সমসাময়িক ভাবনা

৫০ বছরে পাকিস্তানের চেয়ে দ্বিগুণ বাংলাদেশের অর্থনীতি

অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ বদরুজ্জামান ভূঁইয়া

প্রকাশ : ২০ জানুয়ারি ২০২৩, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ

পাকিস্তানকে পেছনে ফেলে জিডিপির আকারের ভিত্তিতে বৃহৎ অর্থনীতির দেশের তালিকায় ৩৫তম অবস্থানে উঠে এসেছে বাংলাদেশ। স্বাধীন হওয়ার পর ক্ষুধার্ত জনগণকে যখন দুই বেলা খাইয়ে রাখা কষ্টকর সেখানে ঘুরে দাঁড়ানো যেন অবাস্তব। এমন অবস্থায় বহির্বিশ্ব বাংলাদেশকে তলাবিহীন ঝুড়ি হিসেবে আখ্যায়িত করত। অথচ স্বাধীনতার ঠিক ৫০ বছর পর এসে সেই দেশটি এখন অর্থনীতিতে আশাজাগানিয়া একটি দেশ। শুধু দক্ষিণ এশিয়ায় নয়, এশিয়া অন্যতম সেরা অর্থনীতির দেশ বাংলাদেশ। অর্থনৈতিক ও সামাজিক সব সূচকে সেই পাকিস্তানের তুলনায় এগিয়ে বাংলাদেশ, বেশকিছু সূচকে ভারতকেও পেছনে ফেলেছে বাংলাদেশ। বিভিন্ন আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমেও বাংলাদেশের অর্থনৈতিক সাফল্যের বিষয় আলোচিত হচ্ছে অনেক দিন থেকে। প্রশংসা আসছে স্বয়ং পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রীর কাছ থেকেও।

‘দ্য বাংলাদেশ মডেল’ শিরোনামে এই লেখায় বাংলাদেশকে পাকিস্তানের উন্নয়নের জন্য মডেল হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। এ নিয়ে পাকিস্তানে হয় ব্যাপক আলোচনা। পাকিস্তানের বিশেষজ্ঞরা দুই দেশের বিভিন্ন সূচকে অবস্থান পরিষ্কার করেন এবং বাংলাদেশকে তাদের জন্য উন্নয়নের মডেল হিসেবে চিহ্নিত করেন। সম্ভবত এটা বাংলাদেশের জন্য একটি বড় বিজয়। পাকিস্তানের বিভিন্ন গণমাধ্যমে টকশোর একজন পরিচিত মুখ উন্নয়ন পরামর্শক জাইঘাম তার ‘দ্য বাংলাদেশ মডেল’এ বিভিন্ন তথ্য তুলে ধরেন। যেহেতু সামাজিক সংস্কৃতি ও ধর্মীয় কৃষ্টি-কালচারের দিক থেকে দেশ দুটির বৈশিষ্ট্যগত মিল রয়েছে তাই পাকিস্তানের অর্থনৈতিক ও সামাজিক উন্নয়নের জন্য তিনি বাংলাদেশকে ফলো করার কথা বলেন। অবশ্য সামাজিক ও অর্থনৈতিক গুরুত্বপূর্ণ ১০টি সূচকে বাংলাদেশের অগ্রগতি ও পাকিস্তানের পিছিয়ে পড়া তার এই মডেলটির যৌক্তিকতা নির্দেশ করে। নিউইয়র্কভিত্তিক একটি জনপ্রিয় বিজনেস পোর্টাল কোয়ার্টজ ডটকম বলেছে, বিশ্ব অর্থনীতিতে অগ্রসরমান এশিয়ার অন্যতম প্রতিনিধিত্বশীল দেশ হচ্ছে বাংলাদেশ। এটি বিশ্বের একমাত্র দেশ ২০২০ এবং ২০২১ এই বছরেই যাদের প্রবৃদ্ধি হবে ২ শতাংশের বেশি।

স্বল্পোন্নত দেশের কাতার থেকে মধ্যম আয়ের দেশে উঠে আসার ক্ষেত্রে মাথাপিছু জাতীয় আয়, মানবসম্পদ উন্নয়ন ও অর্থনৈতিক ভঙ্গুরতা সূচকের অন্তত দুটি পূরণ করতে হয়। স্বল্পোন্নত দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশই প্রথম দেশ হিসেবে তিনটি সূচকের সব কটি পূরণ করে পরবর্তী ধাপে উন্নীত হয়েছে, যা আমাদের জন্য গর্বের বিষয়। ২০২২ সালের সূচক অনুযায়ী বাংলাদেশ এখন বিশ্বের ৩৫তম বৃহৎ অর্থনীতির দেশ। ব্রিটেনের অর্থনৈতিক গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর ইকোনমিক্স অ্যান্ড বিজনেস রিসার্চ তাদের সর্বশেষ এক রিপোর্টে জানায় ২০৩০ সাল নাগাদ বাংলাদেশ ২৫তম অর্থনীতির দেশ হবে। এছাড়া অন্যান্য অর্থনৈতিক জরিপের ভবিষ্যদ্বাণী অনুযায়ী বাংলাদেশ ২০৪৩ সাল নাগাদ ২১তম শক্তিশালী অর্থনৈতিক দেশ হতে যাচ্ছে। মাথাপিছু আয়ের হিসাবে প্রায় ৪ বছর আগেই পাকিস্তানকে অতিক্রম করে বাংলাদেশ। ২০২১-২২ অর্থবছরে পাকিস্তানের মাথাপিছু আয় ছিল ১ হাজার ১০০ ডলার। ওই একই বছর বাংলাদেশের মাথাপিছু আয় বেড়ে দাঁড়ায় ২ হাজার ৮২৪ ডলার। করোনার মধ্যেও বাংলাদেশের মাথাপিছু আয় বেড়েছে ৯ শতাংশ। অন্যদিকে বর্তমানে পাকিস্তানের মাথাপিছু আয় ১ হাজার ৫৪৩ মার্কিন ডলার। অর্থাৎ, মাথাপিছু আয়ের দিক থেকে পাকিস্তানের তুলনায় যোজন যোজন এগিয়ে বাংলাদেশ।

মাথাপিছু আয়ের দিক থেকে পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতকেও পিছনে ফেলেছে বাংলাদেশ। ভারতের বর্তমান মাথাপিছু আয় ১৯৪৩ মার্কিন ডলার। আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) বলেছে, চলতি বছরে পাকিস্তানকে আরও একটি সূচকে পেছনে ফেলতে যাচ্ছে বাংলাদেশ। ক্রয়ক্ষমতার দিক থেকে পাকিস্তান এগিয়ে থাকলেও চলতি বছরে তা ছাড়িয়ে যাবে বাংলাদেশ। ভারতের শীর্ষস্থানীয় এক গণমাধ্যমের প্রতিবেদনে বলা হয়, অর্থনৈতিক উন্নতির হিসাবে পাকিস্তান এবং ভারত- দুই দেশকেই পেছনে ফেলে দক্ষিণ এশিয়ার নতুন তারকার তকমা ছিনিয়ে নিয়েছে বাংলাদেশ। বাংলাদেশ মোট জিডিপির হিসেবেও পাকিস্তানকে পেছনে ফেলেছে ২ বছর আগে। দেশের জিডিপি প্রবৃদ্ধির হার পাকিস্তানের তুলনায় বেশি। করোনা মহামারির আগে ২০১৮-১৯ অর্থবছরে বাংলাদেশের জিডিপি প্রবৃদ্ধি হয়েছিল ৮ দশমিক ১৫ শতাংশ, যা বিশ্বে জিডিপি প্রবৃদ্ধি অর্জনে ছিল অন্যতম। মাথাপিছু জিডিপিতেও পাকিস্তানকে ৩ বছর আগে পেছনে ফেলে বাংলাদেশ। আইএমএফের হিসেবে মাথাপিছু জিডিপিতে ভারতকেও পেছনে ফেলেছে বাংলাদেশ। সামাজিক বিভিন্ন সূচকে গত ১০ বছরে ভারতকে পেছনে ফেলে বাংলাদেশ।

শিক্ষার হার কিংবা গড় আয়ুর দিক থেকে পাকিস্তান থেকে অনেকটা এগিয়ে বাংলাদেশ। বাংলাদেশের মানুষের গড় আয়ু ৭৩.৬ বছর, ভারতে ৬৯.৪ এবং পাকিস্তানে ৬৭.১ বছর। যদিও শিক্ষার হারের দিক থেকে ভারত থেকে সামান্য একটু পিছিয়ে বাংলাদেশ। ভারতের ৭৪.৪%-এর বিপরীতে বাংলাদেশের শিক্ষার হার ৭৫% যেখানে পাকিস্তানে শিক্ষার হার মাত্র ৫৯.১৩%! পাকিস্তানের তুলনায় বাংলাদেশে বিত্তবানের সংখ্যা ৪৫% বেশি! এছাড়া বিভিন্ন রিপোর্ট সমীক্ষা অনুযায়ী অর্থনৈতিক স্বাধীনতার সূচকে ভারত-পাকিস্তানের চেয়ে এগিয়ে রয়েছে বাংলাদেশ, এছাড়া গণতন্ত্রের সূচকে ভারত ও পাকিস্তানের চেয়েও ভালো অবস্থানে রয়েছে বাংলাদেশ। মানবসম্পদ উন্নয়ন সূচকে ভারত কিছুটা এগিয়ে থাকলেও বাংলাদেশের অবস্থান পাকিস্তানের থেকে ভালো। পোশাকশিল্পকে অগ্রাধিকার দেয়ায় গত ১০ বছরে রপ্তানির চিত্র বদলেছে বাংলাদেশের। ২০১১ থেকে ২০২০ সাল পর্যন্ত প্রতি বছর গড়ে ৮.৬% রপ্তানি বেড়েছে। যেখানে বিশ্বে রপ্তানি বেড়েছে গড়ে ০.৪% মাত্র! এমন সাফল্যের পেছনে রয়েছে পোশাকশিল্পে নারী শ্রমিকদের অংশগ্রহণ বৃদ্ধি পাওয়া। বিপরীতে ভারত ও পাকিস্তানে কমেছে নারী শ্রমিকদের সংখ্যা। ভারতের বিশ্লেষকরা বলেছেন, বাংলাদেশের এগিয়ে যাওয়ার পেছনে শ্রমশক্তিতে নারীদের উচ্চতর অংশগ্রহণ একটি বড় ভূমিকা রাখছে। বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের পরিমাণের দিক থেকে পাকিস্তানের তুলনায় তিনগুণ এগিয়ে বাংলাদেশ। করোনার উদ্ভূত পরিস্থিতির মধ্যেও বাংলাদেশ ব্যাংকে থাকা বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ এবার ৪১ বিলিয়ন ডলারের মাইলফলকও পেরিয়ে গেছে। বিভিন্ন সামাজিক সূচক যেমন শিশু ও মাতৃমৃত্যুর হার হ্রাস, গড় আয়ুষ্কাল বৃদ্ধি, জন্মহার, উন্নত পয়ঃনিষ্কাশন সুবিধাসহ বিভিন্ন সামাজিক সূচকে ভারত ও পাকিস্তানের তুলনায় বাংলাদেশের অগ্রগতি বেশ ভালো। বাংলাদেশে জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার ১ দশমিক ৩৭ শতাংশ। অন্যদিকে পাকিস্তানে এই হার ২ শতাংশ। এছাড়া প্রতি এক হাজার শিশুর মধ্যে বাংলাদেশে মারা যায় ২২ জন, আর পাকিস্তানে মারা যায় ৬১ জন শিশু। পরিসংখ্যান বিশ্লেষণ করে দেখা যাচ্ছে, স্বাধীনতার পরের ৩০ বছর অনেক সূচকেই পাকিস্তানের অবস্থান ছিল বাংলাদেশের তুলনায় দ্বিগুণ। এরপর থেকে ব্যবধান ক্রমেই কমিয়ে আনে বাংলাদেশ। আর বর্তমানে সব সূচকেই পাকিস্তানের থেকে এগিয়ে রয়েছে বাংলাদেশ। একজন পাক বিশ্লেষক দাবি করেন এমন অবস্থা চলতে থাকলে ২০৩০ সালে বাংলাদেশের কাছে সাহায্য চাওয়া লাগতে পারে পাকিস্তানের! সর্বশেষ এক দশকে সব সূচকে অভূতপূর্ব উন্নয়ন ঘটেছে বাংলাদেশের। হেনরি কিসিঞ্জারের সেই ‘তলাবিহীন ঝুড়ি’ এখন অর্থনৈতিক উন্নয়নের মডেল। তবে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক ও সামাজিক বিভিন্ন উন্নয়নের ক্ষেত্রে রাজনৈতিক সহিংসতা বাধা হয়ে না দাঁড়ালে হয়তো আরও ভালো অবস্থানে থাকত বাংলাদেশ।

এছাড়া ভৌগোলিক অবস্থানগত কারণে বিভিন্ন প্রাকৃতিক দুর্যোগ মোকাবিলা করতে হয় প্রায় প্রতিবছর। বিভিন্ন প্রতিবন্ধকতাকে উপেক্ষা করে রপ্তানি, রিজার্ভ, জিডিপি থেকে শুরু করে দেশের বাজেটের আকার, রাজস্ব আয়, রেমিট্যান্স, দারিদ্র্য নিরসন, খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন, দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা, অবকাঠামো তৈরি ও উন্নয়ন, মানবসম্পদ উন্নয়নে সাফল্য এসেছে। এসব সূচকে পাকিস্তানকে পিছনে ফেলা সম্ভবত যুদ্ধের ৫০ বছরে বাংলাদেশের সব থেকে বড় অর্জন। বাংলাদেশ শেখ হাসিনার গত এক যুগের শাসনামলে এগিয়ে গেছে দুর্বার গতিতে। বেশকিছু সামাজিক সূচকের পাশাপাশি অর্থনীতির সূচকেও উল্লেখযোগ্য উন্নতি করেছে। এমডিজি সফলভাবে বাস্তবায়ন করেছে, এসডিজি বাস্তবায়নের পথে। মাত্র একযুগ আগেও যে ভারতের মাথাপিছু জিডিপি প্রায় দ্বিগুণ ছিল, তারাও পেছনে পড়ে যাচ্ছে। একসময়ের কথিত ‘তলাবিহীন ঝুড়ি’ আজ বিশ্ব দরবারে উদীয়মান অর্থনীতির রোল মডেল যার নেতৃত্বে, কৃতিত্ব তো সেই ‘ক্যারিশমাটিক’ নেত্রী শেখ হাসিনাকে দিতে হবেই। বাংলাদেশের জনগণ তার ওপরে আস্থা রেখে তাকে তার পরিকল্পনা অনুযায়ী কাজ করবার সুযোগ করে দিয়েছে। আগামী দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বাংলাদেশের জনগণ একই রকমভাবে তার উপরে বিশ্বাস রাখবে কারণ এই মুহূর্তে আমাদের সবার মাথায় যে বিষয়টি মাথায় রাখা উচিত, সেটি হচ্ছে- বাংলাদেশের রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে শেখ হাসিনার বিকল্প এখন পর্যন্ত তৈরি হয়নি। বঙ্গবন্ধু এবং বাংলাদেশ যেমন সমার্থক হিসেবে ব্যবহৃত হয় ঠিক তেমনিভাবে শেখ হাসিনা বর্তমানে বাংলাদেশের উন্নয়নের আরেক নাম হয়ে উঠেছেন। ফলে, তিনি বাংলাদেশের রাজনীতি এবং উন্নয়ন ব্যবস্থার অপরিহার্য অংশ হয়ে উঠেছেন।

লেখক : ট্রেজারার, বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয় ও সাবেক চেয়ারম্যান ট্যুরিজম অ্যান্ড হস্পিটালিটি ম্যানেজমেন্ট বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।