ঢাকা ২০ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ৫ আশ্বিন ১৪৩১ | বেটা ভার্সন

পার্বত্য চট্টগ্রামের গহিন পাহাড় থেকে রোহিঙ্গা ক্যাম্পে জঙ্গিরা

উদ্বেগ বাড়ছে স্থানীয়দের
পার্বত্য চট্টগ্রামের গহিন পাহাড় থেকে রোহিঙ্গা ক্যাম্পে জঙ্গিরা

পার্বত্য চট্টগ্রামের পর কক্সবাজারের রোহিঙ্গা ক্যাম্প থেকে নতুন জঙ্গি সংগঠনের ‘সামরিক শাখার প্রধান ও বোমা বিশেষজ্ঞ গ্রেপ্তারের ঘটনায় উদ্বেগ বেড়েছে ওই অঞ্চলের বাসিন্দাদের মাঝে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর অভিযানের মুখে জঙ্গিরা পার্বত্য চট্টগ্রাম থেকে সরে এসে রোহিঙ্গা ক্যাম্পে আশ্রয় নিয়েছিল নাকি নতুন সদস্য সংগ্রহে আস্তানা গেড়েছে তা নিয়ে প্রশ্ন দেখা দিয়েছে।

জানা গেছে, পার্বত্য চট্টগ্রাম ও মিয়ানমারঘেঁষা কক্সবাজারের উখিয়া ও টেকনাফে ৩৩টি রোহিঙ্গা আশ্রয় শিবির রয়েছে। যার অবস্থান পাহাড়ের পাশেই। তাই ক্যাম্পে শীর্ষ জঙ্গিদের অবস্থান নেয়ার ঘটনা ভাবিয়ে তুলেছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীসহ স্থানীয় ও জনপ্রতিনিধিদেরও।

নিরাপত্তা বিশ্লেষক মেজর জেনারেল (অব.) ড. মোহাম্মদ নাঈম আশফাক চৌধুরী বলেন- হতাশাগ্রস্ত মানুষদের যে কেউ উগ্রপন্থায় রেডিক্যালাইজড করা সহজ। সুতরাং ক্যাম্পের ভেতরে কি হচ্ছে না হচ্ছে তার জন্য কার্যকরি তৎপরতা বজায় রাখার পাশাপাশি রোহিঙ্গাদের নিজ দেশে ফেরত পাঠাতে দ্রুত কূটনৈতিক উদ্যোগ নেয়া জরুরি।

তিনি বলেন- গত প্রায় ৬ বছর ১১/১২ লাখ রোহিঙ্গা একটা গণ্ডিবদ্ধ জীবনযাপন করছে। তারা হতাশায় ভুগছে। কারণ তারা কবে স্বদেশে ফেরত যাবে, কোথায় যাবে এবং তাদের ভবিষ্যৎ কি হবে এটা নিয়ে দুশ্চিন্তায় আছে। তারা হতাশায় আছে। আর হতাশাগ্রস্ত মানুষদের উগ্রপন্থায় রেডিক্যালাইজড করা সহজ। জেনারেল চৌধুরী আরও বলেন, বাইরে থেকে কে আসবে আর ভেতর থেকে কে সংগঠিত করবে সেটা পরের কথা। প্রথমেই রোহিঙ্গা সমস্যা সমাধান করা জরুরি। রোহিঙ্গা ও উগ্রবাদ সমস্যা শুধু বাংলাদেশ মিয়ানমারেই নয়, দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়াসহ এ অঞ্চলের জন্য হুমকি হয়ে দাঁড়াবে। উগ্রবাদের কারণে পুরো অঞ্চল অস্থির এবং সংকটাপন্ন হয়ে পড়বে বলেও মনে করেন ‘রোহিঙ্গা সংকটের মধ্যে বাংলাদেশ-মিয়ানমার সম্পর্ক’ নিয়ে পিএইচডি করা এ অবসরপ্রাপ্ত জেনারেল।

এদিকে র‍্যাব বলছে, মূলত কয়েকটি কারণে পাহাড়ে আস্তানা গড়েছে জঙ্গি সংগঠনগুলো। এরমধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো- জঙ্গি সংগঠনগুলোর বিষয়ে সাধারণ মানুষ সচেতন হওয়ায় জঙ্গিরা বাসাবাড়িতে আশ্রয় পাচ্ছে না। নিজেদের নিরাপত্তার জন্য পাহাড়কে নিরাপদ মনে করছে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর অব্যাহত অভিযানের কারণে তারা কোথাও থিতু হতে পারছে না এবং অন্যান্য শ্রেণির মানুষকে সংগঠনভুক্ত করতে চাচ্ছে জঙ্গিরা। নজরদারি বাড়ানোর পাশাপাশি রোহিঙ্গা ক্যাম্পকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে কাজ করার দাবি করেছেন র‍্যাব মুখপাত্র আইন ও গণমাধ্যম শাখার পরিচালক কমান্ডার খন্দকার আল মঈন।

অপরদিকে গতকাল বৃহস্পতিবার স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল বলেন, রোহিঙ্গা সংকটের সমাধান না হলে দেশীয় জঙ্গিদের পাশাপাশি বাংলাদেশে আন্তর্জাতিক সন্ত্রাসী গোষ্ঠীর অনুপ্রবেশ ঘটতে পারে। রোহিঙ্গা ক্যাম্প এলাকায় সাম্প্রতিক জঙ্গি আস্তানার সন্ধান সেটিরই ইঙ্গিত বহন করে উল্লেখ করে মন্ত্রী বলেন, ইয়াবার টাকা ভাগাভাগির জন্যই রোহিঙ্গাদের বিভিন্ন গ্রুপের মধ্যে মারামারি হচ্ছে।

মন্ত্রী আরও বলেন, জঙ্গিদের নিয়ন্ত্রণ করা গেলেও তাদের মূলোৎপাটন করা যায়নি। আইনশৃঙ্খলা বাহিনী সমন্বিতভাবে কাজ করছে। যে কোনো মূল্যেই তাদের নির্মূল করা হবে বলেও হুঁশিয়ারি দেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী। পাহাড়ে আশ্রয় নেয়া ৫২ জঙ্গির সবাইকে আইনের আওতায় আনা হবে।

র‍্যাব সূত্রে জানা গেছে, সাম্প্রতিক খবর আসে বান্দরবান ও রাঙামাটির দুর্গম পাহাড়ি অঞ্চলে প্রশিক্ষণের জন্য আস্তানা গেড়েছে নতুন সশস্ত্র জঙ্গি সংগঠন জামায়াতুল আনসার ফিল হিন্দাল শারক্বিয়ার শীর্ষ নেতারা। পার্বত্য চট্টগ্রামের বিচ্ছিন্নতাবাদী সংগঠন কুকি চিন ন্যাশনাল ফ্রন্টের (কেএনএফ) সেল্টারে তারা এ প্রশিক্ষণ ক্যাম্প গড়ে তুলেছিল। অক্টোবর থেকে টানা পাহাড়ে অভিযান চালিয়ে জঙ্গি প্রশিক্ষণের আস্তানাগুলো গুঁড়িয়ে দেয় র‍্যাব। এ সময় দফায় দফায় কেএনএফ ও জঙ্গি সংগঠনের অন্তত ৩৮ জনকে গ্রেপ্তার করেছে।

এরইমধ্যে গোয়েন্দাদের কাছে তথ্য আসে পার্বত্য চট্টগ্রামের গহীন অরণ্য থেকে জঙ্গিরা রোহিঙ্গা ক্যাম্পের দিকে অবস্থান নিয়েছে। সে সূত্র ধরে রোহিঙ্গা ক্যাম্পে অভিযানে নামে র‍্যাব। গত সোমবার কক্সবাজারের উখিয়ায় রোহিঙ্গা ক্যাম্পে র‍্যাবের অভিযানের সময় গোলাগুলির পর জঙ্গি সংগঠন জামায়াতুল আনসার ফিল হিন্দাল শারক্বিয়ার শূরা সদস্য, সামরিক শাখার প্রধান রনবীর ও তার সহযোগী বোমা বিশেষজ্ঞ বাশারকে অস্ত্রসহ গ্রেপ্তার করা হয়েছে।

ফলে পার্বত্য চট্টগ্রামের পর রোহিঙ্গা ক্যাম্পে জঙ্গিদের অবস্থান নেয়ার বিষয়টি আলোচনায় আসে। প্রশ্ন দেখা দিয়েছে কেন পাহাড়ে আস্তানা গড়েছে জঙ্গিরা? তবে জঙ্গি নেতারা আত্মগোপন নাকি সদস্য সংগ্রহের পাশাপাশি প্রশিক্ষণের জন্য রোহিঙ্গা ক্যাম্পে অবস্থান নেয় তা এখনো নিশ্চিত করতে পারেনি র‍্যাব।

র‍্যাবের দাবি অনুযায়ী- নব্য জঙ্গি সংগঠনের সামরিক শাখার প্রধান মাশেকুর রহমান ওরফে রনবীর। পাবর্ত্য চট্টগ্রামে ৫৫ জনসহ অনেককে প্রশিক্ষণ, অস্ত্র সরবরাহ ও বোমা তৈরির প্রশিক্ষণ দিচ্ছে এমন তথ্যের ভিত্তিতে র‍্যাব মাঠে নামে। কিন্তু অভিযানে অন্যদের পাকড়াও করা গেলেও তাকে পাওয়া যায়নি। তাকে ধরতে সাঁড়াশি অভিযানে নেমে শনাক্ত করে রোহিঙ্গা ক্যাম্পে তার অবস্থান। ২৩ জানুয়ারি ভোরে রোহিঙ্গা ক্যাম্পে তার অবস্থান শনাক্তের পর অভিযান চালায় র‍্যাব। এ সময় র‍্যাবকে লক্ষ্য করে গুলি ছোড়ে জঙ্গিরা। আত্মরক্ষার্থে র‍্যাবও পাল্টা গুলি ছোড়ে। একপর্যায়ে রোহিঙ্গা ক্যাম্পের আস্তানা থেকে জামায়াতুল আনসার ফিল হিন্দাল শারক্বিয়ার শীর্ষ নেতা, শূরা সদস্য ও সামরিক শাখার প্রধান, তার সহযোগী বোমা বিশেষজ্ঞকে অস্ত্র ও গোলা-বারুদসহ গ্রেপ্তার করে র‍্যাব। এ সময় বিদেশি একটি অস্ত্র, দেশি দুটি অস্ত্র, তিনটি ম্যাগাজিন, ১১২ রাউন্ড গুলি ও আড়াই লাখ টাকা উদ্ধার করা হয়।’

র‍্যাবের আইন ও গণমাধ্যম শাখার পরিচালক কমান্ডার খন্দকার আল মঈন বলেন, ‘গত আগস্টে কুমিল্লার আট তরুণ হিজরতের নামে আত্মগোপনে চলে যায়। তখন তাদের খুঁজতে গিয়ে নতুন জঙ্গি সংগঠন জামায়াতুল আনসার ফিল হিন্দাল শারক্বিয়ার খোঁজ পায় র‍্যাব। এরপর সেপ্টেম্বরের মাঝামাঝিতে বেশ কয়েকজনকে গ্রেপ্তার করা হয়। এরই ধারাবাহিকতায় ২০ অক্টোবর বান্দরবানে অভিযান চালিয়ে ওই জঙ্গি সংগঠনের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ ব্যক্তি মানিককে গ্রেপ্তার করা হয়। মূলত তার তথ্যের ভিত্তিতে সংগঠনের ৪৮ সদস্যকে গ্রেপ্তার করেছে র‍্যাব।’

জঙ্গিরা কেন রোহিঙ্গা ক্যাম্প এলাকায় আস্তানা গড়েছে এমন প্রশ্নের জবাবে খন্দকার আল মঈন বলেন, ‘তারা কেন রোহিঙ্গা ক্যাম্প এলাকায় এলো, তাদের সঙ্গে রোহিঙ্গাদের যোগসূত্র কী, তা খুঁজে বের করবে র‍্যাব। একইসঙ্গে তাদের সংগঠনে কারা কারা রয়েছে তাদের গ্রেপ্তার করা হবে।’

খন্দকার আল মঈন আরও বলেন, ‘গত ২১ অক্টোবর গ্রেপ্তারকৃতদের বিরুদ্ধে বিলাইছড়ি থানায় সন্ত্রাস দমন আইনে মামলা করা হয়। গ্রেপ্তারকৃত সাতজনের মধ্যে জামায়াতুল আনসার ফিল হিন্দাল শারক্বিয়ার সামরিক শাখার উপ-প্রধান সৈয়দ মারুফ আহমেদ মানিক ছিল। মানিকসহ পাঁচজনের ছয় দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেছিলেন আদালত। তাদের জিজ্ঞাসাবাদ করে সংগঠনের সামরিক শাখার প্রধানের অবস্থান সম্পর্কে তথ্য পাওয়া যায়। ওই তথ্যের ভিত্তিতে দেশের বিভিন্ন স্থানে অভিযান চালায় র‍্যাব।’

র‍্যাব সূত্র আরও জানায়, জঙ্গিবাদে জড়িয়ে গত দুই বছরে বাড়িছাড়া ৫৫ তরুণের খোঁজ পায় র‍্যাব। তাদের মধ্যে ৩৮ জনের একটি তালিকা প্রকাশ করা হয়। এরমধ্যে আবুল বাশার নামে একজনের নাম ছিল। বাশার সামরিক শাখার প্রধান রনবীরের সহযোগী ও বোমা বিশেষজ্ঞ। গ্রেপ্তারের পর জিজ্ঞাসাবাদে বাশার র‍্যাবকে জানায়, গত ৩ অক্টোবর যৌথ অভিযান শুরুর পর ৫৫ জনের দল থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পাহাড় থেকে পালিয়ে সিলেটে সামরিক শাখার প্রধানের কাছে সে আশ্রয় নেয়। কয়েক দিন আগে সামরিক শাখার প্রধান রনবীরের সঙ্গে রোহিঙ্গা ক্যাম্পে আত্মগোপন করে বাশার।

উখিয়ার কুতুপালংয়ের রাজাপালং ৯নং ওয়ার্ডের ইউপি সদস্য হেলাল উদ্দিন বলেন, আমরা দেখতে পাচ্ছি এরইমধ্যে রোহিঙ্গা ক্যাম্পে রোহিঙ্গাদের অভ্যন্তরীণ বিভিন্ন ধরনের সংঘর্ষ হয়েছে। সন্ত্রাসী গ্রুপ ক্যাম্পে কাজ করছে। নতুন একটা বিষয় দেখলাম সেটি হচ্ছে, ক্যাম্পে জঙ্গি সংগঠন আশ্রয় নিয়ে তারা তাদের কার্যক্রম চালাচ্ছে। তিনি বলেন, র‍্যাব একটি প্রশংসনীয় অভিযান চালিয়েছে। আশা করব, এ ধরনের সাঁড়াশি অভিযানের মাধ্যমে ক্যাম্পে যারা এরকম সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড করার জন্য পরিকল্পনা করেছে তাদের আটক করার মাধ্যমে রোহিঙ্গা ক্যাম্প সন্ত্রাসমুক্ত করবে।

উখিয়ার হলদিয়াপালং ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান ইমরুল কায়েস চৌধুরী বলেন, রোহিঙ্গা ক্যাম্পে শীর্ষ জঙ্গি সংগঠনের যে দুজন প্রধান নেতা গ্রেপ্তার হয়েছে সেটি আমাদের এই অঞ্চলের জন্য খুবই উদ্বেগের বিষয়। আমরা দীর্ঘদিন ধরে বলে আসছিলাম রোহিঙ্গা ক্যাম্পগুলাতে নজরদারি বাড়ানোর জন্য এবং সেখানে যৌথ অভিযান চালানোর জন্য। যে জঙ্গিরা ধরা পড়েছে তাদের নিশ্চয়ই ডালপালা এই রোহিঙ্গা ক্যাম্পের মধ্যে আছে। তাদের অনুসারীরাও এ রোহিঙ্গা ক্যাম্পের মধ্যে আছে। আমাদের দাবি থাকবে, এ রোহিঙ্গা ক্যাম্পে যৌথ অভিযান চালিয়ে যে জঙ্গি সংগঠন এবং যে সন্ত্রাসীরা রয়েছে তাদের এখান থেকে নির্মূল করার জন্য। তা না হলে যে কোনো সময় কিন্তু তারা কক্সবাজার অঞ্চলে বড় ধরনের দুর্ঘটনা ঘটাতে পারে।

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত