সহসায় কাটছে না গ্যাস নিয়ে গ্রাহকদের দুর্ভোগ

প্রকাশ : ২১ জানুয়ারি ২০২৩, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ

  ফারুক আলম

সরবরাহ কমে যাওয়ার পাশাপাশি শীতে তাপমাত্রা কমে গেলেও চাহিদার অতিরিক্ত গ্যাস প্রয়োজন হয়। সেজন্য এবারও গ্যাস সংকটের ভোগান্তিতে পড়েছেন মানুষ। রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে কয়েক মাস ধরে গ্যাসের তীব্র সংকট চলছে। এতে চরম ভোগান্তিতে পড়েছেন আবাসিক ও শিল্প গ্রাহকেরা। বাসাবাড়িতে চুলায় গ্যাস পাওয়া যাচ্ছে না। লাইনের গ্যাসের চুলা থাকার পরেও অনেকে রান্নার কাজে ব্যবহার করছেন এলপিজি সিলিন্ডার দিয়ে। এতে সংসারে খরচ বাড়ছে। এছাড়া গ্যাস সংকটের কারণে শিল্পকারখানাগুলোতে উৎপাদন ব্যাহত হচ্ছে।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, প্রত্যেক বছরে শীতের মৌসুমে লাইনের গ্যাসে চাপ কম থাকায় চরম ভোগান্তিতে পড়েন গ্রাহকরা। তবে এবারের ভোগান্তি আগের তুলনায় দ্বিগুণ হয়েছে। সকাল থেকে রাত পর্যন্ত গ্যাসের সংকট চলছে। উত্তরা, কামারপাড়া, নীলক্ষেত, আজিমপুর, মোহাম্মদপুর, রামপুরা, যাত্রাবাড়ী, শনিরআখড়া, মাতুয়াইল, মতিঝিল ও পুরান ঢাকাসহ প্রভৃতি এলাকায় আবাসিক গ্রাহকরা গ্যাসের সংকটে ভুগছেন। লাইনের চুলা থাকলেও তাদের সিলিন্ডারের চুলায় রান্নার কাজ সারতে হচ্ছে।

বছরে বছরে গ্যাসের চাহিদা বাড়লেও দেশে গ্যাসের মজুত ও সরবরাহ কমেছে। এতে গ্যাস সেক্টরে চাহিদা ও যোগানের মধ্যে বিশাল ফারাক তৈরি হয়েছে। বর্তমানে দৈনিক যে পরিমাণ গ্যাস সরবরাহ হচ্ছে, সেখানে প্রায় ১৪০ কোটি ঘনফুট গ্যাসের সরবরাহ সংকট রয়েছে। এ সংকটের কারণে পেট্রোবাংলাকেও রেশনিং করতে হচ্ছে। স্থানীয় শিল্প খাতের উৎপাদন থেকে শুরু করে বিদ্যুৎকেন্দ্র, আবাসিকসহ প্রতিটি খাতেই সংকট বড় হয়ে দেখা দিয়েছে। তিতাস ও পেট্রোবাংলা দুটো প্রতিষ্ঠান গ্যাসের সংকট নিয়ে চাপের মধ্যে রয়েছে।

মাতুয়াইল এলাকার বাসিন্দা গৃহবধূ ফারজানা আক্তার বলেন, ২৪ ঘণ্টার মধ্যে রাত আড়াইটা থেকে তিনটার দিকে একটু গ্যাস আসে। আবার ভোর হওয়ার আগে চলে যায়। সারা দিন চুলায় গ্যাস থাকে না। তাই সিলিন্ডার কিনে সেটি দিয়ে রান্না করতে হচ্ছে। প্রতি মাসেই সিলিন্ডারের প্রয়োজন পড়ে।

রামপুরা এলাকার বাসিন্দা গৃহবধূ সানজিদা পারভীন বলেন, গ্যাসের সংকটের কারণে চুলায় রান্নার কাজ সারা যায় না। দিনভর গ্যাস থাকে না। রাতে গ্যাসের চাপ একটু থাকলেও সেটি ভোর হলেই চলে যায়। কত দিন এই সমস্যা থাকবে, কেউ জানে না।

বড় মগবাজারের বাসিন্দা আয়শা সিদ্দিকা পলি বলেন, লাইনের গ্যাস সকালেই চলে যায়, আসে রাত ১০টার পর। লাইনের গ্যাস থেকে রান্না করতে চাইলে গভীর রাতে করতে হয়। তাই আপাতত তিনি এলপিজি সিলিন্ডার দিয়েই কাজ চালাচ্ছেন। এর ফলে সিলিন্ডার কেনার খরচ যেমন বেড়েছে তেমনি মাসশেষে গ্যাস বিলও দিতে হচ্ছে।

সরবরাহ কম থাকায় গ্যাসের এমন সংকট চলছে বলে জানিয়েছে তিতাস গ্যাস কর্তৃপক্ষ। গ্যাসের চাহিদার তুলনায় সরবরাহের ঘাটতি রয়েছে। সরবরাহ না থাকায় গ্যাসের এই সংকট।

তিতাস সূত্র জানা গেছে, চাহিদার তুলনায় গ্যাস সরবরাহ না থাকায় শুধু ঢাকা নয়, ঢাকার আশপাশের এলাকা সাভার, গাজীপুর, আশুলিয়া, নারায়ণগঞ্জ, মুন্সীগঞ্জের বিভিন্ন স্থানে গ্যাসের চাপ থাকছে না। ফলে উৎপাদনও ব্যাহত হচ্ছে এসব এলাকার শিল্প কারখানায়।

জানা গেছে, দেশে গ্যাসের চাহিদা দৈনিক ৪ হাজার মিলিয়ন ঘনফুট, এর বিপরীতে সরবরাহ ২ হাজার ৬০০ মিলিয়ন ঘনফুট। দৈনিক প্রায় এক হাজার ৪০০ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস সরবরাহ কম করা হচ্ছে। এখন গড়ে ৪২১ মিলিয়ন ঘনফুট এলএনজি সরবরাহ করা হচ্ছে। আর বাদবাকি অংশ দেশীয় খনির গ্যাস।

শিল্পকারখানাগুলোয় গ্যাসের সংকটে ব্যাহত হচ্ছে উৎপাদন। ফলে রপ্তানিমুখী তৈরি পোশাক কারখানা, স্পিনিং, টেক্সটাইল, রি-রোলিং মিলসহ বিভিন্ন শিল্পপ্রতিষ্ঠানের উৎপাদন মারাত্মকভাবে ব্যাহত হচ্ছে। দ্রুত এই সমস্যার সমাধান করা না হলে রপ্তানি বাণিজ্যে ধস নামার আশঙ্কা ব্যবসায়ীদের। শিল্পকারখানা চালাতে হলে ন্যূনতম গ্যাসের চাপ ৬ পিএসআই লাগে। সেটি কমে এখন ১ থেকে ২-এ নেমে এসেছে।

শোহান ফ্যাশন লিমিটেড ডাইংয়ে প্রতিদিন ৬০ থেকে ৬৫ টন মাল উৎপাদন হতো। কিন্তু গ্যাস সংকট ও বিদ্যুতের লোডশেডিংয়ের কারণে উৎপাদন ৩০ থেকে ৩৫ টনে নেমে এসেছে। কারখানাটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক কামরুজ্জামান নাহিদ বলেন, এমনিতেই বায়ারদের থেকে অর্ডার অনেক কমে গেছে। গ্যাসের চাপ পিএসআই এক থেকে দুই আছে। শিল্পকারখানায় উৎপাদন কমে যাওয়ায় লোকসান গুনতে হচ্ছে।

টঙ্গী ডায়িং হাউজ অ্যাপারেলসের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ফজলে এহসান বলেন, গ্যাস- সংকটের কারণে আমাদের দুটি কারখানায় উৎপাদন ৬০ থেকে ৭০ শতাংশ কমে গেছে। কীভাবে এই সংকটের সমাধান হবে, তা আমরা জানি না। গ্যাস-সংকট এভাবে চলতে থাকলে রপ্তানি আয় ক্ষতির সম্মুখীন হবে বলে জানিয়েছেন নিট পোশাকশিল্প মালিকদের সংগঠন বিকেএমইএ’র নেতারা।

গ্যাস সংকট কবে স্বাভাবিক হবে এ বিষয়ে পেট্রোবাংলার কর্মকর্তারা বলছেন, স্পট মার্কেটে এলএনজি আমদানি সম্ভব না হওয়া পর্যন্ত গ্যাসের সংকট কাটানো কঠিন। সরকার গত বছরের শেষ প্রান্তে এসে স্পট মার্কেট থেকে এলএনজি কেনা বন্ধের সিদ্ধান্ত নেয়। স্পট মার্কেট থেকে যতদিন এলএনজি আমদানি করা সম্ভব হবে না ততদিন এই সংকট কমার খুব একটা সম্ভাবনা নেই।

তিতাসের পরিচালক (অপারেশন) মো. সেলিম মিয়া বলেন, আমাদের প্রায় ১৮০০ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাসের চাহিদা রয়েছে। এর মধ্যে ১৫০০ মিলিয়নের মতো আমরা পাচ্ছি। প্রায় ৩০০ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাসের ঘাটতি আছে। এছাড়া শীতের কারণে গ্যাস জমে যাওয়ায় পাইপলাইনের একেবারে শেষ প্রান্তের গ্রাহকের গ্যাসের সরবরাহ কম থাকে প্রায়ই।