ঢাকা ২০ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ৫ আশ্বিন ১৪৩১ | বেটা ভার্সন

আইএমএফের ৪৭০ কোটি ডলারের ঋণ অনুমোদন

অর্থনৈতিক কূটনৈতিক সাফল্যে নতুন ডানা

অর্থনৈতিক কূটনৈতিক সাফল্যে নতুন ডানা

অবশেষে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) নির্বাহী পর্ষদ বাংলাদেশকে ৪.৭ বিলিয়ন (৪৭০ কোটি) ডলার ঋণ দেয়ার প্রস্তাব অনুমোদন দিয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের রাজধানী ওয়াশিংটন ডিসিতে গত সোমবার রাতে আইএমএফের বোর্ডের সভায় এ ঋণ অনুমোদন করা হয়। ঋণ অনুমোদনের বিষয়টি নিশ্চিত করেন অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল। আইএমএফের এ ঋণ অনুমোদনকে অর্থনৈতিক কূটনৈতিক সাফল্য বলে মনে করছেন অর্থনীতিবিদরা। তারা বলেন, এ ঋণটার প্রয়োজন ছিল। এ ঋণের ফলে বাংলাদেশের বৈদেশিক মুদ্রার চাহিদা ও সরবরাহের পার্থক্য কমবে। সামষ্টিক অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা রক্ষা, কম আয়ের মানুষের আয়বর্ধক কাজে সহায়তা এবং অন্তর্ভুক্তিমূলক ও জলবায়ু পরিবর্তনজনিত অভিঘাত মোকাবিলার সক্ষমতা বৃদ্ধিতে এ ঋণ কাজে আসবে। সামাজিক সংস্কার ও উন্নয়নমূলক ব্যয়ে সক্ষম আর্থিক তৈরিতে সহায়তা করবে। তাছাড়া আর্থিক খাত শক্তিশালীকরণ, নীতি কাঠামো আধুনিকীকরণ এবং জলবায়ু স্থিতিস্থাপকতা তৈরি হবে।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ডেভেলপমেন্ট স্টাডিজের (বিআইডিএস) সাবেক মহাপরিচালক, অর্থনীতিবিদ ড. মোস্তফা কে মুজেরি গতকাল আলোকিত বাংলাদেশকে বলেন, ‘দেশে বৈদেশিক মুদ্রার ঘাটতি মেটাতে আইএমএফের এ ঋণটার প্রয়োজন ছিল। এ ঋণ বৈদেশিক মুদ্রার চাহিদা ও সরবরাহের পার্থক্য কমাবে। ফরেন রিজার্ভে যে চাপ পড়েছে তা স্বল্প সময়ের জন্য কিছুটা হলেও সহায়তা করবে।’ ড. মোস্তফা কে মুজেরি বলেন, এ ঋণ ম্যাক্রো ইকোনমিতে ম্যানেজমেন্ট, বিশেষ করে বৈদেশিক খাতের ম্যানেজমেন্টে যথেষ্ট সহায়তা করবে। তিনি বলেন, আমাদের নীতিগুলো যদি ফলপ্রসূ যেমন- রেমিট্যান্স, রপ্তানি আয়, অপ্রয়োজনীয় ও কম প্রয়োজনীয় পণ্য আমদানি সামলে রাখা যায় তবে বৈদেশিক মুদ্রার ওপর যে চাপ আছে তা কাটিয়ে উঠতে সক্ষম হবে দেশ।

এদিকে অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল গত সোমবার রাতে তার বিবৃতিতে বলেন, ‘আমরা অবশ্যই আইএমএফের প্রতি এ ঋণের জন্য কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করছি। বিশেষ করে আইএমএফের উপব্যবস্থাপনা পরিচালক (ডিএমডি) আন্তোয়নেত মনসিও সায়েহ এবং মিশনপ্রধান রাহুল আনন্দসহ যে দলটি এ ঋণের বিষয়ে বাংলাদেশ সফর করেছিল, তাদের প্রতি জানাই ধন্যবাদ ও কৃতজ্ঞতা। বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর আব্দুর রউফ তালুকদার এবং অর্থ বিভাগের সিনিয়র সচিব ফাতিমা ইয়াসমিনসহ অর্থ মন্ত্রণালয়ের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা, যারা এ ঋণ কর্মসূচি নিয়ে কাজ করেছেন, তাদের প্রতিও রইল আমার কৃতজ্ঞতা।’

অর্থমন্ত্রী আরও বলেন, ‘অনেকেই সন্দেহ পোষণ করেছিলেন যে, আইএমএফ হয়তোবা আমাদের এ ঋণ দেবে না। তারা ভেবেছিল, আমাদের সামষ্টিক অর্থনীতির মৌলিক এলাকাগুলো দুর্বল, তাই আইএমএফ এ ঋণ প্রদান থেকে বিরত থাকবে। এ ঋণ অনুমোদনের মাধ্যমে এটাও প্রমাণিত হলো যে, আমাদের সামষ্টিক অর্থনীতির মৌলিক এলাকাগুলো শক্ত ভিতের ওপরে দাঁড়িয়ে আছে এবং অন্যান্য অনেক দেশের তুলনায় ভালো।’ এই ঋণ মঞ্জুরির মধ্য দিয়ে বাংলাদেশের অর্থনীতির সক্ষমতার প্রকাশ ঘটেছে বলে মনে করেন অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল।

জানা গেছে, বাংলাদেশ আইএমএফ থেকে ৪৭০ কোটি ডলারের যে ঋণ চেয়েছে, এর মধ্যে তিন ধরনের ঋণ রয়েছে। এগুলো হলো- বর্ধিত ঋণ সহায়তা (ইসিএফ), বর্ধিত তহবিল সহায়তা (ইএফএফ) ও রেজিলিয়েন্স অ্যান্ড সাসটেইনেবিলিটি ফ্যাসিলিটি (আরএসএফ)। ইসিএফ ও ইএফএফ থেকে পাওয়া যাবে ৩৩০ কোটি ডলার। আরএসএফ থেকে পাওয়া যাবে ১৪০ কোটি ডলার। এই ঋণ পাওয়া যাবে ৪২ মাসে সাত কিস্তিতে। ঋণের গড় সুদের হার ২ দশমিক ২ শতাংশ। আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) ঋণ বাংলাদেশের সামষ্টিক অর্থনীতির স্থিতিশীলতা রক্ষায় সহায়তা করবে। একইসঙ্গে বাংলাদেশ সরকার যে সংস্কার কর্মসূচি হাতে নিয়েছে, তা বাস্তবায়নেও সহায়তা করবে এই ঋণ।

আইএমএফের বিবৃতিতে বলা হয়েছে, ৪২ মাসে এ ঋণ ছাড় করা হবে। প্রথম কিস্তিটি চলতি মাসেই পাওয়া যাবে। ঋণের গড় সুদের হার ২ দশমিক ২ শতাংশ। এর আগে গত ১৬ জানুয়ারি আইএমএফের উপব্যবস্থাপনা পরিচালক অ্যান্তইনেত মনসিও সায়েহ তার ঢাকা সফরের সময় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে সৌজন্য সাক্ষাৎ করেন। সেদিন তাদের মধ্যে ঋণের বিষয়টি নিয়ে আলোচনা হয়। বাংলাদেশকে এই ঋণ দিতে গত নভেম্বরে ঢাকায় কর্মকর্তা পর্যায়ের বৈঠকে প্রাথমিক সমঝোতায় পৌঁছায় আইএমএফ। সেই ঋণচুক্তির শর্তসহ খুঁটিনাটি চূড়ান্ত করার প্রক্রিয়ার মধ্যেই বাংলাদেশ সফর করেন আইএমএফ এর উপব্যবস্থাপনা পরিচালক।

২০২২ সালের ২৪ জুলাই ঋণ চেয়ে আইএমএফের কাছে চিঠি দেয় বাংলাদেশ। এতে পরিমাণের কথা উল্লেখ ছিল না। পরে ১২ অক্টোবর ওয়াশিংটনে বিশ্বব্যাংক-আইএমএফের বার্ষিক সম্মেলনে যোগ দিয়ে গভর্নর আব্দুর রউফ তালুকদার ৪৫০ কোটি ডলারের ঋণসহায়তার কথা উল্লেখ করেন। আইএমএফের উপব্যবস্থাপনা পরিচালক (ডিএমডি) অ্যান্তইনেত মনসিও সায়েহ সংস্থাটির প্রেস বিজ্ঞপ্তিতে এ কথা বলেন। তিনি বলেন, বৈশ্বিক অর্থনৈতিক প্রতিকূলতার মধ্যে আরও টেকসই ও অন্তর্ভুক্তিমূলক প্রবৃদ্ধি অর্জন করতে সরকারকে তার উচ্চাভিলাষী সংস্কার কার্যক্রমের গতি বাড়াতে হবে। ২০৩১ সালের মধ্যে উচ্চমধ্যম আয়ের দেশ হতে গেলে মানবসম্পদ ও অবকাঠামো খাতে আরও বিপুল বিনিয়োগ করতে হবে। একই সঙ্গে টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা (এসডিজি) অর্জনেও তা জরুরি। তারা বলেছে, বাংলাদেশ সরকার এসব চ্যালেঞ্জ সম্পর্কে ওয়াকিবহাল এবং একই সঙ্গে জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব মোকাবিলার প্রয়োজনীয়তা সম্পর্কেও বাংলাদেশ অবগত। অ্যান্তইনেত মনসিও সায়েহ বলেন, রাজস্ব খাতে সংস্কার করলে বাংলাদেশ সামাজিক খাত, উন্নয়ন ও জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলায় ব্যয় বৃদ্ধি করতে পারবে। তবে সে জন্য কর নীতি ও রাজস্ব প্রশাসন- উভয় খাতেই হাত দিতে হবে। রাজস্ব সংস্কার হলে সরকারি অর্থায়ন, বিনিয়োগ ও ঋণ ব্যবস্থাপনা উন্নত হবে। এতে সরকারের ব্যয় সক্ষমতা ও স্বচ্ছতা বাড়বে এবং শাসনব্যবস্থা উন্নত হবে। আইএমএফের উপব্যবস্থাপনা পরিচালক (ডিএমডি) আরও বলেন, আর্থিক খাতের দুর্বলতা কমলে, নিয়ন্ত্রণব্যবস্থা উন্নত করা হলে ও পুঁজিবাজারের উন্নতি করা গেলে প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে প্রয়োজনীয় অর্থায়ন করা সম্ভব হবে। এ ছাড়া প্রবৃদ্ধির সম্ভাবনা বৃদ্ধি করতে কাঠামোগত সংস্কার প্রয়োজন বলে মনে করেন আইএমএফের ডিএমডি। সে জন্য দরকার, বাণিজ্য ও প্রত্যক্ষ বিদেশি বিনিয়োগ বৃদ্ধির সহায়ক পরিবেশ তৈরি, মানবসম্পদ উন্নয়ন ও শাসনব্যবস্থার উন্নয়ন।

সরকার ও বাংলাদেশ ব্যাংক কী সংস্কারে হাত দিয়েছে, যাতে আইএমএফ সমর্থন করছে, আইএমএফের ডিএমডির ঢাকা সফরের সময় এ বিষয়ে জানতে চাওয়া হলে জানা যায়, ভর্তুকি কমাতে জ্বালানি তেল ও বিদ্যুতের দাম বাড়িয়েছে সরকার। এরপর গ্যাসের মূল্যবৃদ্ধি করা হয়। রিজার্ভের গণনাপদ্ধতি আইএমএফের চাওয়া অনুযায়ী করা হচ্ছে এবং জ্বালানি তেলের দাম মাসে মাসে সমন্বয় করার ঘোষণাও দিয়েছে সরকার। ঋণ আলোচনা চূড়ান্ত করতে ১৪ জানুয়ারি পাঁচ দিনের সফরে দেশে আসেন আইএমএফের উপব্যবস্থাপনা পরিচালক (ডিএমডি) অ্যান্তইনেত মনসিও সায়েহ। তখন তিনি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল, বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর আবদুর রউফ তালুকদারের সঙ্গে বৈঠক করেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বক্তব্যও দেন তিনি।

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত