ভাষার অধিকারের জন্য অপেক্ষা করতে হয়েছিল

প্রকাশ : ০৪ ফেব্রুয়ারি ২০২৩, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ

  নিজস্ব প্রতিবেদক

২০০ বছরের ব্রিটিশ শাসনের পর ১৯৪৭ দ্বিজাতিতত্ত্বের ভিত্তিতে ভারত ও পাকিস্তান রাষ্ট্রের উদ্ভব হয়। পশ্চিম ও পূর্ব পাকিস্তান নামে পাকিস্তানের দুইটি অংশ ছিল। দুইটি অংশের মধ্যে হাজার মাইলেরও বেশি দূরত্ব ছিল। পাকিস্তানের জন্মের পর থেকেই পশ্চিম পাকিস্তান এবং পূর্ব পাকিস্তানের মধ্যে সাংস্কৃতিক, ভৌগোলিক ও ভাষাগত দিক থেকে অনেক মৌলিক পার্থক্য বিরাজ করছিল। বিভিন্নভাবে বঞ্চিত ও শোষিত পূর্ব পাকিস্তানের জনগোষ্ঠী নিজের ভাষায় কথা বলার জন্য সংগ্রাম শুরু করে। বিভিন্ন চড়াই-উতরাই পেরিয়ে চূড়ান্ত রূপ লাভ করে ১৮৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি। তবে ভাষার অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য বাঙালি জনগোষ্ঠিকে অপেক্ষা করতে হয়েছিল আরও ৫ বছর। ১৯৫৬ সালের ২৬ ফেব্রুয়ারি পাকিস্তান সংবিধান উর্দুর পাশাপাশি বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে স্বীকৃতি দেয়।

ইতিহাসবিদদের সঙ্গে কথা বলে এবং ভাষা আন্দোলন নিয়ে বিভিন্ন প্রতিবেদন পড়ে জানা গেছে, ১৯৪৭ সালের সেপ্টেম্বরে নতুন সংগঠন তমদ্দুন মজলিশ বাংলা ভাষাকে রাষ্ট্রভাষা করার দাবি তোলে। তমদ্দুন মজলিশ ‘পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা কী হবে? বাংলা নাকি উর্দু?’ এ নামে একটি পুস্তিকা প্রকাশ করে, যেখানে সর্বপ্রথম বাংলাকে পাকিস্তানের একটি রাষ্ট্রভাষা হিসেবে ঘোষণা করার দাবি করা হয়। উল্লেখ্য, সেই সময় সরকারি কাজকর্ম ছাড়াও সব ডাকটিকিট, পোস্টকার্ড, ট্রেন টিকিটে কেবল উর্দুু এবং ইংরেজিতে লেখা থাকত। তমদ্দুন মজলিশের তৎকালীন সাধারণ সম্পাদক ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থ বিজ্ঞানের অধ্যাপক আবুল কাশেম ঢাকা বিশ্বব্যিালয়ের ফজলুল হক হলে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা কী হওয়া উচিত সে ব্যাপারে একটি সভা আহ্বান করেন। ওই সভায় বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার ব্যাপারে পাকিস্তান সরকারের কাছে নিয়মতান্ত্রিক পন্থায় আন্দোলন করার ব্যাপারে সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়ে। বইটিতে তিনজনের নাম লেখা ছিল। তারা হলেন-অধ্যক্ষ আবুল কাশেম, আবুল মনসুর আহমদ এবং কাজী মোতাহার হোসেন। তারা ফজলুল হক মুসলিম হলে ১২ নভেম্বর একটি সভা করেন। এ সভার আগে পূর্ববঙ্গ সাহিত্য সমাজ ৫ নভেম্বর এ সংক্রান্ত একটি সভা করে।

১৯৪৭ সালের নভেম্বরে পাকিস্তানের তৎকালীন শিক্ষামন্ত্রী ফজলুর রহমানের উদ্যোগে পশ্চিম পাকিস্তানে আয়োজিত ‘পাকিস্তান এডুকেশনাল কনফারেন্সে’ পূর্ব পাকিস্তান থেকে আগত প্রতিনিধিরা উর্দুকে একমাত্র রাষ্ট্রীয় ভাষা হিসেবে প্রতিষ্ঠার বিরোধিতা করেন এবং বাংলাকেও সমঅধিকার প্রদানের দাবি তোলেন। কিন্তু বিদ্যমান অবস্থার নাটকীয় পরিবর্তন ঘটে যখন ৫ ডিসেম্বর করাচিতে অনুষ্ঠিত শিক্ষা সম্মেলনে উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা ও মাধ্যম হিসেবে বিভিন্ন প্রদেশে ব্যবহার এবং প্রাথমিক স্তরের আবশ্যিক বিষয় হিসেবে ব্যবহার করার সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। তাৎক্ষণিক প্রতিবাদে ৬ ডিসেম্বর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গণে তমদ্দুন মজলিশের নেতৃত্বে সমাবেশ ও মিছিল হয়। সমাবেশে বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ছাত্ররা এসে জড়ো হন। সেখানে অনুষ্ঠিত সভায় বাংলা ভাষাকে পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা এবং পূর্ব পাকিস্তানের শিক্ষার মাধ্যম ও দাফতরিক ভাষা হিসেবে নির্ধারণ করার দাবি জানানো হয়। ভাষার জন্য বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গণে অনুষ্ঠিত প্রথম সভা ছিল সেটি। তমদ্দুন মজলিশের ৮ ডিসেম্বরের একটি সমাবেশ থেকে বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার দাবি উত্থাপিত হয়। ডিসেম্বরের শেষের দিকে গঠিত হয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ এবং তমদ্দুন মজলিশের অধ্যাপক নুরুল হক ভূঁইয়া এর আহ্বায়ক নিযুক্ত হন।

উল্লেখ্য, বাংলাকে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষার মর্যাদা দেয়ার প্রশ্নটি প্রথম উত্থাপিত হয় ১৯৪৭ সালের ভারত ভাগের আগে থেকেই। পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার আগেই আলিগড় বিশ্ববিদ্যালয়ের ড. জিয়াউদ্দিন উর্দুকে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা করার প্রস্তাব করেন, তখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ পাল্টা বাংলা ভাষাকে প্রস্তাব দেন।