ঢাকা ২০ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ৫ আশ্বিন ১৪৩১ | বেটা ভার্সন

শীত শেষ হতে না হতেই লোডশেডিংয়ের ভোগান্তি

শীত শেষ হতে না হতেই লোডশেডিংয়ের ভোগান্তি

জ্বালানি তেল ও কয়লা সংকটের মধ্যে শীত শেষ হতে না হতেই লোডশেডিং শুরু হয়ে গেছে রাজধানীসহ সারা দেশে। ডলারের ঘাটতি ও জ্বালানি আমদানিতে সরকারি-বেসরকারি বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্রগুলো চাপের মধ্যে রয়েছে। বাধ্য হয়ে অনেক কেন্দ্র বন্ধ ও বিদ্যুতের সরবরাহ লাইন সংস্কার না করায় এ সমস্যা হচ্ছে। বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের (পিডিবি) কর্মকর্তারা বলছেন, উৎপাদন ব্যয় কমাতে জ্বালানি তেলচালিত বেশিরভাগ বিদ্যুৎকেন্দ্র বন্ধ রাখা হয়েছে। এর মধ্যেই কয়লা ও গ্যাসচালিত তিনটি বিদ্যুৎকেন্দ্র থেকে উৎপাদন ব্যাপক হারে কমে যাওয়ায় সরবরাহ ঘাটতি তৈরি হয়েছে।

বিদ্যুৎ বিভাগের তথ্য বলছে, দেশে বিদ্যুৎ উৎপাদনের সক্ষমতা ২২ হাজার মেগাওয়াটের বেশি। গ্রীষ্মে সর্বোচ্চ ১৪ হাজার ৭৮২ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন করা হয়েছিল। গড়ে ওই সময় ১২ থেকে ১৪ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুতের চাহিদা থাকে। এখন শীতের সময় বিদ্যুতের চাহিদা কমে দাঁড়িয়েছে ৯ থেকে ৭ হাজার মেগাওয়াটে। অথচ এটা সরবরাহ করা যাচ্ছে না।

বিদ্যুৎ বিভাগের দেয়া তথ্য অনুযায়ী, জ্বালানির ঘাটতি থাকায় বিদ্যুৎ উৎপাদন ও সরবরাহে কিছুটা সমস্যা রয়েছে। তবে নতুন নতুন বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোর উৎপাদিত বিদ্যুৎ জাতীয় গ্রিডে যুক্ত হলে এই সমস্যা দূর হবে।

সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের সূত্রে জানা গেছে , গ্রাহকের প্রয়োজন মেটাতে সরকারি বিদ্যুৎ কেন্দ্রের পাশাপাশি বেসরকারি ভাড়াভিত্তিক বিদ্যুৎ উৎপাদনকেন্দ্রের (রেন্টাল) মাধ্যমে বিদ্যুৎ সরবরাহ করা হচ্ছে। রামপুরার কয়েকজন ব্যবসায়ী বলেন, কয়েক দিন ধরে দিনের একটা থেকে দেড় ঘণ্টা বিদ্যুৎ থাকে না। রাতেও বারবার লোডশেডিং হচ্ছে। শনির আখড়ার বাসিন্দা হারুনুর রশিদ বলেন, ঘন ঘন লোডশেডিংয়ে শিক্ষার্থীদের অবস্থা খারাপ। কিছুটা গরম আসতে না আসতেই দুর্ভোগ চরমে উঠেছে।

কামারপাড়ার বাসিন্দা মশিউর রহমান ও কামরুল ইসলাম বলেন, বিদ্যুৎ না থাকায় পানি আসছে না ওয়াসার লাইনে। এছাড়া রোগীদের নানা অসুবিধা হচ্ছে।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে বিদ্যুৎ বিভাগের কয়েকজন প্রকৌশলী বলেন, চাহিদার তুলনায় বিদ্যুতের উৎপাদন বেশি, বিদ্যুৎ-সংকট হওয়ার কথা নয়। তারপরও গত এক বছর ধরে গ্রাহকরা সংকটের মধ্যে রয়েছেন। গ্রাহকরা রেফ্রিজারেটর, টেলিভিশন চালানোর পাশাপাশি বিপুল পরিমাণ অটোরিকশার ব্যাটারি চার্জ করতে বিদ্যুৎ ব্যবহার করছেন। এতে ট্রান্সমিটারে বিদ্যুতের লোড বাড়ছে। বিদ্যুৎ লাইনের ক্যাবল (তার) অনেক আগের। চাহিদা বেড়ে যাওয়ায় তারগুলো পুড়ে নষ্ট হয়ে যাচ্ছে।

গাইবান্ধার বাসিন্দা আরিফুর রহমান বলেন, পল্লী বিদ্যুৎ সমিতি পুরোনো সরবরাহ লাইন ও ফিডারে বিদ্যুৎ বিতরণ করছে। এগুলো সংস্কার না করে গ্রাহক বাড়াচ্ছে। তাই পর্যাপ্ত বিদ্যুৎ থাকার পরও লোকজনকে দুর্ভোগ পোহাতে হচ্ছে।

পাওয়ার সেলের মহাপরিচালক প্রকৌশলী মোহাম্মদ হোসাইন আলোকিত বাংলাদেশকে বলেন, এখনো বিশ্বে জ্বালানির বাজারে অস্থিরতা কমেনি। ডলারের দর বৃদ্ধিতে ফিরে এসেছে বিদ্যুতের লোডশেডিং। তবে মার্চ নাগাদ পরিস্থিতির উন্নতি হবে।

বিদ্যুতের দাম বাড়ানো প্রসঙ্গে তিনি বলেন, বিদ্যুৎ উৎপাদনের মূল কাঁচামাল গ্যাস, তেল ও কয়লা। সবাই জানে, বিশ্ববাজারে এসব জ্বালানির দাম অস্বাভাবিক হারে বেড়েছে এবং সেই আলোকে জ্বালানি ও খনিজসম্পদ বিভাগ ইতোমধ্যে গ্যাসের মূল্য বাড়িয়েছে। কাঁচামালের মূল্য বাড়লে ফিনিশড প্রোডাক্টের মূল্য তো বাড়বেই। গ্যাস দিয়ে বিদ্যুৎ উপাদন করা হয়, গ্যাসের দাম বেড়ে যাওয়ায় সেই অনুপাতে বিদ্যুতের দাম বাড়ে। এ ছাড়া বিশ্ববাজারে গ্যাসের দাম বেড়ে যাওয়ায় তেল দিয়ে বিদ্যুৎ উৎপাদন করতে হচ্ছে। বিশ্ববাজারে কয়লার দামও বেড়েছে। সব মিলিয়ে বিদ্যুৎ উৎপাদন ব্যয় গত ২ বছরের তুলনায় অনেক বেড়েছে। গত কয়েকদিনের ব্যবধানে বিদ্যুতের লোডশেডিং কোথাও কোথাও প্রায় দ্বিগুণ হয়েছে। দিনের পাশাপাশি রাতেও কাটাতে হচ্ছে বিদ্যুৎহীন অবস্থায়। রাজধানীতে পানি সংকটেও ভুগতে হচ্ছে অনেককে। দেশে এখন দিনে বিদ্যুতের চাহিদা রয়েছে ১২ হাজার মেগাওয়াটের মতো, সেখানে উৎপাদন হচ্ছে ৯ হাজার থেকে সর্বোচ্চ সাড়ে ৯ হাজার মেগাওয়াট। চাহিদার তুলনায় আড়াই থেকে তিন হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুতের ঘাটতি থাকায় লোডশেডিং বেড়েছে।

সরকারি কর্মকর্তারা লোডশেডিং বাড়ার জন্য জ্বালানি সংকটের পুরোনো কারণগুলোর সঙ্গে সাম্প্রতিক জাতীয় গ্রিড বিপর্যয়কেও কারণ দেখাচ্ছেন। জ্বালানি সংকটে জানুয়ারিতে সরকার সূচি অনুযায়ী লোডশেডিংয়ের যে পরিকল্পনা দিয়েছিল, উৎপাদন কম হওয়ায় শুরু থেকেই তা ভেস্তে যায়।

শীতের মধ্যেও দৈনিক ঘণ্টা খানিক বিদ্যুৎহীন অবস্থায় পার করতে হচ্ছে মানুষকে। ঢাকার বাইরের পরিস্থিতি আরও নাজুক। রাজধানীর বিভিন্ন এলাকার বাসিন্দারা বলছেন, দিনের পাশাপাশি এখন মধ্যরাতেও কয়েক দফায় লোডশেডিং হচ্ছে।

মিরপুর, মোহাম্মদপুর, কল্যাণপুর, শ্যামলী, আজিমপুর, মগবাজার, মালিবাগ, রামপুরা, বাসাবো, গোড়ান এলাকায় বিদ্যুৎ না থাকার তথ্য পাওয়া গেছে। বিদ্যুৎ কর্মকর্তারা বলছেন, যখন প্রচুর বিদ্যুতের প্রয়োজন, তখন বেশ কয়েকটি কারণ মিলে সংকট তীব্র হয়েছে। তাদের ভাষ্য, বেশ কয়েকটি বিদ্যুৎকেন্দ্রের অনেকগুলো ইউনিট কারিগরি কারণে বন্ধ আছে। বিদ্যুৎ কেন্দ্রে গ্যাস সরবরাহ আরও কমেছে। এছাড়া বেশ কিছু বেসরকারি বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্র পূর্ণ উৎপাদনে যেতে পারছে না। আন্তর্জাতিক বাজারে ডিজেলের দাম বেড়ে যাওয়ার পাশাপাশি বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলোর ৪-৫ মাসের বিল বকেয়া রয়েছে, সে কারণে তারা উৎপাদন কমিয়ে দিয়েছে বলে জানা গেছে। ডেসকোর এমডি কাউসার আমির আলীও বলেন, আমরা যতটুকু বরাদ্দ পাচ্ছি, সে অনুযায়ী বিতরণ করছি। পিডিবি আমাদের যা দিচ্ছে, আমরা তাই দিচ্ছি কিন্তু চাহিদা আরও বেশি।

ভোক্তা অধিকার সংগঠন কনজ্যুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) সিনিয়র ভাইস প্রেসিডেন্ট এম শামসুল আলম বলেন, সরকার ভর্তুকি কমাতে বিদ্যুতের দাম বাড়িয়েছে তাহলে নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ সরবরাহের নিশ্চয়তা দিতে হবে। সেটি দিতে পারছে না। প্রাথমিক জ্বালানির অভাব ও বিদ্যুৎকেন্দ্রের বিল বকেয়া থাকার অজুহাতে লোডশেডিং দেয়া হয়।

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত