ঢাকা ২০ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ৫ আশ্বিন ১৪৩১ | বেটা ভার্সন

প্রস্তাব ও নির্দেশনায় তিন দিনের সম্মেলন শেষ

সুষ্ঠু নির্বাচনের বার্তা নিয়ে গেলেন ডিসিরা

সুষ্ঠু নির্বাচনের বার্তা নিয়ে গেলেন ডিসিরা

মাঠপর্যায়ে সরকারের প্রতিনিধি হিসেবে কাজ করেন জেলা প্রশাসক। সেজন্য জেলা প্রশাসক সম্মেলনে ডিসিদের প্রস্তাব ও মন্ত্রণালয়ের নির্দেশনা গুরুত্ব দেয়া হয়। তবে এবারের ডিসি সম্মেলন অন্যান্য বছরের তুলনায় একটু ভিন্ন ছিল। কারণ সব ঠিক থাকলে আগামী বছরের জানুয়ারির প্রথম সপ্তাহে দ্বাদশ জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। ফলে নির্বাচনের আগে মন্ত্রণালয়, অধিদপ্তর ও বিভিন্ন সংস্থার দায়িত্বশীলদের সঙ্গে হয়তো এটিই ডিসিদের শেষ সম্মেলন। আগামীতে সুষ্ঠু নির্বাচন উপহার দিতে ডিসিদের সচেষ্ট থাকার কথা বলা হয়েছে।

সংশ্লিষ্টরা বলেছেন, দেশের রাষ্ট্র প্রশাসনের গুরুত্বপূর্ণ ধাপ ও সরকারের নির্বাচনি ইশতেহার বাস্তবায়নের দায়িত্বে থাকেন ডিসিরা। সেজন্য জেলা প্রশাসকদের সম্মেলনে জাতীয় সংসদ নির্বাচন নিয়ে প্রস্তুতি নেবার পাশাপাশি আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রাখার বিষয়ে ডিসিদের প্রস্তুত হওয়ার জন্য পরামর্শ দিয়েছেন সরকারের মন্ত্রীরা। কারণ নির্বাচন সুষ্ঠু করতে তাদের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে হবে। নির্বাচনকালীন সময়ে স্থানীয় পর্যায়ে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর পূর্ণাঙ্গ ক্ষমতা ডিসিদের হাতে ন্যস্ত থাকবে। ভোট গ্রহণের সময়ে যেসব কেন্দ্রে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি হবে সে ক্ষেত্রে তাৎক্ষণিক যে কোন ব্যবস্থা গ্রহণ করতে পারবেন ডিসিরা। সেদিক থেকে দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন ডিসিদের কাছে বড় চ্যালেঞ্জের।

বিএনপি ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ সরকারের পরিবর্তে নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে নির্বাচনের জন্য ধারাবাহিক আন্দোলনের কর্মসূচি পালন করে আসছে। তবে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ ইতোমধ্যেই জানিয়েছে যে নির্বাচন সংবিধান অনুযায়ী অর্থাৎ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন সরকারের অধীনেই অনুষ্ঠিত হবে। বিএনপির দাবি পূরণ না হওয়ায় ২০১৪ সালের নির্বাচন তারা বর্জন করেছিল আর ২০১৮ সালের নির্বাচনে অংশ নিলেও নির্বাচনের পর তারা ব্যাপক কারচুপির অভিযোগ তুলেছিল। নির্বাচন নিয়ে অনিয়ম ও আওয়ামী লীগের জয় নিশ্চিত করতে জেলা প্রশাসক ও পুলিশ সুপারদের একটি অংশের সমালোচনাও করে আসছে বিএনপিসহ আরও কিছু রাজনৈতিক দল। নির্বাচন আয়োজনের দায়িত্ব নির্বাচন কমিশনের হলেও কমিশন সংসদ নির্বাচনের ক্ষেত্রে জনপ্রশাসনের ওপরই নির্ভর করে থাকে এবং নির্বাচনে জেলা প্রশাসকরাই মাঠপর্যায়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে আসছেন। এই প্রেক্ষাপটে এবারের জেলা প্রশাসক সম্মেলনে অংশ নিতে আসা জেলা প্রশাসকদের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী নির্বাচনের জন্য প্রস্তুত হওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে কয়েকজন জেলা প্রশাসক বলেছেন, আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন সুষ্ঠু করতে আমাদের সতর্ক থাকতে বলা হয়েছে। যাতে নির্বাচনের সময় আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি না ঘটে। সেজন্য আগেভাগেই আইনশৃঙ্খলার বিষয়ে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সতর্ক করেছেন। আসলে কে নির্বাচন করলো বা কে করলো না সেটি তো জেলা প্রশাসকের ব্যাপার না। জেলা প্রশাসক নির্বাচন কমিশন যেভাবে চায় সেভাবে কাজ করবে। এবারের ডিসি সম্মেলনে সামাজিক অপরাধ নিয়ন্ত্রণ, খাদ্য উৎপাদন বৃদ্ধি, জনসন্তুষ্টি অর্জন, বাজার মনিটরিং এবং জনগণকে সরকারি সেবা প্রধানসহ জেলা প্রশাসকদের ২৫ দফা দিক নির্দেশনা দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এছাড়াও আইন, বিচার ও সংসদ বিষয়ক, স্বরাষ্ট্র, তথ্য ও সম্প্রচার, দুর্নীতি দমন কমিশন ছাড়াও বিভিন্ন মন্ত্রণালয় ও অধিদপ্তরের শীর্ষ কর্মকর্তারা ডিসিদের উদ্দেশ্যে বেশ কিছু নির্দেশনা দিয়েছেন।

রাজধানীর ওসমানী স্মৃতি মিলনায়তনে ২৪ জানুয়ারি হতে ২৬ জানুয়ারি পর্যন্ত চলে ডিসি সম্মেলন। এতে ৬৪ জেলার ডিসিসহ দেশের ৮ বিভাগের বিভাগীয় কমিশনাররাও অংশগ্রহণ করেন। সরকারের নীতিনির্ধারক ও জেলা প্রশাসকদের মধ্যে সামনাসামনি মতবিনিময় এবং প্রয়োজনীয় দিকনির্দেশনা দেয়ার জন্য সাধারণত প্রত্যেক বছর ডিসি সম্মেলন আয়োজন করা হয়। কার্য অধিবেশনগুলোয় মন্ত্রণালয় ও বিভাগের প্রতিনিধি হিসেবে মন্ত্রী, উপদেষ্টা, প্রতিমন্ত্রী, উপমন্ত্রী, সিনিয়র সচিব ও সচিবরা উপস্থিত ছিলেন। গত বছরের মতো এবারও স্থানীয় পর্যায়ে সরকারের উন্নয়ন কার্যক্রম বাস্তবায়নের অগ্রগতি, আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি, আর্থসামাজিক উন্নয়নসহ মাঠপ্রশাসনে আরও ক্ষমতা চেয়েছেন ডিসিরা। তারা ২৪৫টি প্রস্তাব মন্ত্রিপরিষদ বিভাগে জমা দেন। সবচেয়ে বেশি সংখ্যক প্রস্তাব স্বাস্থ্যসেবা বিভাগ সংক্রান্ত ২৩টি, ভূমি মন্ত্রণালয় সংশ্লিষ্ট ১৫টি, পানিসম্পদ মন্ত্রণালয় ১৩টি, সুরক্ষাসেবা বিভাগ ১১টি, গৃহায়ণ ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয় ১০টি প্রস্তাব এসেছে।

ডিসিরা যা চাইলেন : জেলা-উপজেলায় সরকারি হাসপাতালের ব্যবস্থাপনা কমিটির প্রধান স্থানীয় সংসদ সদস্যরা। কমিটিতে পদাধিকার বলে জেলা প্রশাসক (ডিসি) সহ-সভাপতি। এরপরও ডিসি-ইউএনওকে সভাপতি করে জেলা ও উপজেলায় স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনা কমিটি গঠনের প্রস্তাব দেন গোপালগঞ্জের ডিসি কাজী মাহবুবুল আলম। প্রস্তাবের পক্ষে তিনি যুক্তি দেন- বিদ্যমান কমিটির পাশাপাশি ডিসি এবং ইউএনওর নেতৃত্বে স্বাস্থ্য কমিটি গঠিত হলে সার্বিক স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনা বিষয়ে নিয়মিত সমন্বয় ও মনিটরিং কার্যক্রম পরিচালনা সম্ভব হবে। গোপালগঞ্জের ডিসির মতো মাঠ প্রশাসনে নিজেদের ক্ষমতা আরো বাড়ানোর লক্ষ্যে এ ধরনের অনেক প্রস্তাব দেন ডিসিরা। যেমন সরকারি রাজস্ব প্রশাসনের উন্নয়ন বরাদ্দে ডিসিদের আয়ন-ব্যয়নের ক্ষমতা দেয়ার প্রস্তাব করেন পটুয়াখালীর ডিসি মো. শরিফুল ইসলাম। প্রস্তাবের পক্ষে যুক্তি তুলে ধরে তিনি বলেন, বিভিন্ন উপজেলা সহকারী কমিশনার (ভূমি) অফিস ও ইউনিয়ন ভূমি অফিস নির্মাণ করছে গণপূর্ত ও এলজিইডি বিভাগ। এসব কাজের প্রকল্প গ্রহণ, প্রাক্কলন প্রস্তুত, অনুমোদন, টেন্ডার প্রক্রিয়া ও বাস্তবায়ন কোনোটির সঙ্গেই ডিসি বা তার প্রতিনিধি রাখা হয় না। তাদের খেয়ালখুশিমতো প্রকল্প প্রস্তুত করে নিজেদের মতো করে বাস্তবায়ন করে থাকেন।

সংশ্লিষ্ট বিভাগ থেকে কাঙ্ক্ষিত মনিটরিংও নেই। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে নির্ধারিত সময়ে প্রকল্প বাস্তবায়নে ব্যর্থ হন তারা। সংশ্লিষ্ট ঠিকাদার কাজ শেষ না করলেও শতভাগ বিল পায়। আবারো প্রকল্প রিভাইজ করে সরকারের অর্থ অপচয় করা হয়। এছাড়া খাসজমি বন্দোবস্তের কবুলিয়ত দলিল বাতিলের ক্ষমতা চেয়ে প্রস্তাব দেন জয়পুরহাটের ডিসি সালেহীন তানভীর গাজী। ডিসির এল এ কন্টিনজেন্সি খাতের ব্যয়ের আর্থিক ক্ষমতা বাড়ানোর প্রস্তাব করেছেন ময়মনসিংহের ডিসি মোস্তাফিজুর রহমান। বিভিন্ন বিষয় নিয়ে মোট ২৪৫টি প্রস্তাব দেন ডিসিরা।

ডিসিদের প্রস্তাবের পাশাপাশি সম্মেলনে মন্ত্রীদের বেশ কিছু নির্দেশনা উঠে এসেছে। সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য জাতীয় নির্বাচন উপহার দিতে জেলা প্রশাসকদের (ডিসি) প্রস্তুত থাকার নির্দেশ দিয়ে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান বলেন, আমরা বলেছি, একটি সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন, যেটা দেশবাসী চাইছে, সারা বিশ্বও সেদিকে তাকিয়ে আছে। একটি সুষ্ঠু নির্বাচন করার জন্য আপনাদের ভূমিকাই মুখ্য হবে। সে জন্য আপনারা তৈরি থাকুন, যাতে একটি সুষ্ঠু নির্বাচন উপহার দিতে পারেন।

তথ্য ও সম্প্রচারমন্ত্রী ড. হাছান মাহমুদ বলেছেন, জেলা পর্যায়ে অনিবন্ধিত অনলাইন, আইপিটিভি, ইউটিউব চ্যানেলের মাধ্যমে গুজব ছড়ানো হলে, তা দ্রুত তথ্য মন্ত্রণালয়কে জানানোর নির্দেশ দেয়া হয়েছে ডিসিদের। সেই সঙ্গে গুজবটি যে গুজব, তা তুলে ধরার জন্য সত্য তথ্য প্রকাশের নির্দেশও দেয়া হয়েছে। জনপ্রশাসন প্রতিমন্ত্রী ফরহাদ হোসেন বলেন, সারা দেশে ১৭০০ প্রকল্প রয়েছে। এসব প্রকল্প যাতে নির্বাচনের আগেই শেষ করা যায়, সে ব্যাপারে তৎপর থেকে কাজ করার নির্দেশনা দেয়া হয়েছে ডিসিদের। সরকারের নির্বাচনী ইশতেহার বাস্তবায়নে ডিসিদের ভূমিকা রয়েছে। সেগুলো পালন করতে হবে।

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত