ঢাকা ২০ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ৫ আশ্বিন ১৪৩১ | বেটা ভার্সন

ইজতেমার প্রথম পর্বের আখেরি মোনাজাতে লাখো মুসল্লির ঢল

গন্তব্যে ফিরতে ভোগান্তি
ইজতেমার প্রথম পর্বের আখেরি মোনাজাতে লাখো মুসল্লির ঢল

বাংলাদেশসহ সারা বিশ্বের মুসলিম উম্মাহর শান্তি ও কল্যাণ কামনায় আখেরি মোনাজাতের মধ্য দিয়ে শেষ হলো ৫৬তম বিশ্ব ইজতেমার প্রথম পর্ব। টঙ্গীর তুরাগ তীরে তাবলিগ জামাত আয়োজিত বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহৎ এ সম্মিলনের আখেরি মোনজাতে অংশগ্রহণ করেন দেশ-বিদেশের লাখ লাখ ধর্মপ্রাণ মানুষ।

গতকাল রোববার সকাল ১০টায় শুরু হওয়া আখেরি মোনাজাত পরিচালনা করেন রাজধানীর কাকরাইল মারকাজের তাবলিগ জামাতের শূরা সদস্য মাওলানা মোহাম্মদ জোবায়ের। আরবি, উর্দু ও বাংলা মিলিয়ে তিনি ২০ মিনিটে মোনাজাত শেষ করেন। এ সময় ‘আমিন’ ধ্বনিতে মুখর হয়ে ওঠে তুরাগ এলাকা।

এদিকে আখেরি মোনাজাতকে ঘিরে ইজতেমা ময়দান ও আশপাশের এলাকায় কঠোর নিরাপত্তা ব্যবস্থা গ্রহণ করে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। যানজট এড়াতে এ সময় বিভিন্ন সড়কে যানবাহন চলাচলও বন্ধ রাখা হয়। তবে দূরদূরান্ত থেকে ব্যক্তিগত গাড়ি বা বিকল্প বাহনে, অনেকে আবার হেঁটেই ইজতেমা ময়দানে হাজির হন। মোনাজাত শেষে গন্তব্যে ফিরতেও তাদের চরম দুর্ভোগ পোহাতে হয়।

ইজতেমার প্রথম পর্বের আয়োজক কমিটির মিডিয়া সমন্বয়ক মুফতি জহির ইবনে মুসলিম জানান,

ইজতেমা ময়দানের বিদেশি নিবাসের পূর্বপাশে বিশেষভাবে তৈরি করা মোনাজাত মঞ্চ থেকে আখেরি মোনাজাত অনুষ্ঠিত হয়। মোনাজাতে প্রায় ৩০ লাখ মুসল্লি অংশ নেন। ভোর থেকেই আখেরি মোনাজাতে অংশ নিতে মুসল্লির ঢল নামে ইজতেমা ময়দানে। মুসল্লিদের সুবিধার্থে ইজতেমা ময়দানের আশপাশে ব্যাপক সংখ্যক মাইকের ব্যবস্থা রাখা হয়।

আখেরি মোনাজাতে আত্মশুদ্ধি ও নিজ নিজ গুনাহ মাফের পাশাপাশি দুনিয়ার সব বালা-মুসিবত থেকে হেফাজতে লাখ লাখ মুসল্লি আকুতি জানান। এ সময় ‘আমিন, আল্লাহুম্মা আমিন’ ধ্বনিতে আকাশ-বাতাস মুখরিত হয়ে ওঠে।

বিভিন্ন টেলিভিশন ও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে সরাসরি সম্প্রচার করা হয় এই মোনাজাত। দেশ-বিদেশের বিভিন্ন স্থান থেকে এই সম্প্রচারিত মোনাজাতেও অনেকে হাত তুলে শরিক হন।

ইজতেমা ময়দানে নারীদের বসার কোনো ব্যবস্থা ছিল না। তবে ময়দানের বাইরে খালি জায়গায়, কলকারখানা ও বসতবাড়ির ছাদসহ বিভিন্ন স্থানে অবস্থান নিয়ে আখেরি মোনাজাতে অংশ নেন বহু নারী।

এর আগে ইজতেমার শেষ দিনে ফজরের পর বয়ান করেন বাংলাদেশের মাওলানা রবিউল ইসলাম। আর ভারতের আব্দুর রহমান হেদায়তি বয়ান করেন। হেদায়তি বয়ানের পরপরই শুরু হয় আখেরি মোনাজাত।

বিশ্ব ইজতেমার আয়োজক কমিটির সদস্য প্রকৌশলী মাহফুজ জানান, আখেরি মোনাজাতে অংশ নিতে গত শনিবার রাত থেকেই টঙ্গীর তুরাগতীর অভিমুখে মানুষের ঢল নামে। গতকাল সকাল ৯টার দিকে ইজতেমা ময়দানের আশপাশের এলাকা জনসমুদ্রে পরিণত হয়। শীত, ধুলাবালি উপেক্ষা করে ৫ থেকে ৬ কিলোমিটার দূরে বাস, ট্রাক, মাইক্রোবাস, প্রাইভেট কারসহ অন্যান্য যানবাহন রেখে মুসল্লিরা ছুটে যান ইজতেমা ময়দানের দিকে।

মাত্র কয়েক ঘণ্টার মধ্যে বিমানবন্দর থেকে বোর্ডবাজার, গাজীপুর, টঙ্গী, আশুলিয়াসহ বিভিন্ন সড়ক মুসল্লির সমাবেশে একাকার হয়ে যায়। যেদিকেই চোখ যায় শুধু পাঞ্জাবি-টুপি পরা মানুষ। ইজতেমা ময়দান ছাড়াও আশপাশের মহাসড়ক, অলিগলি, বাড়িঘরের ছাদ পর্যন্ত ছেয়ে যান মুসল্লিরা। অনেকে ইজতেমার মূল ময়দানে ঢুকতে না পেরে পত্রিকা, পাটি, জায়নামাজ, পলিথিন বিছিয়ে রাস্তায় বসে পড়েন। অনেকেই আবার মোবাইল ফোনে দূরদূরান্ত থেকে মোনাজাতে অংশ নেন। এছাড়া টঙ্গী শহীদ আহসান উল্লাহ মাস্টার জেনারেল হাসপাতাল চত্বরে অবস্থান নেন শতাধিক নারী।

আয়োজক কমিটির সদস্যরা জানান, ভারত, চীন, সৌদি আরব, পাকিস্তান, ফিলিপাইন, যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, কাতার, ইন্দোনেশিয়া, মালয়েশিয়াসহ বিভিন্ন দেশ থেকে মুসল্লিরা এবারের বিশ্ব ইজতেমায় অংশ নিয়েছেন।

আখেরি মোনাজাতে নিরাপত্তার বিষয়ে গাজীপুর মহানগর পুলিশ (জিএমপি) কমিশনার মোল্ল্যা নজরুল ইসলাম জানান, সাদা পোশাকে মুসল্লির বেশে পুলিশ মোতায়েনসহ ১০ হাজার সদস্য ইজতেমা ময়দান ও আশপাশের এলাকায় নিয়োজত ছিলেন। তারা আখেরি মোনাজাতের পর মুসল্লিদের বাড়ি ফেরা পর্যন্ত ছিলেন। খুব দ্রুত ও নিরাপদে মুসল্লিরা যেন ময়দান ত্যাগ করতে পারেন, সেজন্য বাস-ট্রেনসহ সব ধরনের যানবাহনের ব্যবস্থা রয়েছে।

এদিকে করোনা মহামারির সময় পেরিয়ে আবারও সমবেত হতে পারায় মহান সৃষ্টিকর্তার কাছে কৃতজ্ঞতা জানান মুসল্লিরা। গত শুক্রবার আম বয়ানের মধ্য দিয়ে এবারের বিশ্ব ইজতেমার প্রথম পর্ব শুরু হয়। এই পর্বে অংশ নেন মাওলানা মোহাম্মদ জোবায়েরের অনুসারীরা। এর বাইরে শুধু আখেরি মোনাজাতে শরিক হন সাধারণ ধর্মপ্রাণ মানুষ। প্রথম পর্বের এ ইজতেমায় বিভিন্ন অসুস্থতার কারণে ৮ জন মুসল্লির মৃত্যু হয়েছে বলে জানা গেছে।

আগামী ২০ থেকে ২২ জানুয়ারি হবে ইজতেমার দ্বিতীয় পর্ব। তাতে অংশ নেবেন দিল্লির মাওলানা সা’দ কান্ধলভীর অনুসারীরা।

বিদেশ থেকে আসা অতিথিরা প্রথম পর্ব শেষে ইজতেমাস্থল ত্যাগ করে হাজী ক্যাম্পে অবস্থান করবেন। সেখান থেকে তারা নিজ নিজ গন্তব্যে যাবেন। আর দ্বিতীয় পর্বের বিদেশি মেহমান যারা আসবেন তারা ইজতেমা মাঠেই অবস্থান করবেন এবং ইজতেমা শেষে তারা যার যার গন্তব্যে চলে যাবেন।

আখেরি মোনাজাত শেষে বাড়ি ফিরতে ভোগান্তি: আখেরি মোনাজাত শেষে ইজতেমায় আগতরা টঙ্গীর মাঠ ও এর আশপাশের এলাকা থেকে নিজ নিজ গন্তব্যে রওনা হন। বাস, মিনি ট্রাক, ঠেলা গাড়িতে করে ঢাকায় ফেরেন মানুষ। ট্রেনগুলোতেও ছিল উপচেপড়া ভিড়। ঝুঁকি নিয়ে ট্রেনের ছাদে উঠে অনেকে গন্তব্যে ফেরেন।

মোনাজাতের শুরুতে মানুষ দলে দলে ইজতেমা মাঠের উদ্দেশে রওনা হয়েছিলেন; মোনাজাত শেষ হওয়ার পর সবাই একসঙ্গে ফিরতে শুরু করায় যানবাহনের সংকটে পদে পদে ভোগান্তিতে পড়তে হয় তাদের।

গতকাল সকাল সাড়ে ১০টার দিকে প্রথম পর্বের আখেরি মোনাজাত শেষ হওয়ার পরপরই ঢাকার বিমানবন্দর ও গাজীপুরের বিভিন্ন সড়কে ইজতেমাফেরত হাজার হাজার মানুষের ঢল নামে। ইজতেমা মাঠ থেকে ঢাকায় ফেরার সরাসরি কোনো গণপরিবহণ ছিল না। উপায় না দেখে অনেকে হেঁটেই রওনা হন; কেউ কেউ আবার কয়েকগুণ বেশি টাকা দিয়ে প্রাইভেট কার, সিএনজিচালিত অটোরিকশা, ভ্যান, মোটরসাইকেল ও পিকআপ ভ্যান ভাড়া করেন।

যারা ইজতেমা মাঠে না যেতে পেরে স্টেশন রোড, টঙ্গীর হোসেন মার্কেট, উত্তরা কিংবা বিমানবন্দরের বিভিন্ন এলাকায় থেকে মোনাজাতে অংশ নিয়েছিলেন, তারাও একই সময় ফেরা শুরু করেন। ফলে আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর থেকে বনানীমুখী সড়ক জনস্রোতে পরিণত হয়; তাদের বেশিরভাগই হেঁটে ফিরছিলেন। পাশাপাশি বাস, মিনি ট্রাক, ট্রেন, ঠেলা গাড়িতে করে ঢাকায় আসেন।

গাজীপুরের পূবাইল এলাকার নওজেশ আলী বলেন, আখেরি মোনাজাতের শুরুতে মানুষ দলে দলে ইজতেমা মাঠের উদ্দেশে রওনা হয়েছিলেন। কিন্তু মোনাজাত শেষ হওয়ার পর সবাই একসঙ্গে ফিরেন বলে যানবাহনের সংকট দেখা দেয়। ফলে গুণতে হচ্ছে বেশি ভাড়া।

আব্দুল্লাহপুর থেকে পিকআপ ভ্যানে করে আখেরি মোনাজাত শেষে বিমানবন্দর আসেন সানোয়ার হোসেন। তিনি বলেন, মোনাজাত শুরুর আগে বিমানবন্দর থেকে ১৫০ টাকায় পিকআপভ্যানে করে আব্দুল্লাহপুর গিয়েছিলাম। এখন ফিরতি পথে ২০০ টাকা দিয়ে আসতে হয়েছে। একসঙ্গে অনেক মানুষ রওনা হওয়ায় অল্প সময়ের ব্যবধানে ৫০ টাকা ভাড়া বেড়ে যায়।

মোটরসাইকেল রাইড শেয়ারিং সেবা নিয়ে ইজতেমা মাঠ থেকে উত্তর বাড্ডায় আসেন সোলায়মান মিয়া। তিনি জানান, উত্তরা যেতে তার খরচ হয়েছিল ২০০ টাকা; এখন ৪০০ টাকা দিয়ে ফিরতে হচ্ছে। যাত্রী বেশি দেখে চালকরা ভাড়াও বেশি চাইছেন।

অন্যদিকে ঢাকার তেজগাঁওয়ের পথে হেঁটেই রওনা হয়েছেন কামাল হোসেন। তিনি বলেন, ইজতেমা মাঠে যাওয়ার সময় বাস-অটোরিকশা দিয়ে গেলেও এখন কোনো গাড়িই পাচ্ছি না। এখন হেঁটে খিলক্ষেত যাব, সেখান থেকে কুড়িল গিয়ে বাসে রওনা হবো। নাহলে হেঁটেই বাসায় ফিরব।

এদিকে আখেরি মোনাজাত শেষে গন্তব্যে ফেরা মানুষের ভিড়ের কারণে টঙ্গীর কামারপাড়া সড়ক, ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়ক, টঙ্গী-কালীগঞ্জ সড়কের আহসান উল্লাহ মাস্টার উড়াল সেতু ও আশপাশের সড়ক-মহাসড়ক এবং সংযোগ সড়কগুলোতে দীর্ঘ জনজট ও যানজট দেখা দেয়।

এর আগে মুসল্লিদের মোনাজাতে অংশ নেয়া নির্বিঘœ করতে ইজতেমা ময়দানের উত্তরে গাজীপুরের চান্দনা চৌরাস্তা, দক্ষিণে বিমানবন্দর থেকে টঙ্গীমুখী ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়কে সব ধরনের যানবাহন বন্ধ করে দেয় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। এছাড়া শাখা সড়কগুলো থেকেও কোনো গাড়ি প্রধান সড়কে ঢুকতে দেয়া হয়নি।

এদিকে ইজতেমায় আগত মুসল্লিদের নিরাপত্তার পাশাপাশি নানা সেবামূলক কর্মকাণ্ডে নিয়োজিত ছিল আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। এছাড়া বিভিন্ন সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠান ও স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনের পক্ষ থেকে চিকিৎসা সেবা, খাদ্য ও পানীয় সরবরাহসহ নানা সহযোগিতার খবর পাওয়া গেছে।

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত