বিশ্ব ইজতেমার দ্বিতীয় পর্ব শুরু আজ

তাবলিগের দুই গ্রুপের দ্বন্দ্বে দেশ-বিদেশে ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন

* ভারতের মুরব্বি সা’দ কান্ধলভীর পক্ষে-বিপক্ষে অনড় দুইপক্ষ * কাকরাইল মসজিদ মারকাজ ব্যবহার হচ্ছে সপ্তাহ ভাগ করে

প্রকাশ : ২০ জানুয়ারি ২০২৩, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ

  রকীবুল হক

তাবলিগ জামাতের দুই গ্রুপের দ্বন্দ্বের কারণে তৃতীয়বারের মতো উভয়পক্ষের আলাদা ব্যবস্থাপনায় দুটি পর্বে অনুষ্ঠিত হচ্ছে বিশ্ব ইজতেমা। ভারতের তাবলিগ জামাতের প্রধান কেন্দ্র নিজামুদ্দিন মারকাজের মুরব্বি মাওলানা সা‘দ কান্ধলভীর কিছু বিতর্কিত বক্তব্য নিয়ে শুরু হওয়া দ্বন্দ্ব এখনও বহাল রয়েছে। এ নিয়ে বিভিন্ন সময়ে সংঘাত-সংঘর্ষের পরিপ্রেক্ষিতে সা‘দ কান্ধলভীর বাংলাদেশে বিশ্ব ইজতেমায় আসাও বন্ধ হয়ে গেছে। বিভক্তি ছড়িয়ে পড়েছে বিভিন্ন দেশেও। আর বাংলাদেশের তাবলিগ কেন্দ্র কাকরাইল মসজিদের নিয়ন্ত্রণও পালাক্রমে দুই গ্রুপ। সা‘দ বিরোধী হিসেবে বাংলাদেশের তাবলিগ মুরব্বি মাওলানা জোবায়ের এবং সা‘দের পক্ষে মাওলানা ওয়াসিফুল ইসলামের নেতৃত্বে চলছে দুটি গ্রুপের কার্যক্রম।

বিশ্বের অন্যতম একটি ধর্মীয় দাওয়াতি এ সংগঠনের মধ্যে সৃষ্ট বিভক্তিতে চরম অস্বস্তিতে আছেন তাবলিগ সংশ্লিষ্ট মুরব্বিসহ সাধারণ অনুসারীরা। প্রকাশ্য ঘোষণা দিয়ে দুই পক্ষের আলাদা ব্যবস্থাপনায় দুটি পর্বে আয়োজিত বিশ্ব ইজতেমায়ও এর প্রভাব পড়ছে বলে জানা গেছে। এতে দেশে-বিদেশে চরমভাবে ভাবমূর্তিও ক্ষুণ্ন হচ্ছে। বিশ্ব ইজতেমা ঘিরে নিরাপত্তাব্যবস্থা গ্রহণে আইনশৃংখলাবাহিনীকেও বাড়তি চাপে পড়তে হচ্ছে। সরকারসহ সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন মহলের উদ্যোগ থাকলেও তাবলিগের দুই পক্ষের এ দ্বন্দ্ব সহসাই মেটা নিয়ে অনিশ্চয়তা বিরাজ করছে বলে জানা গেছে।

এমনই বাস্তবতায় আজ থেকে টঙ্গীর তুরাগ তীরে শুরু হচ্ছে ৫৬তম বিশ্ব ইজতেমার দ্বিতীয় পর্ব। এতে সা‘দ কান্ধলভীর অনুসারীরা ছাড়াও দেশ-বিদেশের সাধারণ ধর্মপ্রাণ মানুষ অংশ নিচ্ছে। আগামী রোববার আখেরি মোনাজাতের মধ্য দিয়ে এ পর্ব শেষ হবে। এর আগে গত ১৩-১৫ জানুয়ারি অনুষ্ঠিত হয় প্রথম পর্বের ইজতেমা। এতে সা‘দবিরোধীরা অংশ নেন। প্রথম পর্বের ইজতেমায় তাবলিগ অনুসারী ছাড়াও সাধারণ মুসল্লিদের ঢল নামে। দ্বিতীয় পর্বেও উপস্থিতি ভালো হচ্ছে বলে সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন। তবে ইজতেমায় উপস্থিতি ব্যাপক হলেও আয়োজকদের দ্বন্দ্বের কারণে দেশে-বিদেশে চরমভাবে ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন হচ্ছে বলে সংশ্লিষ্টরা মন্তব্য করেছেন।

চলমান দ্বন্দ্ব ও আলাদা ব্যবস্থাপনায় বিশ্ব ইজতেমা আয়োজন প্রসঙ্গে সা‘দপন্থী হিসেবে পরিচিত বাংলাদেশের তাবলিগ মুরব্বি মাওলানা ওয়াসিফুল ইসলাম আলোকিত বাংলাদেশকে বলেন, দুই পক্ষের আলাদা ব্যবস্থাপনায় বিশ্ব ইজতেমা আয়োজন হোক আমরাও চাই না। এতে অনেক সমস্যা হয়। আমরা ভারতের নিজামুদ্দিন মারকাজ তথা মূল পক্ষে আছি। আরেকটি পক্ষ হচ্ছে দেশি-বিদেশে চক্রান্তের অংশ। তাদের সঙ্গে পাকিস্তানের একটি পক্ষ আছে। ভারতের নিজামুদ্দিন মারকাজে তাদের তেমন কোনো অবস্থান নেই। তবে দুই পক্ষকে ঐক্যবদ্ধ করার বিষয়ে তাদের উদ্যোগ আছে বলেও তিনি উল্লেখ করেন।

কাকরাইল মসজিদ ব্যবহার প্রসঙ্গে ওয়াসিফুল ইসলাম বলেন, মসজিদটি পর্যায়ক্রমে দুই পক্ষই ব্যবহার করে। আমরা দুই সপ্তাহ এবং অন্যরা চার সপ্তাহ ব্যবহার করে।

অন্যদিকে দুই পক্ষের দ্বন্দ্বের বিষয়ে তাবলিগের আরেক পক্ষের প্রধান কাকরাইল মসজিদের ইমাম মাওলানা জোবায়ের বলেন, এটি অনেক লম্বা বিষয়। অল্পসময়ে এবং মোবাইলে বলা সম্ভব নয়।

সূত্রমতে, ১৯৪১ সালে দিল্লির নিজামউদ্দীন মসজিদের ছোট এলাকা মেওয়াতের নুহ মাদ্রাসায় তাবলিগ জামাতের প্রথম ইজতেমা আয়োজন করা হয়। বাংলাদেশে ১৯৪৬ সালে ঢাকার রমনা পার্কসংলগ্ন কাকরাইল মসজিদে তাবলিগ জামাতের বার্ষিক সম্মেলন বা ইজতেমা প্রথম অনুষ্ঠিত হয়। এরপর ১৯৪৮ সালে চট্টগ্রামে তৎকালীন হাজি ক্যাম্পে ইজতেমা হয়, ১৯৫৮ সালে বর্তমান নারায়ণগঞ্জের সিদ্ধিরগঞ্জে ইজতেমা অনুষ্ঠিত হয়। তখন এটা কেবল ইজতেমা হিসেবে পরিচিত ছিল।

প্রতিবছর ইজতেমায় অংশগ্রহণকারীর সংখ্যা আশাতীতভাবে বাড়তে থাকায় ১৯৬৬ সালে ইজতেমা টঙ্গীর পাগার গ্রামের খোলা মাঠে আয়োজন করা হয়। ওই বছর স্বাগতিক বাংলাদেশ ছাড়াও বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকে ধর্মপ্রাণ মুসলমানরা অংশ নেওয়ায় ‘বিশ্ব ইজতেমা’ হিসেবে পরিচিতি লাভ করে।

১৯৬৭ সাল থেকে বর্তমান অবধি (২০১১ সাল থেকে দুই পর্বে) ‘বিশ্ব ইজতেমা’ টঙ্গীর কহর দরিয়াখ্যাত তুরাগ নদের উত্তর-পূর্ব তীরসংলগ্ন ১৬০ একর জায়গার বিশাল খোলা মাঠে অনুষ্ঠিত হচ্ছে। তবে এ ইজতেমায় ব্যাপক জনসমাগমের কারণে ২০১১ সাল থেকে দুই পর্বে তিন দিন করে ৬ দিনব্যাপী অনুষ্ঠিত হচ্ছে। প্রতিবছর বিশ্বের অর্ধশতাধিক দেশসহ বাংলাদেশের প্রত্যন্ত গ্রম-শহর-বন্দর থেকে লাখ লাখ তাবলিগ অনুসারী ও সাধারণ ধর্মপ্রাণ মুসলমান বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম জমায়েত বিশ্ব ইজতেমায় অংশ নেন। সাধারণত প্রতিবছর জানুয়ারিতেই অনুষ্ঠিত হয় এ ইজতেমা।

এদিকে তাবলিগ জামাতের ভারতের শীর্ষ মুরব্বি সাদ কান্ধলভির বিতর্কিত কিছু বক্তব্যকে কেন্দ্র করে বিভক্ত হয়ে পড়েন বাংলাদেশের তাবলিগ অনুসারীরা। মূলত, ২০১৪ সালে ভারতের তাবলিগের মুরব্বি মাওলানা জোবায়েরুল হাসানের মৃত্যুর পর সা‘দ কান্ধলভী দায়িত্ব পালন শুরু করেন। এরপর থেকেই তার বিভিন্ন সিদ্ধান্ত নিয়ে সংশ্লিষ্ট মহলে বিরোধ দেখা দেয়। একপর্যায়ে ধর্মীয় বিভিন্ন বিষয়ে তার কিছু বক্তব্য নিয়েও চরম বিতর্ক ছড়িয়ে পড়ে বাংলাদেশসহ বিভিন্ন দেশে। ২০১৭ সালের বিশ্ব ইজতেমায় বিরোধ প্রকাশ্য রূপ নেয়। সা‘দ কান্ধলভীকে ঢাকায় আসা ঠেকাতে বিক্ষোভ শুরু হয় ঢাকায়। এমনকি ইজতেমা মাঠে তাবলিগের দুই গ্রুপের ব্যাপক সংঘর্ষ ও হতাহতের ঘটনাও ঘটে। এতে দেশে-বিদেশে তাবলিগ জামাত ও বিশ্ব ইজতেমার ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন হয়।

এমনই পরিস্থিতিতে ২০১৮ সালে ভারতের মাওলানা সা‘দ কান্ধলভী ঢাকায় এলেও তার বিরুদ্ধে শক্ত অবস্থানের কারণে তিনি কাকরাইল মসজিদে কয়েকদিন অবস্থান করে দেশে ফিরতে বাধ্য হন। এরপর গত ২০১৯ ও ২০ সালে এবং সর্বশেষ চলতি বছরের ইজতেমায় তার আসার সুযোগ হয়নি।

নানা সংঘাতের পর সরকার, শীর্ষ আলেমণ্ডওলামা ও বিভিন্ন ইসলামী সংগঠনের হস্তক্ষেপে ২০১৯ সালে ৫৪ তম বিশ্ব ইজতেমা একটানা চারদিন অনুষ্ঠিত হলেও দুই পক্ষ দুই দিন করে পরিচালনা করেন এবং দুটি আখেরি মোনাজাত অনুষ্ঠিত হয়।

আর ২০২০ সালে দুই গ্রুপের ব্যবস্থাপনায় দুই পর্বে তিন দিন করে অনুষ্ঠিত হয় ৫৫তম বিশ্ব ইজতেমা। ওই ইজতেমা থেকেই একই নিয়মে ২০২১ সালের ৫৬তম বিশ্ব ইজতেমার তারিখ নির্ধারণ করা হয়। তবে করোনার কারণে গত দুই বছর ইজতেমা আয়োজন সম্ভব হয়নি। এবার ৫৬তম বিশ্ব ইজতেমা অনুষ্ঠিত হচ্ছে।

সংশ্লিষ্ট একাধিক সূত্র জানায়, দুই গ্রুপের দ্বন্দ্বের কারণেই সংশ্লিষ্টদের আলাদা ব্যবস্থাপনায় দুটি পর্বে অনুষ্ঠিত হচ্ছে বিশ্ব ইজতেমা। এতে একপর্ব শেষ হওয়ার পর চারদিন বিরতি দিয়ে দ্বিতীয় পর্ব শুরু হচ্ছে। প্রথমপর্ব শেষ হওয়ার একদিন পরই মাঠ ছেড়ে দেন সংশ্লিষ্টরা। পরে দ্বিতীয় পর্বের আয়োজকরা মাঠ বুঝে নিয়ে ইজতেমা আয়োজনের প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করেন। এতে প্রকাশ্য কোনো সংঘাত না ঘটলেও দেশে-বিদেশের আলেমণ্ডওলামা ও সাধারণ মুসলমানদের মধ্যে দ্বন্দ্ব থেকেই যাচ্ছে।

তাবলিগের একজন মুরব্বি জানান, মূলত, সা‘দ কান্ধলভী তাবলিগের শীর্ষ পদে থাকার যোগ্য নন। তিনি থাকা পর্যন্ত এই দ্বন্দ্ব কাটিয়ে ওঠা কঠিন।

এ বিষয়ে বাংলাদেশ খেলাফত মজলিসের একজন নেতা জানান, বাংলাদেশের শীর্ষ আলেমণ্ডওলামা ও তাবলিগের বেশিরভাগ মানুষ সা‘দের বিরুদ্ধে। তারা মাওলানা জোবায়েরের নেতৃত্বে পরিচালিত প্রথম পর্বের ইজতেমায় অংশগ্রহণ করেছেন। কাকরাইল মসজিদও বেশিরভাগ সময় এই পক্ষের নিয়ন্ত্রণে থাকছে।

অবশ্য দুই গ্রুপের দ্বন্দ্বের কারণে উদ্ভূত যেকোনো পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে এবং প্রয়োজনীয় নিরাপত্তার জন্য বিশ্ব ইজতেমাকে ঘিরে কঠোর নিরাপত্তাব্যবস্থা গ্রহণ করছে আইনশৃংখলা বাহিনী। এতে সংশ্লিষ্টদের বাড়তি চাপে পড়তে হচ্ছে বলে জানা গেছে। এছাড়া বিভিন্ন সময়ে তাবলিগের দুই গ্রুপের দ্বন্দ্ব নিরসনে দফায় দফায় বৈঠকসহ সরকারের পক্ষ থেকে নানা উদ্যোগ নিতে দেখা গেছে। তবে এখনও দ্বন্দ্ব না মিটলেও উভয়পক্ষই আলাদাভাবে কার্যক্রমের সুযোগ পাচ্ছে। তবে দ্রুত যেন এ দ্বন্দ্ব মিটে আবার সম্মিলিত আয়োজনে বিশ্ব ইজতেমা অনুষ্ঠিত হয়, সেই প্রত্যাশা সংশ্লিষ্ট সবার।