনায় বাড়তি লোকজন সহায়তা করছে। তিনি বলেন, তার মতো ময়দানের চারপাশে শতাধিক কম্বলের দোকান রয়েছে। এসব দোকানে ছয় দিনে অন্তত সাড়ে ৯ কোটি টাকার বেচাকেনা হবে।
ইজতেমা ময়দানের চারপাশে খোলা জায়গায় সারিবদ্ধভাবে বসেছে দোকানপাট। সেখানে মিলছে তসবিহ, জায়নামাজ, আতর, টুপি থেকে শুরু করে আছে শীত নিবারণের নানা কাপড়ও। ইজতেমার সময়ে এসব বিক্রি করে লাখ লাখ টাকা আয় করেন ব্যবসায়ীরা। তসবিহ, টুপি, আতর বিক্রেতা ওবায়দুল্লাহ বলেন, আমরা ইজতেমা শুরুর দুই দিন আগে থেকেই চলে এসেছি। অন্য বছর ইজতেমার দিন থেকে বেচাকেনা শুরু হলেও এ বছর দু’দিন আগে থেকেই জমে উঠে বেচাকেনা। তিনি বলেন, একদিন আগেই ইজতেমার মাঠ পরিপূর্ণ হয়। আশা করছি এবার ৫ থেকে ৬ লাখ টাকার বেচাকেনা হবে। নারায়ণগঞ্জ থেকে এসে পাঞ্জাবির কাপড় বিক্রি করেন মো. জুবায়ের আলী। তিনি বলেন, গত দুই বছর ইজতেমার আয়োজন করা হয়নি। এ বছর আমরা তিনদিন আগে থেকেই এসে অবস্থান নিয়েছি। ইজতেমা শুরুর আগ থেকেই বেচাকেনা বেড়েছে, এতে আমরা খুবই খুশি। দৈনিক বিক্রির পরিমাণ ৪০-৫০ হাজার টাকার মতো। বিক্রেতাদের পাশাপাশি কেনাকাটা করে খুশি ছিলেন ক্রেতারাও। তারা বলেন, ইজতেমায় এসে কম মূল্যে ভালো জিনিস কেনা যায়। অন্য দোকানগুলোয় সাধারণ জিনিসপত্রের যে দাম থাকে, ইজতেমা মাঠে সেটা অনেক কম দামে পাওয়া যায়।
জুবায়ের অনুসারীদের শীর্ষ পর্যায়ের মুরব্বি খন্দকার মেজবাহ উদ্দীন বলেন, করোনার কারণে গত দুই বছর বিশ্ব ইজতেমা অনুষ্ঠিত হয়নি, তাই এবার সবচেয়ে বেশি সাথি সমাগম হয়েছে। দেশ-বিদেশ থেকে কমপক্ষে কয়েক লাখ সাথি এসেছেন। তারা বাসে, ট্রাকে করে দলে দলে আসেন। লাখো মুসল্লির চাহিদা মেটাতে, সড়কের বাঁধ ও মাঠে বাঁশের খুঁটির ওপর চট লাগিয়ে ছাউনি দিয়ে শত শত অস্থায়ী দোকান বসে। তবে ইজতেমা ময়দানের প্রবেশমুখে বেচাকেনার চাপ ছিল বেশি।
বিশ্ব ইজতেমায় লাখ লাখ মুসল্লি সমাবেত হওয়ায় খাবার পানি থেকে শুরু করে অজুর পানির সংকট সৃষ্টি হয়। এই সুযোগে আব্দুল্লাপুর, টঙ্গী স্টেশন রোড ও কামারপাড়া রোডে শতশত মানুষ পানির ব্যবসা করেন। অজুর পানি ১০ থেকে ১৫ টাকায় কিনতে হয় মুসল্লিদের। আর এক লিটার পানির বোতল ৩৫ থেকে ৪০ টাকা দরে বিক্রি হয়। এছাড়া রাস্তায় নামাজ পড়তে ১০ থেকে ১৫ টাকায় পুরোনো খবরের কাগজ কিনতে হয়।
কামারপাড়া নতুন বাজার সংলগ্ন ১৫ বছর বয়সি সোবাহান মোল্লা দুই বালতি পানি নিয়ে ক্রেতার জন্য অপেক্ষা করার সময় জানান, বিশ্ব ইজতেমা ঘিরে লাখো মুসল্লি এসেছেন। বিভিন্ন সময়ে মুসল্লিদের পানির প্রয়োজন হয়, স্থানীয় অনেকেই পানি বিক্রি করছে, সেজন্য আমিও করছি। এতো মানুষ ফ্রি পানি কোথায় পাবে। পানি বিক্রির পাশাপাশি মোবাইল চার্জের ব্যবসাও ছিল জমজমাট। উত্তরবঙ্গের নীলফামারি থেকে বিশ্ব ইজতেমায় আসেন জাহিদ হাসান। দীর্ঘ পথ পেরিয়ে সন্ধ্যায় ময়দানে পৌঁছান, ততক্ষণে তার মোবাইল বন্ধ হয়ে গেছে। কিন্তু নিজ বাড়িতে যোগাযোগের তাগিদ থেকে তিনি খুঁজছিলেন মোবাইল চার্জ দেয়ার স্থান। এরপর চলে যান মাঠের পাশেই আহসান উল্লাহ জেনারেল হাসপাতাল সংলগ্ন অস্থায়ী সব দোকানের সামনে। আর সেখানেই খোঁজ মিলে যায় মোবাইল চার্জ দেয়ার অস্থায়ী এক দোকানের। ২০ টাকার বিনিময়ে মোবাইলে চার্জ দেন তিনি। অস্থায়ী এ দোকানটির স্বত্বাধিকারী ইমরান হোসেন বলেন, ইজতেমা উপলক্ষ্যে মুসল্লিদের মোবাইলে চার্জ দিতে দোকান দেয়া হয়েছে। মালিকপক্ষকে জায়গার ভাড়া দিতে হয়। এছাড়া আমার ১০০ পিস চার্জার রয়েছে। এই খরচের সঙ্গে অস্থায়ী ডেকোরেশনের খরচ হয়েছে। সব মিলে কিছুটা লাভের আশায় মুসল্লিদের মোবাইল চার্জ করে দিচ্ছি।