ঢাকা ২০ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ৫ আশ্বিন ১৪৩১ | বেটা ভার্সন

দাশেরকান্দি স্যুয়ারেজ ট্রিটমেন্ট প্ল্যান্ট

পূর্ণ সক্ষমতায় দৈনিক পয়ঃবর্জ্য শোধন হচ্ছে ৫০ কোটি লিটার

পূর্ণ সক্ষমতায় দৈনিক পয়ঃবর্জ্য শোধন হচ্ছে ৫০ কোটি লিটার

ঢাকায় প্রায় ২ কোটি মানুষের বসবাস। এসব মানুষের সেবায় নিয়োজিত সাতটি মন্ত্রণালয়ের ৫৬টি সেবা সংস্থা। ঘনবসতিপূর্ণ এই শহরে সেবা দিতে গিয়ে বহু সংস্থা যেখানে ন্যুয়ে পড়েছে, সেখানে প্রতিনিয়ত নগরবাসীকে সেবা দিয়ে যাচ্ছে স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের আওতাধীন সেবা সংস্থা ঢাকা ওয়াসা। সংস্থাটি সুপেয় পানি সরবরাহের পাশাপাশি স্যুয়ারেজেও আধুনিকায়নের ছোঁয়া লাগিয়েছে। রাজধানীর আফতাবনগর সংলগ্ন দাশেরকান্দিতে পয়ঃশোধনাগার নির্মাণ করা হয়েছে। প্রকল্পের কাজ শেষে এখন পূর্ণ সক্ষমতায় চলছে পয়ঃশোধনাগারটি। শিগগিরই আনুষ্ঠানিকভাবে দাশেরকান্দি স্যুয়ারেজ ট্রিটমেন্ট প্ল্যান্ট উদ্বোধন করা হবে জানিয়েছে ঢাকা ওয়াসা কর্তৃপক্ষ।

দাশেরকান্দি শোধনাগার সরেজমিন ঘুরে দেখা গেছে, প্রকল্পের অধীনে রামপুরা সেতুর পশ্চিম পাশে বর্জ্য লিফটিং স্টেশন স্থাপন করা হয়েছে। এছাড়া হাতিরঝিল থেকে আফতাবনগর হয়ে দাশেরকান্দি শোধনাগার পর্যন্ত প্রায় ৫ কিলোমিটার ট্রাংক স্যুয়ারেজ লাইন (পয়ঃবর্জ্য পরিবহণের প্রধান লাইন) রয়েছে। দাশেরকান্দিতে প্রায় ২৪ হেক্টর জমির ওপর এই শোধনাগার নির্মাণ করা হয়েছে। সেখানে বিশাল আয়তনের ১২টি গোলাকার ট্যাংক রয়েছে। পয়ঃবর্জ্য কয়েক দফা শোধনের পর পানি বালু নদীতে ফেলা হচ্ছে। এই শোধনাগারের মাধ্যমে হাতিরঝিলের দক্ষিণে ছয়টি এবং উত্তরে পাঁচটি স্পেশাল স্যুয়ারেজ ডাইভারশন স্ট্রাকচার (এসএসডিএস) দিয়ে নির্গত বর্জ্য শোধন করা হচ্ছে। পয়ঃশোধনে প্রতিদিন প্রায় ৫৮০ টন প্রক্রিয়াকরণ ক্ষমতাসহ একটি স্লাজ শুকানোর-বার্নিং সিস্টেম করা হচ্ছে।

জানা গেছে, এতদিন পয়ঃবর্জ্য শোধনের ব্যবস্থা না থাকায় নগরের সব পয়ঃবর্জ্য ড্রেন, নালা, খাল ও ঝিল গড়িয়ে ঢাকার চারপাশের নদীতে পড়ত। এতে ভয়াবহ আকারে পৌঁছায় নদীর পানিদূষণ। এ অবস্থা থেকে পরিত্রাণ পেতে দাশেরকান্দি পয়ঃশোধনাগার স্থাপন করে ঢাকা ওয়াসা। রমনা থানার অন্তর্ভুক্ত এলাকা মগবাজার ওয়্যারলেস রোড, ইস্কাটন, নয়াটোলা, মৌচাক, আউটার সার্কুলার রোড, মহানগর হাউজিং, কলাবাগান ও ধানমন্ডির (পূর্বাংশ) পয়ঃবর্জ্য শোধন করা হচ্ছে। এছাড়া হাতিরঝিলের উত্তর পাশের এলাকা তেজগাঁও, নাখালপাড়া, নিকেতন, বাড্ডা, বনানী ও গুলশানের আংশিকসহ রাজধানীর বেশ কিছু এলাকার পয়ঃবর্জ্য পরিশোধন করে দুর্গন্ধমুক্ত পানি বালু নদীতে ফেলা হচ্ছে। এই প্রকল্পের মাধ্যমে দিনে ৫০ কোটি লিটার পয়ঃবর্জ্য পরিশোধন করা হয়। আর এর সুফল পাচ্ছে নগরীর ৫০ লাখ মানুষ।

এ বিষয়ে ঢাকা ওয়াসার ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) প্রকৌশলী তাকসিম এ খান আলোকিত বাংলাদেশকে বলেন, দাশেরকান্দি স্যুয়ারেজ ট্রিটমেন্ট প্ল্যান্টটি বাংলাদেশের প্রথম এবং বৃহত্তম আধুনিক পয়ঃশোধন ট্রিটমেন্ট প্ল্যান্ট। এটি দক্ষিণ এশিয়ারও একক বৃহত্তম পয়ঃশোধনাগার। চীনে পয়ঃশোধন ও স্লাজ (কাঁদাযুক্ত মাটি) আলাদা করতে দুটি ট্রিটমেন্ট প্ল্যান্ট চালু রাখতে হয়। সেখানে দাশেরকান্দি স্যুয়ারেজ ট্রিটমেন্ট প্ল্যান্টে পয়ঃশোধন ও স্লাজ আলাদা করা যাচ্ছে।

তিনি আরও বলেন, দাশেরকান্দি ট্রিটমেন্ট প্ল্যান্টে পয়ঃশোধনের পর পানি বেগুনবাড়ী খাল ও বালু নদী হয়ে শীতলক্ষ্যা পড়ছে। ফলে এ ডাউন স্ট্রিমে শীতলক্ষ্যা নদীর পানির গুণগত মান ভালো পাওয়া যাচ্ছে। এতে বছরে এক মাস শীতলক্ষ্যার পানি প্রি-ট্রিটমেন্ট ছাড়াই ঢাকা ওয়াসা সরবরাহ করছে। ফলে বিদ্যুৎ বিল বাবদ ওয়াসার প্রায় ২৭ লাখ টাকা সাশ্রয় হয়।

ওয়াসার একাধিক কর্মকর্তা বলেছেন, ঢাকার পয়ঃবর্জ্য পরিস্থিতি বদলাতে ২০১৫ সালের আগস্টে দাশেরকান্দি পয়ঃশোধনাগার প্রকল্পটির আনুষ্ঠানিকভাবে শুরু হয়। এটি হাতিরঝিল থেকে ৫ কিলোমিটার দূরে আফতাবনগরের কাছে দাশেরকান্দিতে নির্মাণ করা হয়েছে। এটি বাংলাদেশের বৃহত্তম পয়ঃশোধনাগার প্রকল্প। গত বছরের এপ্রিল থেকে আনুষ্ঠানিকভাবে চালু হয়েছে। দাশেরকান্দি পয়ঃশোধনাগার বাংলাদেশের প্রথম আধুনিক বিশালাকার ট্রিটমেন্ট প্ল্যান্ট। চীনের ছিংহুয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের পেটেন্টের অধীনে প্রস্তুত করা হয়েছে।

বাড্ডার বাসিন্দা লিয়াকত আলী বলেন, সাত মন্ত্রণালয়ের আওতাধীন ৫৬ রকম সেবায় ৫৬ রকম ভোগান্তি। কেউ খুঁড়ছে, তো কেউ ভরছে; কেউ কাটছে, কেউ আটকাচ্ছে- সবাই যেন উদাসীন। এভাবেই চলছে রাজধানী। তিনি বলেন, এসব সংস্থার মধ্যে ঢাকা ওয়াসাই ভালো করছে। পানি ও স্যুয়ারেজ লাইনের যেসব সমস্যা ছিল, বর্তমানে সেটি নেই। এখন বাসাবাড়ির পয়ঃবর্জ্য ড্রেন ও খালে না গিয়ে সরাসরি দাশেরকান্দি পয়ঃশোধনাগারে পড়ছে।

পাওয়ার চায়নার অধীনে চেংডু ইঞ্জিনিয়ারিং কর্পোরেশনের ডিজাইন ও নির্মিত প্রকল্পটি এক বছরের অপারেশন্স ও রক্ষণাবেক্ষণ শেষে গত বছরের এপ্রিলে ওয়াসার কাছে হস্তান্তর করা হয়।

দাশেরকান্দি পয়ঃশোধনাগার প্রকল্পের পরিচালক প্রকৌশলী মহসিন আলী মিয়া আলোকিত বাংলাদেশকে বলেন, এই প্রকল্পের মাধ্যমে বালু নদীর পাশাপাশি শীতলক্ষ্যা নদীর পানি দূষণের পরিমাণও কমবে। এছাড়া এই শোধনাগারে প্রতিদিন যে শুষ্ক বর্জ্য তৈরি হবে, সেই বর্জ্য সিমেন্ট কারখানায় ব্যবহার করা যাবে কাঁচামাল হিসেবে। এতে নগরের পরিবেশ আরও ভালো হবে।

উন্নয়ন পরিকল্পনা প্রস্তাব (ডিপিপি) অনুযায়ী, দাশেরকান্দি পয়ঃশোধনাগার ২০১৫ সালের জুলাইয়ে শুরু হয়ে এই প্রকল্পের কাজ শেষ হওয়ার কথা ছিল ২০১৯ সালের ডিসেম্বরে। তবে দুই দফা সংশোধনীতে প্রকল্পের মেয়াদ বাড়ানো হয়েছে ২০২৩ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত। এরই মধ্যে প্রকল্পের কাজ প্রায় শেষ। এখন পরীক্ষামূলকভাবে শোধন করা হচ্ছে বর্জ্য। প্রকল্পের আনুষ্ঠানিক উদ্বোধনের জন্য প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছে সময় চেয়েছে ঢাকা ওয়াসা। আট বছরে প্রকল্পটি বাস্তবায়নে প্রায় ৩ হাজার ৪৮২ কোটি টাকা ব্যয় হয়েছে।

প্রসঙ্গত, ‘ঘুরে দাঁড়াও ঢাকা ওয়াসা’ কর্মসূচির মাধ্যমে ঢাকা শহরের পানি ব্যবস্থাপনা এবং পয়ঃনিষ্কাশন ব্যবস্থার আমূল পরিবর্তনের লক্ষ্যে বেশ কিছু ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে। তারই অংশ হিসেবে স্যুয়ারেজ ট্রিটমেন্ট প্ল্যান্ট হাতে নেয়া হয়। ঢাকা শহরকে শতভাগ স্যুয়ারেজ নেটওয়ার্কের আওতায় নিয়ে আসা এবং পয়ঃবর্জ্য শোধন করে নদীতে ফেলার জন্য এই পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে।

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত