ঢাকা ২০ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ৫ আশ্বিন ১৪৩১ | বেটা ভার্সন

মশার উৎপাতে অতিষ্ঠ রাজধানীবাসী

* বছরে ডেঙ্গুতে ২৮১ জনের মৃত্যু, * মশা নিধনে ফগিং কার্যকর নয় : কীটতত্ত্ববিদ, * মশকনিধন কার্যক্রম চলছে : সিটি করপোরেশন
মশার উৎপাতে অতিষ্ঠ রাজধানীবাসী

মশার কামড় থেকে নগরবাসীকে রেহাই দিতে বিভিন্ন উদ্যোগ নিয়েছে ঢাকা দুই সিটি করপোরেশন। তবে সংস্থা দুটির বেশকিছু উদ্যোগের পরও মশার কামড় থেকে রেহাই পাচ্ছে না রাজধানীবাসী। অথচ প্রতিবছর মশকনিধনে যথেষ্ট অর্থ খরচ করছে সিটি করপোরেশন।

কীটতত্ত্ববিদরা বলছেন, মশা নিয়ন্ত্রণে আশানুরূপ ফল পাওয়া যাচ্ছে না। এতে মশার কামড়ের যন্ত্রণা সারা বছরই কমবেশি আলোচনায় থাকছে। একই সঙ্গে সিটি করপোরেশনের মশকনিধন উদ্যোগ নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে।

দুই সিটির কয়েকটি ওয়ার্ড সরেজমিন ঘুরে দেখা গেছে, দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের আওতাধীন লালবাগকেল্লা, আজিমপুর, বকশিবাজার, নবাবপুর এলাকায় মশার উপদ্রবের তুলনায় নতুন ওয়ার্ড সারুলিয়া, ডেমরা, ঠুলঠুলিয়া, মা-া খালপাড়, যাত্রবাড়ী মাতুয়াইলে মশার উপদ্রব বেশি। উত্তর সিটি করপোরেশনের গুলশান, মহাখালী, বনানী, তেজগাঁও ও বাড্ডা এলাকায় মশার উপদ্রব কম থাকলেও ভাষানটেক বাজার, খিলক্ষেত, উত্তর খান, দক্ষিণখানের ফায়দাবাদ ও কামারপাড়া এলাকার মানুষ মশার কামড়ে অতিষ্ঠ হয়ে পড়েছেন।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বছরজুড়েই রাজধানীতে মশার উপদ্রব থাকছে। তবে যখন মশা বাড়ে, তখন হইচই হয়, আবার মশা কিছুটা কমলেই আলোচনা থেমে যায়। ঠিক একইভাবে সিটি করপোরেশন বিক্ষিপ্তভাবে মশানিধন কার্যক্রম চালাচ্ছে। তবে মশা নিয়ন্ত্রণে পুরো কার্যক্রমে সমন্বিত ব্যবস্থাপনা (ইন্টিগ্রেটেড ভেক্টর ম্যানেজমেন্ট) গড়ে তোলা দরকার। এতে মশার প্রজননস্থল কমবে, মশা নিয়ন্ত্রণে লার্ভিসাইড (লার্ভা মারার ওষুধ) এবং মশা নিয়ন্ত্রণে জনগণকে সম্পৃক্ত করতে হবে।

ঢাকা উত্তর ও দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের মশক নিয়ন্ত্রণের বাজেট প্রতি বছরই বাড়ে এবং ২০২২-২৩ অর্থবছরে দুই সিটি কর্পোরেশন বরাদ্দ রেখেছে ১৪৭ কোটি টাকা, যেখানে উত্তর সিটিতে বরাদ্দ ১০১ কোটি টাকা এবং ঢাকা দক্ষিণে বরাদ্দ ৪৫ কোটি ৭৫ লাখ কোটি টাকা। মশা নিধনে সিটি করপোরেশনে বছরে বছরে বাজেট বাড়লেও মশা নিয়ন্ত্রণে আশানুরূপ ফল পায়নি নগরবাসী।

কিউলিক্স মশার পাশাপাশি এডিস মশার আতঙ্কে রয়েছে মানুষ। কারণ দেশের ইতিহাসে ২০২২ সালে ডেঙ্গুতে সবচেয়ে বেশি মৃত্যু হয়েছে। ওই বছর ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে ২৮১ জন মারা গেছেন। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের রোগনিয়ন্ত্রণ শাখার হিসাব বলছে, এর মধ্যে ৬৭ জন শিশু, তাদের বয়স ১৮ বছরের নিচে। আর সদ্য বিদায়ি জানুয়ারিতে ডেঙ্গুতে ৬ জনের মৃত্যু হয়েছে।

রোগনিয়ন্ত্রণ শাখার হিসাবে, গত বছর আক্রান্ত ব্যক্তিদের ২৪ শতাংশও ছিল শিশু। গত বছর আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছিলেন ৬২ হাজার ৩৮২ জন। এর মধ্যে শিশুর সংখ্যা ছিল ১৪ হাজার ৯৭২।

মশা নিধনের কার্যক্রম নিয়ে দুই সংস্থার স্বাস্থ্য বিভাগের কর্মকর্তারা বলছেন, ঢাকায় মশার অন্যতম প্রজননস্থল বাংলাদেশ রোড ট্রান্সপোর্ট করপোরেশনের (বিআরটিসি) বাস ডিপো, থানায় রাখা পুরোনো গাড়ি, সিভিল এভিয়েশনের আওতাধীন এলাকা, নির্মাণাধীন ভবন, ফাঁকা প্লট ও জমে থাকা পুরোনো টায়ার। এরই মধ্যে ফাঁকা প্লট মালিকদের নির্দেশনা দেয়া হয়েছে প্লটে ময়লা-আবর্জনার ভাগাড় যাতে না হয়। অনেক প্লট মালিক নিজ থেকেই প্লট পরিষ্কার করছেন, আবার যারা পরিষ্কার করেনি তাদের বিরুদ্ধে জরিমানার ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছে। মশার প্রজনন বন্ধে আবাসন ব্যবসায়ীদের সংগঠন রিহ্যাব, ঢাকা মহানগর পুলিশ, সিভিল এভিয়েশন কর্তৃপক্ষের সঙ্গে সমন্বয় সভা করা হয়েছে।

যত্রতত্র ময়লা আবর্জনা ফেলার কারণে মশা বৃদ্ধি পেয়েছে বলে অভিযোগ করেছেন যাত্রাবাড়ী এলাকার বাসিন্দারা। সড়কের পাশে ময়লা-আবর্জনা ফেলা হচ্ছে। নালা নর্দমায় অপরিষ্কার পানি জমে থাকা, নিয়মিত পরিষ্কার না করায় মশার বিস্তার চরম আকার ধারণ করেছে বলে মনে করেন তারা।

মাতুয়াইল এলাকার গৃহিণী জাহানারা আহমেদ বলেন, কয়েক দিন ধরে মশার উৎপাত বেড়েছে। কয়েল জ্বালিয়েও কোনো লাভ হচ্ছে না। মশার যন্ত্রণায় তার সন্তানরা ঠিকমতো লেখাপড়া করতে পারছে না। মশানিধন কার্যক্রম চালাতে সিটি করপোরেশনের কাছে অভিযোগ করায় গত বুধবার মাতুয়াইলের আমানসিটিতে মশকনিধন কর্মীরা ওষুধ ছিঁটায়।

উত্তর সিটি করপোরেশনের কামারপাড়া এলাকার বাসিন্দা মুসলিম মিয়া বলেন, মশার কামড়ে কোথাও বসার সুযোগ নেই। বাসায় বসে থাকলেও দিনে-রাতে মশা কামড়ায়। সেজন্য কয়েল জ্বালিয়ে মশা তাড়াতে হয়, দু’এক মিনিট কয়েল না জ্বালালে মশা কামড়ায়। মাঝে মাঝে সিটি করপোরেশনের লোকজন ফগার মেশিন দিয়ে ধোঁয়া দিয়ে যায়। ধোঁয়া কমে গেলেই সেই আগের মতোই মশা কামড়ানো শুরু করে। মশা যেমন ছিল, ঠিক তেমনই থাকে। ময়লা-আবর্জনা পরিষ্কার না করে শুধু ফগিং করা হয়। এ জন্য মশার উপদ্রব কমছে না বলে মনে করেন তিনি।

বাড্ডার একাধিক বাসিন্দা বলেন, মশা মারা নিয়ে মশকরা অনেক হয়েছে। মানুষ এখন মশার কাছে জিম্মি। মশার উপদ্রবে দিনে মশারি টাঙিয়ে ঘুমাতে হয়। মশার যন্ত্রণায় অতিষ্ঠ হয়ে পড়েছি। জিহাদুল ইসলাম বলেন, উত্তরার পথঘাটের কোথাও দাঁড়াতে পারি না মশার কারণে। হাত-পাসহ শরীরের বিভিন্ন স্থানে মশা এমনভাবে কামড়ায় যেন মনে হয় শরীরে পিঁপড়া কামড়াচ্ছে। মশার জ্বালায় টেকা যায় না।

মশা নিয়ন্ত্রণের বিষয়ে কীটতত্ত্ববিদ ও জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক ড. কবিরুল বাশার আলোকিত বাংলাদেশকে বলেছেন, দীর্ঘদিন ধরে মশক নিয়ন্ত্রণে সমন্বিত নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থার কথা বলে আসছি। কারণ সমগ্র বিশ্বে সমন্বিতভাবে খুব সহজেই মশক নিয়ন্ত্রণ করা হয়ে থাকে। তিনি আরও বলেন, বাংলাদেশে ১২৩ প্রজাতির মশার রেকর্ড রয়েছে। তার মধ্যে বর্তমানে ঢাকায় প্রায় ১৪ প্রজাতির মশা দেখা যায়। মশার প্রতিটি প্রজাতির প্রজনন, আচরণ ও রোগ বিস্তারের ক্ষমতা ভিন্ন। এদের ঠিকভাবে নিয়ন্ত্রণ করতে গেলে মশার প্রজাতি ও আচরণভেদে নিয়ন্ত্রণব্যবস্থা আলাদা আলাদাভাবে নিতে হবে। সেজন্য সমন্বিত ব্যবস্থাপনার প্রয়োজন।

সমন্বিত ব্যবস্থাপনার চারটি অংশ রয়েছে- পরিবেশগত, জীবন, রাসায়নিক ও মশা নিয়ন্ত্রণে জনগণের অংশগ্রহণ। এছাড়াও সমন্বিত মশক ব্যবস্থাপনা ঠিকভাবে বাস্তবায়নের জন্য সিটি করপোরেশনের প্রতিটি ওয়ার্ডকে দশটি ব্লকে ভাগ করে কার্যক্রম চালাতে হবে। প্রতিটি ব্লকে এন্টোমোলজি টেকনিশিয়ান, স্প্রেম্যান ও ক্লিনার থাকতে হবে বলে জানান এই কীটতত্ত্ববিদ।

ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের (ডিএসসিসি) প্রধান স্বাস্থ্য কর্মকর্তা (অতিরিক্ত দায়িত্বে) ডা. ফজলে শামসুল কবির আলোকিত বাংলাদেশকে বলেন, ‘ডিএসসিসির আওতাধীন এলাকায় প্রতিদিন ১ হাজার ৫০ জন মশককর্মী এবং ৭৫ জন সুপারভাইজার সকাল-বিকাল মশা নিধন কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছেন। পর্যাপ্ত যন্ত্রপাতি, জনবল ও মশার ওষুধ রয়েছে।’

মশা মারতে দুই সিটি করপোরেশন ফগার মেশিন ব্যবহার করছে। বিকালে ফগিং বা ধোঁয়া দিয়ে মশক নিধনের কাজ করা হচ্ছে। তবে ফগার মেশিনের শব্দে মশা পালানোর অভিযোগের বিষয়ে তিনি বলেন, ‘ফগার মেশিনের শব্দে মশা পালিয়ে যায়, এ তথ্য সঠিক নয়। মশা নিধনে ফগার মেশিনের শব্দ মুখ্য নয়, ধোঁয়াই মুখ্য, ওষুধের ধোঁয়ায় মশা মারা যায়। এখন কিউলেক্স মশার প্রজনন। সেজন্য খাল, বিল ও জলাশয় পরিষ্কারের কার্যক্রম চালানো হচ্ছে।’ তবে ফগার মিশনের বিরোধিতা করে কীটতত্ত্ববিদ অধ্যাপক ড. কবিরুল বাশার বলেন, ‘মশা মারতে ফগার মিশন ল্যাবে কার্যকর, খোলা আকাশে ফগিং কার্যকর নয়। ফগিংয়ের শব্দে মশা উড়ে যায়। এছাড়াও ফগিংয়ের ধোঁয়া স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর।’

ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের প্রধান স্বাস্থ্য কর্মকর্তা ব্রিগ্রেডিয়ার জেনারেল মো. জোবায়দুর রহমান আলোকিত বাংলাদেশকে বলেন, ‘মশা নিধন কার্যক্রম ও অভিযান চলমান। এছাড়াও খাল, জলাশয় ও ডোবা পরিষ্কার করা হচ্ছে। এডিস ও কিউলেক্স মশা নিয়ন্ত্রণে কীটতত্ত্ববিদদের পরামর্শক্রমে বছরব্যাপী কর্মপরিকল্পনা প্রণয়ন করা হবে। সেই সঙ্গে অঞ্চল পর্যায়ে কর্মপরিকল্পনা বাস্তবায়নের নির্দেশনাও দেয়া হয়েছে।’

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত