উদ্বেগজনক পর্যায়ে রাজধানীর বায়ুদূষণ

জনস্বাস্থ্যকে ঠিক রেখে উন্নয়ন কর্মকাণ্ড করতে হবে : আইপিডি

প্রকাশ : ২৯ জানুয়ারি ২০২৩, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ

  নিজস্ব প্রতিবেদক

সরকারি পর্যায়ে যথাযথ উদ্যোগের অভাবে রাজধানীসহ আশপাশের এলাকার বায়ু দূষণ ক্রমাগতভাবে উদ্বেগজনক পর্যায়ে উপনীত হয়েছে। নগর পরিকল্পনা ও উন্নয়নের দর্শনে পরিবেশকে পেছনে ঠেলে দিয়ে উন্নয়নের যে চিত্র আঁকা হচ্ছে, সেখান থেকে রাষ্ট্রীয় সংস্থাসমূহকে পরিবেশ সমুন্নত রেখেই উন্নয়নের কৌশল ঠিক করতে হবে। গতকাল শনিবার ইনস্টিটিউট ফর প্ল্যানিং এন্ড ডেভেলপমেন্ট (আইপিডি) অনলাইনে আয়োজিত ‘রাজধানীর বিপর্যস্ত বায়ু : নগরায়নের বিদ্যমান প্রেক্ষিত ও করণীয়’ শীর্ষক ‘আইপিডি নগরায়ন ও উন্নয়ন বিষয়ক পর্যালোচনা’ অনুষ্ঠানে বিশেষজ্ঞরা এসব কথা বলেন। বিশেষজ্ঞরা বলেন, নগর এলাকাসহ সারা দেশে অবকাঠামো, ভবন নির্মাণসহ যাবতীয় উন্নয়ন কর্মকাণ্ডে যথাযথ মানদণ্ডে প্রকল্প ব্যবস্থাপনাসহ বায়ু দূষণরোধে প্রয়োজনীয় তদারকি ও জবাবদিহি নিশ্চিত করতে হবে।

আইপিডি বলেছে, আমাদের সামগ্রিক জনস্বাস্থ্য, পরিবেশ ও জীববৈচিত্র্য রক্ষার্থে নীরব ঘাতক বায়ু দূষণের বিদ্যমান ক্রান্তিজনক অবস্থাকে স্বীকার করে নিয়ে বায়ু ও পরিবেশ দূষণের মতো অপরাধকে জনস্বাস্থ্যগত অপরাধ বিবেচনায় নিয়ে পরিবেশ আইনের প্রয়োজনীয় সংশোধনী এনে যথাযথ দণ্ড ও শাস্তির বিধান প্রণয়ন করা দরকার। পাশাপাশি দূষণের সাথে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি, গোষ্ঠী ও প্রতিষ্ঠানকে দ্রুত আইনের আওতায় নিয়ে আসা প্রয়োজন। আইপিডি’র পক্ষ থেকে আরো বলা হয়, ঢাকা ও এর আশেপাশের এলাকার জলাভূমি ভরাট এবং সবুজ এলাকা ও সবুজায়ন কমে যাওয়া, নিয়ন্ত্রণহীণ অবকাঠামো ও ভবন নির্মাণ, নগর ও পরিবেশের ভারবহন ক্ষমতার মাত্রাতিরিক্ত জনসংখ্যা, অবকাঠামো ও উন্নয়ন কর্মকাণ্ড, পার্ক-উদ্যান-খেলার মাঠে প্রাকৃতিক পরিবেশ ধ্বংস করে দিয়ে কংক্রীটনির্ভর উন্নয়ন প্রকল্প গ্রহণ, যানবাহনের নিয়ন্ত্রণহীন গতি প্রভৃতি কারণে বায়ু দূষণ নিয়ন্ত্রণহীন মাত্রায় চলে গিয়েছে। সড়ক খনন নীতিমালার কোনো প্রয়োগ নেই; পরিবেশ আইন, বিধিমালা ও নীতিমালার প্রতিপালন করবার ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট সংস্থাসমূহের ভূমিকা অতি দুর্বল। প্রভাবশালীরা আইনের ঊর্ধ্বে থেকে গিয়ে ব্যবসা বা শিল্প-কারখানা স্থাপন করে পরিবেশকে উপেক্ষা করে নির্বিচারে বায়ু দূষণ করে যাচ্ছে।

অনুষ্ঠানের মূল প্রবন্ধে আইপিডি’র নির্বাহী পরিচালক অধ্যাপক ড. আদিল মুহাম্মদ খান বলেন, নিয়ন্ত্রণহীণ ধূলা, যানবাহনের ধোঁয়া ও ফিটনেসবিহীন গাড়ির অবাধ চলাচল, মোটরসাইকেলসহ ব্যক্তিগত গাড়ির সংখ্যার মাত্রাতিরিক্ত বৃদ্ধি, ইটভাটার ধোঁয়া, সড়কের নিয়ন্ত্রণহীণ খোঁড়াখুড়ি, অবকাঠামো ও মেগা প্রজেক্টের নির্মাণযজ্ঞ, শিল্পকারখানার ধোঁয়া ও বর্জ্য, কঠিন বর্জ্যের অব্যবস্থাপনা ও বর্জ্য পোড়ানো, প্রভৃতি কারণে ঢাকা ও এর আশপাশের এলাকার বায়ু দূষণ ক্রমাগত বেড়েই চলেছে, শুষ্ক মৌসুমে যার প্রভার থাকে সবচেয়ে বেশি।

অনুষ্ঠানে আইপিডি উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. আকতার মাহমুদ বলেন, ঢাকার চেয়েও নারায়ণগঞ্জ এলাকার বায়ুমান বিপদজনক মাত্রাকে আরো বেশি ছাড়িয়ে গেছে, পুরো জানুয়ারী মাসেই যা গড়ে প্রতিদিন বায়ুমান সূচক (একিউআই) ৪০০ বা তার চেয়ে বেশি ছিল। ঢাকাসহ নারায়ণগঞ্জ ও গাজীপুর এলাকার বায়ুদূষণ জনস্বাস্থ্যের জন্য মারাত্মক হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে। কার্যকর ক্লিন এয়ার আইন করতে আমরা কেন ব্যর্থ হলাম, কারা এই আইন করতে দেয়নি- এই বিষয়গুলোর জবাব নীতি নির্ধারকদের দিতে হবে। বায়ু দূষণ রোধ করতে কার্যকর নগর ও প্রকল্প ব্যবস্থাপনার উপর গুরুত্বারোপ করেন তিনি।

আইপিডি পরিচালক মোহাম্মদ আরিফুল ইসলাম বলেন, বায়ূ দূষণে শুধু স্বাস্থ্যগত বিপর্যয়ই নয়, এতে আমাদের অর্থনৈতিক উন্নয়ন বাধাগ্রস্ত হয় ও জিডিপি কমে যায়। বায়ু দূষণ কমাতে নগর এলাকায় অনাচ্ছাদিত এলাকায় ল্যা-স্কেপিং ও সবুজায়নের পাশাপাশি এলাকাভিত্তিক বায়ুরমান নিয়মিত তদারকির উপর জোর দেন তিনি।

জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশ বিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক মো. জামালউদ্দিন বলেন, বায়ু দূষণের কারণে বাংলাদেশের মানুষের গড় আয়ু ৭ থেকে ৮ বছর কমে যাচ্ছে। বায়ূ দূষণকে এইডসের মতো প্রাণঘাতী রোগের চেয়ে ও ভয়ঙ্কর মন্তব্য করে তিনি বলেন, সর্বোচ্চ পর্যায়ের রাজনৈতিক সদিচ্ছা ছাড়া বায়ু দূষণ কমানো সম্ভবপর হবে না।

কানাডার সেন্ট মেরি বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশ বিষয়ক গবেষক মো. মনিরুজ্জামান বলেন, বাংলাদেশের ঢাকার পাশাপাশি রাজশাহী, খুলনার বায়ু দূষণের মাত্রা ও উদ্বেগজনক। সারা বাংলাদেশে মাত্র ১১টা পয়েন্টে রাষ্ট্রীয়ভাবে বায়ুমান পরিমাপ করা হচ্ছে, যা বায়ু দূষণ নিয়ন্ত্রণে বিজ্ঞানভিত্তিক গবেষণা ও কর্মপদ্ধতি নির্ধারণে অপ্রতুল উল্লেখ করে তিনি এগুলোর সংখ্যা বাড়ানোর পরামর্শ দেন।

বাপার যুগ্ম সম্পাদক মারুফ হোসেন বলেন, বায়ু দূষণ নিয়ন্ত্রণে সরকারি বিভিন্ন অবকাঠামো নির্মাণ প্রকল্পে উদাহরণ তৈরি করবার সুযোগ রয়েছে। শীতাতপ নিয়ন্ত্রণ যন্ত্রের মাত্রাতিরিক্ত ব্যবহারের কারণে গ্রীণ হাউস গ্যাস নির্গত হয়ে দূষণ বাড়ছে বলে মন্তব্য করেন তিনি। বায়ু ও পরিবেশ দূষণ নিয়ন্ত্রণে সাধারণ মানুষের গণআন্দোলন কেন দিনে দিনে স্তিমিত হয়ে যাচ্ছে, তার কারণ অনুসন্ধান করে দূষণের বিরুদ্ধে জনমত গড়ে তোলে নীতিনির্ধারকদের উপর চাপ বাড়ানোর পরামর্শ দেন তিনি।

পরিবেশ বিশেষজ্ঞ ড. ফরহাদুর রেজা বলেন, বায়ু দূষণের কারণে আমাদের আকাশের উপরিভাগে ‘ডাস্ট ডোম লেয়ার’ তৈরি হচ্ছে, যা আমাদের জন্য দীর্ঘমেয়াদে স্বাস্থ্য ঝুঁকির কারণ হতে পারে। জাপানের মতো দেশে উন্নত প্রযুক্তি ও কঠোর নজরদারির মাধ্যমে বর্জ্য থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদন করা হয়। আমাদের দেশের এই ধরনের উদ্যোগের সক্ষমতার অভাবে বর্জ্য থেকে বিদ্যুৎ তৈরির উদ্যোগে পরিবেশ দূষণ আরো বাড়তে পারে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করেন এই বিশেষজ্ঞ।