গ্যাসের দামবৃদ্ধির চাপে শিল্পোদ্যোক্তারা

* গ্যাসের দাম বাড়ানোর ব্যাখ্যা দিল সরকার * দাম পুনর্নির্ধারণের দাবি এফবিসিসিআইয়ের

প্রকাশ : ৩১ জানুয়ারি ২০২৩, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ

  নিজস্ব প্রতিবেদক

গ্যাসের দাম বাড়ানোর বিরোধিতা করে আসছে দেশের শিল্পোদ্যোক্তারা। কারণ গ্যাসের দাম বাড়ায় উৎপাদন খরচ বেড়েছে, যা শিল্পের প্রতিযোগিতা সক্ষমতা কমিয়ে দিয়েছে। এতে শিল্প, বিদ্যুৎ ও বাণিজ্যিক খাতে বড় ধরনের চাপের মুখে পড়ছে। ব্যবসায়ীদের চাপ গিয়ে পড়ছে জনগণের কাঁধে। তবে গ্যাসের দাম বাড়ানোর ব্যাখ্যা দিয়েছে জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয়। এই মন্ত্রণালয়ের তথ্য কর্মকর্তা মীর মোহাম্মদ আসলাম উদ্দিন স্বাক্ষরিত বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, বৈশ্বিক বিশেষ জ্বালানি পরিস্থিতিতে ও রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের পরিপ্রেক্ষিতে বিশ্বব্যাপী সব ধরনের জ্বালানির মূল্যে অস্থিতিশীলতা বিরাজ করছে। এ ছাড়া জ্বালানি সংশ্লিষ্ট অন্য ব্যয়, যেমন বিমা খরচ, ঝুঁকি ব্যয়, ব্যাংক সুদ, মার্কিন ডলারের বিপরীতে টাকা দুর্বল হওয়ায় সামগ্রিকভাবে জ্বালানি খাতে ব্যয় ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে। তারই ধারাবাহিকতায় বিশ্ববাজারে এলএনজি আমদানি মূল্যও অস্বাভাবিক পরিমাণে বেড়ে যাওয়ায় এ খাতে সরকারকে বিপুল পরিমাণ অর্থ ভর্তুকি বাবদ প্রদান করতে হচ্ছিল। গত বছরের জুলাই থেকে স্পট মার্কেট থেকে এলএনজি আমদানি বন্ধ রয়েছে। এ প্রেক্ষাপটে বিদ্যমান উৎপাদন/সরবরাহ সক্ষমতা বিবেচনায় নিয়ে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে বিদ্যুৎ, ক্যাপটিভ বিদ্যুৎ ও শিল্পসহ সব খাতে গ্যাস রেশনিং করা হচ্ছে। চলতি বছরের ১৮ জানুয়ারি গ্যাসের দাম বাড়িয়ে প্রজ্ঞাপন জারি করে জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ বিভাগ।

এতে দেখা যায়, বৃহৎ শিল্পে প্রতি ইউনিট গ্যাসের দাম ১১ টাকা ৯৮ পয়সা থেকে বাড়িয়ে ৩০ টাকা করা হয়েছে। অর্থাৎ, দাম বেড়েছে প্রায় তিনগুণ। শিল্পে উৎপাদিত নিজস্ব বিদ্যুৎ কেন্দ্রের (ক্যাপটিভ) জন্য ইউনিট প্রতি গ্যাসের দাম ১৬ টাকা থেকে বাড়িয়ে ৩০ টাকা করা হয়েছে। সারকারখানায় ব্যবহৃত গ্যাসের দাম ১৬ টাকা (ইউনিট প্রতি) অপরিবর্তিত থাকছে। মাঝারি শিল্পে ব্যবহৃত গ্যাসের দাম ১১ টাকা ৭৮ পয়সা থেকে বাড়িয়ে ৩০ টাকা করা হয়েছে। ক্ষুদ্র ও কুটিরশিল্পে ব্যবহৃত গ্যাসের দাম ১০ টাকা ৭৮ পয়সা থেকে বাড়িয়ে ৩০ টাকা করা হয়েছে। চা বাগানের ক্ষেত্রে দাম ১১ টাকা ৯৩ পয়সা অপরিবর্তিত থাকছে। হোটেল ও রেস্তোরাঁ খাতে ব্যবহৃত বাণিজ্যিক শ্রেণির গ্রাহকরা ফেব্রুয়ারি থেকে প্রতি ইউনিটে দাম দেবেন ৩০ টাকা ৫০ পয়সা। আগে তারা দিচ্ছিলেন ২৬ টাকা ৬৪ পয়সা। গ্যাসের দাম ফের বাড়ার আশঙ্কা করছেন ব্যবসায়ীরা।

বিদ্যুৎ ও গ্যাসের দাম বাড়ানোর মধ্যেই গত রোববার জাতীয় সংসদে সরকারকে প্রজ্ঞাপন জারি করে বিদ্যুৎ, গ্যাস ও তেলের দাম বাড়ানো বা কমানোর ক্ষমতা দিয়ে ‘বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশন (সংশোধন) আইন, ২০২৩’ বিল পাস হয়েছে। বর্তমান প্রক্রিয়ায় ট্যারিফ কমিশনের মাধ্যমে গণশুনানি করে বিদ্যুৎ ও গ্যাসের ট্যারিফ সমন্বয় (মূল্যবৃদ্ধি) এবং প্রচলিত আইনে বর্ণিত প্রক্রিয়ায় মূল্য নির্ধারণে সময় বেশি লাগে বলে দ্রুততম সময়ে ট্যারিফ সমন্বয়ের লক্ষ্যে সরকারের ক্ষমতা সংরক্ষণের জন্য আইনটি সংশোধন করা হয়েছে।

দেশের ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন এফবিসিসিআইয়ের সভাপতি মো. জসিম উদ্দিন বলেছেন, বিশ্ববাজারে জ্বালানির দাম বাড়ছে। এটি আমরাও বুঝি। এ কারণে আমরাও দাম বাড়ানোর পক্ষে। কিন্তু গ্যাসের দাম অসহনীয় হলে সবাই ক্ষতিগ্রস্ত হবো। এই সময়েই জ্বালানিতে ভর্তুকি বাড়ানো দরকার। এই সেক্টরে রাজস্ব আদায়েও সমন্বয় জরুরি। তিনি বলেন, এফবিসিসিআইয়ের পক্ষ থেকে আমরা জ্বালানি উপদেষ্টা ও প্রতিমন্ত্রীর সঙ্গে বৈঠক করি। ব্যবসায়ীরা গ্যাসের মূল্য ১৬ টাকার জায়গায় ২৫ টাকা করার প্রস্তাব দেই। সরকার করলো ৩০ টাকা এবং সেটা সবার জন্যই নির্ধারণ করা হলো। অথচ ইন্ডাস্ট্রির ধরন ও আকার অনুযায়ী গ্যাসের মূল্যের পার্থক্য ছিল। এখন সবার ওপর একই মূল্য নির্ধারণ করা হয়েছে।

এফবিসিসিআইয়ের সভাপতি আরও বলেন, সরকারের নির্ধারিত মূল্য বহাল থাকলে বিদ্যুতের দামও বাড়াতে হবে। কারণ বিদ্যুতের কাঁচামালও গ্যাস। তখন পরিস্থিতি আরও খারাপ হবে। এ কারণেই আমরা অনুরোধ করছি গড়ে ৫৭ শতাংশ বর্ধিত মূল্যের বেশি যেন না করা হয়। একই সঙ্গে নিরবচ্ছিন্ন সরবরাহ নিশ্চিত করতে হবে।

বাংলাদেশ পোশাক রপ্তানিকারক ও মালিক সমিতির (বিজিএমইএ) সভাপতি ফারুক হাসান বলেন, সব কিছুর দাম এরই মধ্যে বেড়ে গেছে। জ্বালানির বাজার অস্থির। জ্বালানির দাম বাড়ানোর কারণে আমাদের পরিবহণ ব্যয় বেড়ে গেছে। তার মানে ব্যয় বাড়ার কারণে আমরা এমনিতেই প্রতিযোগিতায় পিছিয়ে আছি। গ্যাসের দাম বাড়লে প্রতিযোগিতায় আরও পিছিয়ে যাবো। উৎপাদন ব্যয় বাড়লে পণ্যের দাম বাড়াতে হবে। বেশি দামে ক্রেতা পণ্য কিনতে চাইবে না, এটিই স্বাভাবিক। এর প্রভাব সর্বত্রই পড়বে। ভোক্তা অধিকার সংগঠন ক্যাব বলেছে, অযৌক্তিকভাবে ব্যয় বৃদ্ধি করে সেই ব্যয়কে অজুহাত হিসাবে দেখিয়ে দামটা বাড়ানো হচ্ছে। দেখভালের দায়িত্বে থাকা প্রতিষ্ঠানগুলোও এখানে অকার্যকর।

বাংলাদেশ টেক্সটাইল মিলস অ্যাসোসিয়েশন বিটিএমএর সভাপতি মোহাম্মদ আলী খোকন বলেন, গ্যাসের মূল্যবৃদ্ধি নিয়ে আমাদের আপত্তি আছে। অন্যদের না বাড়িয়ে কেবল শিল্প খাতে দাম বাড়াতে গিয়ে শিল্পের উপর প্রভাব বেশি পড়ে যাচ্ছে। হঠাৎ করে এভাবে ২০০ শতাংশ মেনে নেয়া যায় না। বাড়ানোটা সহনীয় হতে হবে। ভ্যাট ট্যাক্স কমালেও ইউনিট প্রতি দাম ২০ টাকার মধ্যে রাখা যেত। ক্যাবের জ্বালানি উপদেষ্টা শামসুল আলম মনে করেন, জ্বালানি সংক্রান্ত সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোর দীর্ঘদিনের অনিয়ম ও দুর্নীতির ফলে বেড়ে যাওয়া ব্যয়ের ভার জনগণের ওপর চাপাতে গ্যাসের মূল্যবৃদ্ধির এধরনের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।

বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতে ভোক্তার অধিকার রক্ষায় সরব এই অধ্যাপক মনে করেন, মূল্যবৃদ্ধির সমালোচনা করার আগে ব্যয়বৃদ্ধির অন্যায্য উদ্যোগগুলো প্রতিরোধে আন্দোলন গড়ে তোলা প্রয়োজন। এলএনজি আমদানি, দেশীয় গ্যাসের উৎপাদন ব্যয়, দেশের অভ্যন্তরে আন্তর্জাতিক গ্যাস উত্তোলন প্রতিষ্ঠানগুলো (আইওসি), দেশীয় কোম্পানির উৎপাদন ব্যয়, ভ্যাট, ট্যাক্স, কোম্পানিগুলোর মুনাফা, সঞ্চালন, অবকাঠামো নির্মাণ হতে শুরু কবে পুরো সরবরাহ প্রক্রিয়ায় অতিরিক্ত ব্যয় হচ্ছে বলে দাবি করেন ক্যাবের উপদেষ্টা।