রাজধানীর অধিকাংশ মানি এক্সচেঞ্জ প্রতিষ্ঠানই অবৈধ

* সিআইডির অভিযানে ১৪ জন গ্রেপ্তার * স্বল্প পুঁজিতে বেশি আয়, ফোনে ফোনে ব্যবসা

প্রকাশ : ১৯ জানুয়ারি ২০২৩, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ

  এএইচএম ফারুক

অল্প সময়ে স্বল্প পুঁজিতে বেশি আয়ের আশায় রাজধানীতে গড়ে উঠছে মানি এক্সচেঞ্জ প্রতিষ্ঠান। এর অধিকাংশই অবৈধ এবং নন ব্যাংকিং চ্যানেলে লেনদেন পরিচালনা করার অভিযোগ পাওয়া গেছে। প্রতিষ্ঠানগুলো মূলত ফোনে ফোনে চালাচ্ছে এ অবৈধ মানি এক্সচেঞ্জ ব্যবসা।

সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, দিন দিন দেশে ডলারের দাম বাড়তে থাকায় বাড়ছে নামসর্বস্ব এসব মানি এক্সচেঞ্জ প্রতিষ্ঠান।

অর্থনৈতিক অপরাধ বিষয়ে কাজ করে পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি)। সংস্থাটির পক্ষ থেকে জানা গেছে, বর্তমানে রাজধানীতে হাজারেরও বেশি প্রতিষ্ঠান মানি এক্সচেঞ্জ নাম দিয়ে ব্যবসা চালাচ্ছে। কিন্তু বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্যমতে, বৈধ মানি এক্সচেঞ্জ প্রতিষ্ঠান রয়েছে মাত্র ২৩৫টি।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, অবৈধ এসব ব্যবসার কৌশলও ভিন্ন। তারা কর্মী নিয়োগ দিয়ে প্রশিক্ষিত করে তাদের ব্যাগে ডলার দিয়ে কাঙ্ক্ষিত ব্যক্তির খোঁজে নামিয়ে দিচ্ছে। এমনকি কোনো ব্যক্তির ডলার লাগলে তারা ফোনেও অর্ডার করছে। এরপর তা পৌঁছে দেয়া হচ্ছে সেই ব্যক্তির কাছে। এসব প্রতিষ্ঠানের নেই কোনো ধরনের বৈধতা। অনুমতি ছাড়াই অবৈধভাবে ব্যবসা করছে তারা।

এ বিষয়ে অনুসন্ধানে নেমে রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় অভিযান চালিয়ে তিনটি অবৈধ মানি এক্সচেঞ্জ ব্যবসা পরিচালনাকারী প্রতিষ্ঠানের ১৪ জনকে গ্র্রেপ্তার করে সিআইডি। পরে তাদের জিজ্ঞাসাবাদে বেরিয়ে আসে এসব চাঞ্চল্যকর তথ্য।

গতকাল দুপুরে রাজধানীর মালিবাগে সিআইডির প্রধান কার্যালয়ে এক সংবাদ সম্মেলনে সিআইডির প্রধান অতিরিক্ত আইজিপি মোহাম্মদ আলী মিয়া এসব চাঞ্চল্যকর তথ্য জানান।

তিনি বলেন- গত মঙ্গলবার রাতে রাজধানীর পাঁচটি স্থানে একযোগে অভিযান চালায় সিআইডি। সেখান থেকে তিনটি অবৈধ মানি এক্সচেঞ্জ ব্যবসা পরিচালনাকারী প্রতিষ্ঠানের ১৪ জনকে গ্র্রেপ্তার করে সিআইডি। এ সময় তাদের কাছ থেকে এক কোটি ১১ লাখ ১৯ হাজার ৮২৬ টাকা সমমূল্যের ১৯টি দেশের বৈদেশিক মুদ্রাসহ সর্বমোট এক কোটি ৯৯ লাখ ৬১ হাজার ৩৭৬ টাকা জব্দ করা হয়। তাদের জিজ্ঞাসাবাদের বরাত দিয়ে সিআইডির প্রধান বলেন- স্বল্প সময়ে অল্প পুঁজিতে বেশি আয়ের আশায় অবৈধ মানি এক্সচেঞ্জগুলো গড়ে উঠছে।

অতিরিক্ত আইজিপি মোহাম্মদ আলী মিয়া আরও বলেন, এই মানি এক্সচেঞ্জ প্রতিষ্ঠানগুলো ছিল অবৈধ। অভিযানে অবৈধ পাঁচটি মানি এক্সচেঞ্জের মধ্যে তিনটির অফিস থাকলেও বাকি দুটির স্থায়ী কোনো অফিসও নেই। তারা প্রতারণামূলক বা ফেরারি। তিনটি অবৈধ মানি এক্সচেঞ্জ অফিস হচ্ছে- গুলশানের জেএমসিএইচ প্রাইভেট লিমিটেড, মোহাম্মদপুরের টোকিও স্কয়ারের আলম অ্যান্ড ব্রাদার্স এবং উত্তরার আশকোনা মুক্তিযোদ্ধা মার্কেটের তৈমুর মানি এক্সচেঞ্জ। বাকি দুটি ফেরারি প্রতিষ্ঠান। এর বাইরে আরও হাজারের বেশি মানি এক্সচেঞ্জ প্রতিষ্ঠান রয়েছে। অবৈধভাবে মানি এক্সচেঞ্জ গজিয়ে উঠার সংখ্যা বাড়ছে।

এখানে ব্যাংকগুলোর কোনো গাফিলতি রয়েছে কি না এমন প্রশ্নের জবাবে মোহাম্মাদ আলী মিয়া বলেন, এ বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংক কাজ করছে। তবে আমাদের দেশের স্বার্থে কষ্ট করতে হবে। দেশের সচেতন নাগরিক হিসেবে আমার মতে, কোনে অবৈধ পথ বেছে নেওয়া উচিত নয়। বাংলাদেশ ব্যাংক বা অন্য যেকোনো ব্যাংকের কোনো কর্মকর্তার বিরুদ্ধে যদি হুন্ডি কিংবা অবৈধ মানি এক্সচেঞ্জের সঙ্গে জড়ানোর তথ্য মেলে তবে কাউকে ছাড় দেয়া হবে না।

ফোনে ফোনে যোগাযোগ করলেই যদি একজন টাকা বা বিদেশি মুদ্রা বা ডলার পেয়ে যায়, তাহলে সে কেন ব্যাংকে যাবে? যদিও প্রক্রিয়াটা অবৈধ। এই ক্ষেত্রে ব্যাংকের সেবার যে মান সেটা নিয়ে প্রশ্ন আছে। সেই সেবা বাড়ানোর কোনো তাগিদ আপনারা দিচ্ছেন কি না? এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, যারা প্রবাসী তারা দেশে টাকা পাঠানোর ক্ষেত্রে বাসায় বসেই টাকা পাঠায়। এক্ষেত্রে সময় বাঁচে ও কোনো প্রকার হয়রানির শিকার হতে হয় না। দেশের মানুষ ঘরে বসে টাকা পেয়ে যায়। তবে এটা অবৈধ।

কেন অবৈধভাবে মানি এক্সচেঞ্জ বাড়ছে, এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, খুব অল্প সময়ে লাভবান হওয়া যায় তাই অবৈধ মানি এক্সচেঞ্জ বাড়ছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের সোর্স ও সিআইডির সোর্সের মাধ্যমে আমরা অবৈধ মানি এক্সচেঞ্জের বিরুদ্ধে অভিযান চালাচ্ছি। মানিলন্ডারিংয়ের ক্ষেত্রে শুধু সিআইডি নয়, সব এজেন্সি মিলেই কাজ করতে হবে। এ বিষয়ে আলাদা আইন আছে। সে অনুসারে কাজ করা হচ্ছে। অবৈধ মানি লন্ডারিংয়ের বিরুদ্ধে অভিযান অব্যাহত থাকবে।

সিআইডি সূত্রে জানা গেছে, মঙ্গলবার গ্র্রেপ্তার ব্যক্তিরা হলেন- আবু তালহা ওরফে তাহারত ইসলাম তোহা, আছাদুল শেখ, হাছান মোল্যা, আব্দুল কুদ্দুস, হাসনাত এ চৌধুরী, শামসুল হুদা চৌধুরী ওরফে রিপন, সুমন মিয়া, তপন কুমার দাস, আব্দুল কুদ্দুস, কামরুজ্জামান রাসেল, মনিরুজ্জামান, নেওয়াজ বিশ্বাস, আবুল হাসনাত ও শাহজাহান সরকার। রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় নিজস্ব অফিস এবং ভাসমান যোগাযোগের মাধ্যমে বাংলাদেশ ব্যাংকের অনুমতি (লাইসেন্স) ছাড়া বৈদেশিক মুদ্রা ক্রয়-বিক্রয় করে আসছিল তারা। গ্র্রেপ্তার ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে বিশেষ ক্ষমতা আইন, ১৯৭৪ অনুযায়ী মামলা দায়েরের বিষয় প্রক্রিয়াধীন বলে জানান সিআইডি প্রধান।

সিআইডি প্রধান বলেন, প্রতিটি প্রতিষ্ঠান প্রতিদিন গড়ে প্রায় ৭০ থেকে ৭৫ লাখ টাকা সমমূল্যের বিদেশি মুদ্রা অবৈধভাবে ক্রয়-বিক্রয় করে আসছিল। মাসে ২২ বা ২৪ কর্মদিবসে আরও কী পরিমাণ তারা ক্রয়বিক্রয় করেছে এর ধারণা করা যায়। সারা দেশে আরও এক হাজারের বেশি অবৈধ মানি এক্সচেঞ্জ প্রতিষ্ঠান রয়েছে।

মোহাম্মদ আলী মিয়া বলেন, অভিযানের কারণে অনেক অবৈধ প্রতিষ্ঠান অফিস গুটিয়ে ব্যাগ নিয়ে ঘুরে ঘুরে ফোনে ফোনে যোগাযোগ করে ব্যবসা করছে। যার যেখানে যে পরিমাণ বিদেশি মুদ্রা দরকার সেখানে পৌঁছে দিচ্ছে। বিনিময়ে ডলার বা অন্য বিদেশি মুদ্রার ন্যায্যমূল্যের তুলনায় বেশি টাকা নিচ্ছে।

অতিরিক্ত আইজিপি বলেন, বিদেশে যাওয়ার অনুমতি পাওয়ার ভিসা পাবার পর বাংলাদেশের যেকোনো ব্যাংকে ভিসা দেখালে বিদেশি মুদ্রা পাবেন এবং সংশ্লিষ্ট ব্যাংক তা দিতে বাধ্য। তাহলে কেন তারা অবৈধভাবে ১০০ টাকার ডলার ১১৫ বা ১২০ টাকায় কিনবেন! এটা অন্যায় ও অবৈধ। আমরা এই অবৈধ কাজকে উৎসাহিত করতে পারি না। লাগবেই যখন তখন বৈধভাবে নেব, ব্যাংক কিংবা বৈধ মানি এক্সচেঞ্জ প্রতিষ্ঠান থেকে নেব। তাহলে ফুলে-ফেঁপে উঠা এসব অবৈধ মানি এক্সচেঞ্জ প্রতিষ্ঠান অটোমেটিক্যালি বন্ধ হয়ে যাবে।