তত্ত্বাবধানের অভাব

আবর্জনার স্তূপে ঢাকার দুই সিটির খাল

* পুনরুদ্ধারে মাঠে নামছে সিটি করপোরেশন * আবর্জনা জমায় বেড়েছে মশার উপদ্রব

প্রকাশ : ০৪ ফেব্রুয়ারি ২০২৩, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ

  ফারুক আলম

ঢাকা ওয়াসার নিয়ন্ত্রণে থাকা রাজধানীর ২৬টি খাল দুই বছর আগে আনুষ্ঠানিকভাবে ঢাকা উত্তর ও দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের কাছে হস্তান্তর করা হয়। এরপর খালের ময়লা আবর্জনা পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন ও দখলমুক্ত করতে তোড়জোর শুরু করে দুই সিটি করপোরেশন। তবে তত্ত্বাবধানের অভাবে ফের খালগুলো আবর্জনার স্তূপে পরিণত হয়েছে। ফলে আগামী বর্ষা মৌসুমে পানির গতিপথে বাধার সৃষ্টি হবে আশঙ্কা করা হচ্ছে। এতে করে বাড়বে জলাবদ্ধতা ও জনদুর্ভোগ।

তবে সিটি করপোরেশন সংশ্লিষ্টরা বলেছেন, নিয়মিত খাল পরিষ্কার, খনন ও দখলদার উচ্ছেদ অভিযান চালানো হচ্ছে। ফলে অনেক খালের চিত্র কিছুটা হলেও বদলেছে। দখল-দূষণে মৃতপ্রায় অনেক খালে পানিপ্রবাহ দেখা যায়। তবে রাজধানী শহরজুড়ে শত শত কিলোমিটার খালে ময়লা ফেলা রোধে সার্বক্ষণিক তত্ত্বাবধায়ন সম্ভব নয়। আবর্জনা ফেলা বন্ধে নগরবাসীর সচেতন হওয়া দরকার।

সরেজমিন ঘুরে রাজধানীর শ্যামপুর খাল, ঢাকাণ্ডচট্টগ্রাম হাইওয়ে সংলগ্ন খাল, রামপুরা, মান্ডা, কাটাসুর, লাউতলা ও ইব্রাহিমপুর, রামচন্দ্রপুর, মিরপুর পীরেরবাগের বগার মার খাল ও শ্যামপুর খালের বেহাল অবস্থা। এসব খালে আশপাশের বাসাবাড়ির সব পয়ঃবর্জ্য গিয়ে পড়ছে। খালের দু’পাড়ের বাসিন্দা ও রাস্তার পথচারীদের ফেলা আবর্জনা খালের বিভিন্ন স্থানে স্তূপ হয়েছে। খালে আবর্জনায় মশা জন্মায়, এতে মশার উপদ্রব বেড়েছে। অথচ খালের পাশেই সিটি করপোরেশনের টাঙানো সাইনবোর্ডে নির্দেশনা রয়েছে ‘খালে কেউ ময়লা আবর্জনা ফেলবেন না। যারা ময়লা আবর্জনা ফেলবেন তাদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেয়া হবে।’ তবে কে শোনে কার কথা। সিটি করপোরেশনের নোটিসের দিকে তাকানোর কোনো গরজই মনে করছেন কেউ। অবলীলায় ফেলে যাচ্ছেন ময়লা। যা জলাবদ্ধতার অন্যতম প্রধান কারণ। কদমতলী ও দেবধূলা খাল কয়েক মাস আগে পরিষ্কার করা হলেও আবার আবর্জনায় পরিপূর্ণ হয়ে গেছে।

জানা গেছে, বর্ষা মৌসুম সামনে রেখে পানি নিষ্কাশনের প্রধান দুই মাধ্যম খাল ও ড্রেন। এই দুই মাধ্যম পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন ও দখলদার উচ্ছেদ করছে সিটি করপোরেশন। খালের ওপর স্থাপনা উচ্ছেদসহ গাইডওয়াল তৈরি করা হয়েছে। গত বছর ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন (ডিএসসিসি) শ্যামপুর, মান্ডা, কালুনগর, জিরানী, বাসাবো, কমলাপুর, ঢাকাণ্ডচট্টগ্রাম হাইওয়ে সংলগ্ন খাল, খিলগাঁও ঝিল, জুরাইন কবরস্থান সংলগ্ন খাল, পান্থপথ বক্স কালভার্ট, সেগুনবাগিচা বক্স কালভার্টে দখলদার উচ্ছেদের পাশাপাশি আবর্জনা পরিষ্কার করে। কিন্তু তত্ত্বাবধায়নের অভাবে এসব খালে ফের আবর্জনার স্তূপ হয়ে পড়ছে। একই অবস্থা ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের (ডিএনসিসি) খালগুলোয়। ওই সময় মিরপুর পীরেরবাগের বগার মার খাল, রামচন্দ্রপুর, রূপনগর, গোদাগাড়ী, কল্যাণপুর ক, খ, গ, ঙ ও চ খালের আবর্জনাও পরিষ্কার করা হয়। এসব খাল থেকে পলিথিন, প্লাস্টিকের বোতল, জাজিম, সোফা, টেলিভিশনের খোলস, ভাঙা ফ্রিজ, স্যুটকেস, বালিশ, ডাবের খোসাসহ বিভিন্ন ধরনের আবর্জনা পাওয়া যায়। দুই সিটির পরিষ্কার করা খালে তত্ত্বাবধানের অভাবে মানুষ ফের আবর্জনা ফেলছে। এতে খালে পানি প্রবাহ সচল রাখতে স্থায়ী কোন সমাধান হবে না।

ডিএনসিসির আওতাধীন রামচন্দ্রপুর খালের পাশে মোহাম্মদী ভূঁইয়া হাউজিংয়ের বাসিন্দা সজল মিয়া বলেন, খালের আশপাশে বসবাস করা বাসিন্দারা রাতের আঁধারে আবর্জনা ফেলছে। খালের দু’পাশ দিয়ে রাস্তা রয়েছে। রাস্তা দিয়ে চলাচল করা পথচারী চিপস ও বিস্কুটের প্যাকেটসহ বিভিন্ন ধরনের আবর্জনা ফেলছে। এতে পরিষ্কার খালে ফের আবর্জনার স্তূপ হচ্ছে। খালে পানির প্রবাহ ধরে রাখতে নিয়মিত তত্ত্বাবধায়ন দরকার। রিভার অ্যান্ড ডেল্টা রিসার্চ সেন্টারের ২০২০ সালের জরিপ অনুযায়ী, ঢাকায় ৭৩টি খাল আছে। ২০১৬ সালে করা ঢাকা জেলা প্রশাসনের সর্বশেষ জরিপ বলছে, খালের সংখ্যা ৫৮টি। সেই সময় জেলা প্রশাসনের প্রতিবেদনে বলা হয়েছিল, উল্লিখিত খালের ৩৭টি দখলে রয়েছে। দখল ও দূষণের কারণে খাল স্বাভাবিক প্রবাহ হারিয়েছে। কোনো কোনো খাল পুরোপুরি ভরাট হয়ে গেছে।

ঢাকার দুই সিটিতে ৩৯টি খাল রয়েছে। এরমধ্যে ঢাকা ওয়াসার নিয়ন্ত্রণে থাকা ২৬টি খাল ২০২০ সালের ডিসেম্বরে আনুষ্ঠানিকভাবে ঢাকা উত্তর ও দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনকে হস্তান্তর করা হয়। যা ঢাকা উত্তর ১৫টি এবং দক্ষিণ ১১টি খালের সার্বিক তত্ত্বাবধানের দায়িত্ব পায়। আর বাকি ১৩টি খাল পানি উন্নয়ন বোর্ড এবং গৃহায়ণ ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের আওতাধীন বিভিন্ন সংস্থার তত্ত্বাবধানে আছে।

ঢাকার ২৬টি খালের মধ্যে সাতটির সরাসরি সংযোগ রয়েছে নদীর সঙ্গে। এর মধ্যে রয়েছে আব্দুল্লাহপুর খাল, বেগুনবাড়ী খাল, দ্বিগুণ খাল, হাজারীবাগ খাল, জিরানী খাল, কল্যাণপুর খাল ও মা-া খাল। রূপনগর খাল, শাহজাদপুর খাল ও সুতিভোলা খাল এই তিনটি জলাধারের সঙ্গে সরাসরি যুক্ত। বাকি ১৬টি খাল ওই ১০টি খালের সঙ্গে যুক্ত। আব্দুল্লাহপুর খাল উত্তরার ১০ নম্বর সেক্টরের কামারপাড়া মৌজার ওপর পানি উন্নয়ন বোর্ডের একটি সুইস গেটের সঙ্গে যুক্ত রয়েছে। বেগুনবাড়ী খাল রমনা কালভার্ট থেকে মেরাদিয়া হয়ে বালু নদীতে পড়েছে। তুরাগ নদের সঙ্গে যুক্ত রয়েছে রূপনগর খাল। মোহাম্মদী হাউজিংয়ের ৫ নম্বর রোড থেকে শুরু হয়ে মোহাম্মদপুর আদাবর ১৬ নম্বর রোড পার হয়ে কল্যাণপুর প্রধান খালে গিয়ে শেষ হয়েছে রামচন্দ্রপুর খাল। ঢাকার খালগুলো রক্ষণাবেক্ষণ ও সৌন্দর্য্যবর্ধনে প্রকল্প গ্রহণ করছে সরকার। এরই মধ্যে ডিএসসিসি চারটি খাল সংস্কার এবং নান্দনিক পরিবেশ সৃষ্টি করতে ৮৯৮ কোটি টাকার একটি প্রকল্প অনুমোদন পেয়েছে।

অন্যদিকে ডিএনসিসির খাল সংস্কারে মাস্টারপ্ল্যান করছে। এ জন্য পরামর্শক প্রতিষ্ঠান ঠিক করা হয়েছে। খালকে দৃষ্টিনন্দন কীভাবে করা যায়Ñসে আলোকে লে-আউট ডিজাইন তৈরি করছে। এরই মধ্যে সিএস, আরএস জরিপের মাধ্যমে কয়েকটি খালের সীমানা ঠিক করা হয়েছে। বাকিগুলোর কাজও শিগগিরই শেষ হবে। এরপরই উচ্ছেদ কার্যক্রম শুরু হবে। তা ছাড়া ডিএনসিসির খাল সংস্কার ও নান্দনিক পরিবেশ সৃষ্টিতে ৬৫০ কোটি টাকার একটি প্রকল্প নেওয়া হয়েছে।

ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের জনসংযোগ কর্মকর্তা মকবুল হোসাইন আলোকিত বাংলাদেশকে বলেন, উত্তর সিটি করপোরেশনের ২৯টি খালের আবর্জনা পর্যাক্রমে পরিষ্কার করা হচ্ছে। তবে খাল পরিষ্কারের পর জনগণ আবার ময়লা-আবর্জনা ফেলছেন। এ ধরনের তথ্য সিটি করপোরেশনে প্রায়ই আসছে। এক্ষেত্রে জনগণ সচেতন হলেই খালগুলোর আবর্জনা দূরীকরণে স্থায়ী সমাধান আসবে। তিনি আরও বলেন, খালের জায়গা দখলমুক্ত করতে জোড়েশোরে কার্যক্রম শুরু করবে সিটি করপোরেশন। খালের সীমানা নির্ধারণ ও খালের পাড় দিয়ে সিসি ক্যামেরা বসিয়ে কন্ট্রোল রুমের মাধ্যমে তত্ত্বাবধায়ন করা হবে। এটি বাস্তবায়নে আরও কিছুদিন সময় লাগবে। তবে ইমতোমধ্যেই কিছু কিছু খালে সিসি ক্যামেরা লাগানো হয়েছে। যারা খালে আবর্জনা ফেলবেন তাদের শাস্তির আওতায় নিয়ে আসব।

ডিএসসিসি জনসংযোগ কর্মকর্তা আবু নাছের বলেন, ঢাকা ওয়াসা থেকে খালগুলো বুঝে নিয়ে পরিচ্ছন্ন ও দখলদার উচ্ছেদ করা হয়েছে। আগের চেয়ে খালগুলোর চেহারা পাল্টে গেছে। পর্যায়ক্রমে সব খাল ও বক্স কালভার্টের আবর্জনা অপসারণ করা হবে। তবে মানুষের সচেতনতা ছাড়া বারবার খাল পরিচ্ছন্ন করেও আবর্জনা দূর করা সম্ভব হবে না।

খালের আবর্জনা পরিষ্কারের বিষয়ে বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব প্ল্যানার্সের (বিআইপি) সাধারণ সম্পাদক ড. আদিল মুহাম্মদ খান আলোকিত বাংলাদেশকে বলেন, ঢাকা ওয়াসা থেকে খাল বুঝে পাওয়ার পর বর্জ্য অপসারণে দুই সিটি করপোরেশন তোড়জোর শুরু করেছিল। এতে কিছু খাল দখলমুক্ত ও পরিচ্ছন্ন করায় কিছুটা হলেও নগরবাসী সুফল পেয়েছিল। তবে খালের ময়লা-আবর্জনা স্থায়ীভাবে দূর করতে ওয়ার্ডভিত্তিক নগরপরিকল্পনার দরকার। এছাড়া খালে যাতে মানুষ আবর্জনা না ফেলে সেজন্য সংশ্লিষ্ট সংস্থাকে তত্ত্বাবধায়ন বাড়াতে হবে।