ঢাকা ২০ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ৫ আশ্বিন ১৪৩১ | বেটা ভার্সন

রাতের রাজধানী কার নিয়ন্ত্রণে?

রাতের রাজধানী কার নিয়ন্ত্রণে?

গভীর রাতের পর থেকে ভোর পর্যন্ত রাজধানী ঢাকায় বেড়েছে খুন-ছিনতাই ও নৈরাজ্য। অরক্ষিত নগরীতে অনিরাপদ হয়ে পড়ে পথচারী ও নগরবাসী। এমন পরিস্থিতিতে খোদ পুলিশও মধ্যরাতের পর রাজধানীতে চলাফেরা সীমিত করার জন্য অনুরোধ জানিয়েছে। মধ্যরাতের পর ভোরের দিকে রাজধানীতে চলাচল নিরাপদ নয় উল্লেখ করে ডিএমপির একজন পদস্থ কর্মকর্তা বলেছেন, দেশের অন্যান্য জেলা থেকে যারা ঢাকায় আসবেন, দিনের আলো ফোটার পর গন্তব্যের দিকে রওনা করবেন। এটা যাত্রীদের প্রতি অনুরোধ রইল। এতে প্রশ্ন দেখা দিয়েছে, তাহলে রাজধানীর আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি কোন পর্যায়ে। রাতের রাজধানী কার নিয়ন্ত্রণে?

সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন মাধ্যমে তথ্য সংগ্রহ করে দেখা যায়, মধ্যরাতের পর রাজধানী ঢাকার বিভিন্ন এলাকা ছিনতাইকারী ও মাদকসেবী দুর্বৃত্তদের নিয়ন্ত্রণে চলে যায়। রাত জেগে টানা দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে ক্লান্তিতে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা যখন ঘুমকাতর হয়ে উঠেন এবং নগরীর বাসিন্দারা ঘুমিয়ে পড়েন তখন রাজধানীর অপরাধপ্রবণ এলাকা দাপিয়ে বেড়ায় এসব দুর্বৃত্ত। রাজপথ হয়ে ওঠে তাদের অভয়ারণ্য। মাদকসেবী আর ছিনতাইকারীদের দখলে চলে যায় ঢাকার বিভিন্ন এলাকা। মধ্যরাতের পর জরুরি কাজের প্রয়োজনে রাজপথে বের হলে সর্বস্ব খোয়ানোর ঝুঁকি তো আছেই, এমনকি খুন বা গুরুতর আহত হবেন না- এমন নিশ্চয়তাও নেই। রাজধানী ঢাকা মহানগরীর ৫০টি থানা এলাকার ২ শতাধিক স্পটে অন্তত অর্ধশতাধিক সংঘবদ্ধ ছিনতাইকারী দলের ৩ শতাধিক সদস্য বেপরোয়া রয়েছে বলেও জানা গেছে। প্রতিমাসে গড়ে ২০টির বেশি বড় ধরনের ছিনতাইয়ের ঘটনা ঘটছে রাজধানীতে। হচ্ছে খুন ও মারাত্মক জখমের মতো ঘটনাও। পুলিশ এসব ঘটনায় ছিনতাইকারীদের সম্পৃক্ততার কথা বলে আসছে। অভিযান চালানোর দাাবি করলেও দৃশ্যত এসব ঘটনা বন্ধ হচ্ছে না।

ফলে জনমনে আতঙ্ক দেখা দিয়েছে। প্রশ্ন উঠেছে প্রায় আড়াই কোটি রাজধানীবাসীর নিরাপত্তা দিতে পুলিশ ব্যর্থ হলে সরকারের স্মার্ট বাংলাদেশ গঠন কীভাবে ত্বরান্বিত হবে।

সম্প্রতি (গত ২২ জানুয়ারি) রাত সাড়ে ৩টায় রাজধানীর গোলাপবাগ ফুটপাতে ছুরিকাঘাতে খুন হন খলু মিয়া (২৮) নামে এক যুবক। তিনি সেদিন গ্রামের বাড়ি গাইবান্ধা থেকে একটি পরিবহণে করে রাত আনুমানিক ৩টার দিকে গোলাপবাগে পৌঁছান। বাস থেকে নেমে রাস্তায় পায়ে হেঁটে পরবর্তী গন্তব্যে যাওয়ার সময় ছুরিকাঘাতের শিকার হন তিনি। পরে তাকে এক অটোরিকশা চালক উদ্ধার করে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতালে নিলে ডাক্তার মৃত ঘোষণা করেন। ঢামেক পুলিশ ক্যাম্প সূত্রে ভোরে যাত্রাবাড়ী থানা পুলিশ জানতে পেরে ঢামেকে যায়। পরে থানা পুলিশ ঘটনাস্থলে পৌঁছে রক্তাক্ত স্থানটি দেখতে পায়। ঘটনাস্থলের সিসিটিভি ফুটেজ বিশ্লেষণে দেখা যায়, ভিকটিম গোলাপবাগ থেকে পায়ে হেঁটে ধলপুর কমিউনিটি সেন্টারের সামনে দিয়ে যাওয়ার সময় ওৎ পেতে থাকা অজ্ঞাতনামা কয়েকজন ভিকটিমকে উপর্যুপরি ছুরিকাঘাত করে দৌড়ে পালিয়ে যায়। ভিকটিমের কাছে প্রাপ্ত জিনিসপত্র ও প্রযুক্তিগত সহায়তায় জানা যায়, ভিকটিমের নাম খলু মিয়া (২৮)। তিনি নারায়ণগঞ্জের রূপসী এলাকায় গার্মেন্ট কর্মী হিসেবে কর্মরত ছিলেন। ওই ঘটনায় গত শনিবার খুনি হিসেবে একজনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। পুলিশ দাবি করেছে এ খুনের ঘটনা ঘটেছে ছিনতাইকে কেন্দ্র করে।

তবে রাজধানীতে এমন ঘটনা নতুন নয়। এর আগেও বিভিন্ন এলাকায় পথচারীরা খুনের শিকার হয়েছেন। অধিকাংশ ঘটনায় পুলিশ দাবি করে সেগুলো ছিনতাইয়ের ঘটনায় খুন হয়েছে। গত বছরের মার্চের ২৭ তারিখ ভোরে রাজধানীর শেওড়াপাড়ায় ছুরিকাঘাতে ‘গরীবের চিকিৎসক’ হিসেবে পরিচিত ডা. আহমেদ মাহী বুলবুল নিহত হন। পুলিশ ও স্থানীয় সূত্রে জানা গিয়েছে- ভোর সাড়ে ৫টার দিকে শেওড়াপাড়ার বাসা থেকে নোয়াখালী যাওয়ার জন্য রওনা হলে দুর্বৃত্তের ছুরিকাঘাতে তিনি গুরুতর আহত হন এবং পরে হাসপাতালে নেয়া হলে চিকিৎসক তাকে মৃত ঘোষণা করেন। এ ঘটনায়ও পুলিশ দাবি করেছে খুনিরা ছিনতাইকারী।

এদিকে ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) মামলার উপাত্ত বিশ্লেষণ করে দেখা যায়- রাজধানীতে অপরাধ বেড়েছে। বেশি বেড়েছে খুন, চুরি, ডাকাতি, দস্যুতা ও মাদকসংক্রান্ত অপরাধ। অবশ্য কমেছে নারী ও শিশু নির্যাতনের ঘটনা। যদিও নারী ও শিশু নির্যাতনের ঘটনার সংখ্যা এখনো উদ্বেগজনক।

মামলার উপাত্ত বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, রাজধানীতে গত বছরে বিভিন্ন অপরাধে মামলা হয়েছে ২৮ হাজার ৭৪৯টি, যা আগের বছরের চেয়ে ১৫ শতাংশ বেশি। বিভিন্ন অপরাধে গ্রেপ্তার হয়েছেন ৬১ হাজার ৪৯৪ জন। সংখ্যাটি আগের বছর ছিল ৫০ হাজারের মতো।

২০২২ সালে খুন হয়েছেন ১৭৩ জন। ২০২১ সালে সংখ্যাটি ছিল ১৫২। চুরির ঘটনায় মামলার সংখ্যা বেড়েছে ২৮ শতাংশ। ছিনতাইয়ের ঘটনায় মামলা হয়েছে ১০৩টি। দস্যুতার ঘটনা ঘটেছে ১৪৫টি, আগের বছর দস্যুতার ঘটনা ছিল ১৩৪টি।

সাধারণ চুরি ও ছিনতাইয়ের ঘটনায় অধিকাংশ ক্ষেত্রে ভুক্তভোগীরা থানায় মামলা করার ঝক্কিতে যেতে চান না। ফলে মামলার সংখ্যা দিয়ে প্রকৃত চিত্র বোঝা যায় না। মামলার যে চিত্র উঠে এসেছে, তাকেই উদ্বেগজনক বলে মনে করেছেন অপরাধ বিশেষজ্ঞরা।

খুন বেশি ওয়ারী ও মিরপুরে : রাজধানীর অপরাধ নিয়ন্ত্রণে ৫০টি থানাকে ৮টি অপরাধ বিভাগে ভাগ করে কাজ করে ডিএমপি। বিভাগগুলো হলো রমনা, লালবাগ, ওয়ারী, মতিঝিল, তেজগাঁও, মিরপুর, গুলশান ও উত্তরা। এই আট বিভাগের মধ্যে সবচেয়ে বেশি খুনের ঘটনা ঘটেছে ওয়ারী বিভাগে, ৩৭টি। এ ছাড়া মিরপুরে ৩১টি, গুলশান ও মতিঝিলে ২১টি করে, উত্তরা ও লালবাগে ১৭টি করে, রমনায় ১৬টি এবং তেজগাঁও বিভাগে ১৩টি খুনের ঘটনা ঘটে।

শুধু ২০২২ সাল নয়, আগের বছরগুলোর অপরাধপ্রবণতা বিশ্লেষণে দেখা যায়, ওয়ারী বিভাগ ও মিরপুরে খুনের ঘটনা বেশি ঘটে। ডিএমপির কর্মকর্তারা বলছেন, যেসব এলাকায় ভাসমান মানুষ বেশি বাস করে এবং ঘনবসতিপূর্ণ, সেসব এলাকায় খুনের ঘটনা বেশি ঘটে। ওয়ারী বিভাগের মধ্যে রয়েছে ডেমরা, যাত্রাবাড়ী, শ্যামপুর, গেন্ডারিয়া, কদমতলী ও ওয়ারী থানা।

২০২২ সালে ঢাকায় রাজনৈতিক খুনের ঘটনা ঘটেছে তিনটি- মতিঝিল, ওয়ারী ও গুলশানে। আগের বছর কোনো রাজনৈতিক খুনের ঘটনা ঘটেনি।

নারী ও শিশু নির্যাতন শ্রেণিতে ডিএমপি ধর্ষণ, অ্যাসিড নিক্ষেপ এবং অন্যান্য নারী ও শিশু নির্যাতনের অপরাধে মামলা হয়েছে ২ হাজার ১২টি, যা আগের বছরের চেয়ে ৫০টি কম। ধর্ষণের ঘটনা ঘটেছে ৪৯৭টি, যা আগের বছরের চেয়ে ১৯টি কম।

২০২২ সালে সবচেয়ে বেশি মামলা হয়েছে মাদকসংশ্লিষ্ট অপরাধে। ২০২২ সালে মাদকের মামলা হয়েছে ১৬ হাজার ৩৫টি, যা মোট মামলার ৫৬ শতাংশ।

গত ১৮ আগস্ট রাজধানীতে ছিনতাইয়ের শিকার হয়ে অর্থসহ জরুরি কাগজপত্র হারিয়েছেন যুগান্তরের অপরাধ বিভাগের জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক সিরাজুল ইসলাম। উত্তরার হযরত শাহজালাল বিমানবন্দরের পাশে র‍্যাব-১ দপ্তরের সামনে ছিনতাইকারীর কবলে পড়েন সিরাজুল ইসলাম।

তিনি জানান- এ সময় তার মানিব্যাগ ছিনিয়ে নেয় ছিনতাইকারীরা। মানিব্যাগে ২ হাজার টাকা, দুটি ব্যাংকের এটিএম কার্ড, ড্রাইভিং লাইসেন্সসহ মোটরসাইকেলের অন্যান্য জরুরি কাগজপত্র, অফিস আইডিসহ গুরুত্বপূর্ণ ডকুমেন্ট ছিল। এ ঘটনায় উত্তরা পূর্ব থানায় একটি অভিযোগ করেছেন সিরাজ। তবে সেটার কোনো সুরাহা পাননি তিনি। দৈনিক যুগান্তরের আরেক সাংবাদিক ইকবাল হাসান ফরিদও সম্প্রতি ছিনতাইয়ের শিকার হন ডিউটি শেষে ঢাকা থেকে সাভার বাসায় যাবার পথে।

একটি জাতীয় দৈনিক গণমাধ্যমে কর্মরত রাজনৈতিক বিটের সাংবাদিক রাহাত হোসাইন বলেন- মধ্যরাতে রাজধানীর বিভিন্ন মোড়ে সন্দেহজনক দুর্বৃত্ত শ্রেণির লোকজনের আনাগোনা বেড়েছে। ছিনতাইয়ের ঘটনাও বেড়েছে। এর ফলে বাসায় ফেরার সময় বেশ নিরাপত্তাহীনতায় থাকি।

এদিকে সম্প্রতি ছিনতাইয়ের সময় ছুরিকাঘাতে একজন নিহতের ঘটনায় গতকাল একজনকে গ্রেপ্তারের তথ্য দেন ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) অতিরিক্ত কমিশনার (অপরাধ ও অভিযান) একেএম হাফিজ আক্তার।

এসময় তিনি বলেন, ‘প্রতিটি খুনের ঘটনার রহস্য উদ্?ঘাটনে আমরা গুরুত্ব দিচ্ছি। দু-একটি ঘটনা ছাড়া প্রায় সব ঘটনার রহস্য উদ্?ঘাটিত হয়েছে। তবে এসময় তিনি ভোরের দিকে রাজধানীতে চলাচল নিরাপদ নয় উল্লেখ করে বলেছেন, যারা দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে বাসযোগে ঢাকায় আসেন, তারা সাধারণত মধ্যরাতের পর এসে পৌঁছান। সেই সময়টা ঢাকা অনেকটাই অরক্ষিত থাকে। ফলে তারা বাস থেকে নেমে বাসায় যাবার সময় ফাঁকা রাস্তায় ছিনতাইকারীর কবলে পড়েন। এতে ছিনতাইকারীর হাতে অনেকের প্রাণহানি ঘটে। এ অবস্থা থেকে পরিত্রাণের জন্য তিনি ভোররাতে বাস থেকে নেমে বাসায় না যাবার অনুরোধ করেন।

ডিএমপির শীর্ষস্থানীয় এ কর্মকর্তা বলেন, ঢাকা মহানগরীর অরক্ষিত এলাকাগুলোতে চেকপোস্ট বাড়ানো হয়েছে। পুলিশের টহল আরও বাড়ানো হয়েছে, যাতে মধ্যরাতে বা ভোরে যাত্রীরা নিরাপদে বাসায় পৌঁছতে পারে। তারপরও যারা ভোররাতে বাস থেকে নামেন তাদের অনুরোধ, একটু সকাল হলে বাসার দিকে গেলে ভালো হয়।

এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, শহরে অপরাধ বেড়ে গেলে পুলিশের পক্ষ থেকে বিশেষ অভিযান চালানো হয়। তবে কেবল আইন প্রয়োগকারী সংস্থার পক্ষে একা অপরাধীদের দমন সম্ভব নয়। এজন্য জনগণের সতর্ক থাকা দরকার।

অতিরিক্ত কমিশনার একেএম হাফিজ আক্তার আরও বলেন, ঢাকা শহরটি ২৪ ঘণ্টায় কর্মব্যস্ত থাকে। দিনের বেলায় যেমন অফিস পাড়া থাকে, অফিসে সবাই ব্যস্ত থাকে। রাতের ঢাকায় ব্যাপক হারে ট্রাক ঢুকে। কাঁচাবাজারে বিভিন্ন পণ্য যারা বিক্রি করে সেখানে বাজার খুবই সক্রিয় থাকে। আর যারা বাসে, ট্রেনে, লঞ্চে করে রাতে ঢাকার বাইরে থেকে আসে, তখন অপরাধীরা সক্রিয় হয়ে উঠে।

তিনি বলেন, অপরাধটা যারাই করুক আমাদের প্রথম কাজটি হলো ঘটনা ও অপরাধীকে চিহ্নিত করা। আমরা একটা তালিকা তৈরি করছি, এদেরকে সবসময় নজরদারিতে রাখলে অপরাধ কমে যায়। চুরি বলেন আর ছিনতাই বলেন তাদেরকে ব্যাপক হারে গ্রেপ্তার করতে পারলে অনেকদিন কম থাকে। যখন তারা আবার বেরিয়ে আসে তখন আবার ঘটনা বেড়ে যায়।

তিনি আরও বলেন, অপরাধের যে প্রক্রিয়া সেটি শুধু পুলিশিং দিয়েই একদম নির্মূল করা বিশ্বের কোথাও নাই। কারাগারে গিয়ে সংশোধন বা অন্য কোনো পেশায় যাবে সেটাও হচ্ছে না। একটা এলাকা থেকে কয়েকটা এরকম যদি ধরে ফেলি তাহলে সে এলাকা অনেক দিনের জন্য ঠান্ডা থাকে। এরপর তারা জেল থেকে বেরিয়ে হয়তো জায়গা পরিবর্তন করে। সামনের দিনগুলোতে যদি আমরা উন্নয়নের দিকে আরো অগ্রসর হতে পারি এবং তাদের কর্মসংস্থানের মাধ্যমে পেশা যদি পরিবর্তন করা যায় তাহলে অপরাধটা কমিয়ে আনতে পারব।

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত