আড়াই মাসেও অধরা পলাতক দুই জঙ্গি

বড় ধরনের হামলার ‘আশঙ্কা’অপরাধ বিশেষজ্ঞদের

প্রকাশ : ০৫ ফেব্রুয়ারি ২০২৩, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ

  এএইচএম ফারুক

প্রায় আড়াই মাস আগে ঢাকার আদালত পাড়া থেকে ছিনিয়ে নেয়া মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত দুই জঙ্গিকে এখনো গ্রেপ্তার করতে পারেনি আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। গত ২০ নভেম্বর আবু সিদ্দিক সোহেল ওরফে সাকিব ও মাইনুল হাসান শামীমকে ছিনিয়ে নেয় তাদের সহযোগীরা। তারা নিষিদ্ধ ঘোষিত জঙ্গি সংগঠন আনসার আল ইসলামের (সাবেক আনসারুল্লাহ বাংলা টিম) সদস্য। ধরাছোঁয়ার বাইরে থাকা পলাতক দুজনের একজনকেও শনাক্ত করতে পারেনি আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। তাই বড় কোনো জঙ্গি হামলার আশঙ্কা উড়িয়ে দিচ্ছেন না অপরাধ বিশেষজ্ঞরা।

আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর তথ্য অনুযায়ী আগে থেকেই জামাতুল মুজাহিদীনের (জেএমবি) ১৪ শীর্ষ নেতা এখনো পলাতক। সর্বশেষ গত ২০ নভেম্বর আদালত প্রাঙ্গণ থেকে দুই জঙ্গিকে ছিনিয়ে নেয়ার ঘটনা এবং প্রায় আড়াই মাসেও তাদের গ্রেপ্তার করতে না পারায় বাড়ছে উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা।

পুলিশ ও গোয়েন্দা সংস্থা সূত্রে জানা গেছে, আনসার আল ইসলামের মূল নেতা মেজর (বরখাস্ত) জিয়াকে ধরিয়ে দেয়ার জন্য পুরস্কার ঘোষণা করলেও এখনো কোনো ফল পাওয়া যায়নি। এ কারণেই হয়তো আদালতের মতো জনবহুল প্রাঙ্গণ থেকে জঙ্গি ছিনতাইয়ের সাহস দেখিয়েছে জঙ্গিরা। জঙ্গি বিষয়ে বিশেষজ্ঞরা বলছেন- অনেক সময় দেখা গেছে জঙ্গিরা জামিনে বের হওয়ার পর তারা হারিয়ে যায়। তাদেরও গোয়েন্দা মনিটরিং করতে হয়। ওইসব জঙ্গিদের মনিটিরিংয়ের মধ্যে না রাখার কারণে ছোট ছোট কিছু ঘটনার মোকাবিলা করতে হয় পুলিশকে। যেটা হলো আদালত থেকে জঙ্গি ছিনতাইয়ের মতো ঘটনা। গোয়েন্দা বাহিনীর তথ্যের ওপর ভিত্তি করে অনেক কিছু করা হয়। তাদের আগাম সতর্কতা দিতে হয়, অন্যথায় হামলার আশঙ্কা থেকে যায়। নিরাপত্তা বিশ্লেষক ও আইনশৃঙ্খলা রাক্ষাকারী বাহিনীর একাধিক সূত্র জানিয়েছে, জঙ্গিদের সক্ষমতা আগের চেয়ে বেড়েছে। বিশেষ করে জামিনে বের হওয়ার পর পলাতক জঙ্গিদের বিষয়ে তেমন খোঁজখবর রাখেনি আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। এরকম অন্তত ৩২ জন জঙ্গি জামিনে রয়েছেন।

নিরাপত্তা বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, সামনে জাতীয় নির্বাচন, দুই জঙ্গি পলাতক অবস্থায় দেশে বড় কোনো হামলা চালাতে পারে। দেশে হয়তো তারা আরেকটি হলি আর্টিজানের মতো ঘটনা অথবা আত্মঘাতী কোনো হামলা ঘটানোর পরিকল্পনা করছে। এছাড়া নতুন জঙ্গি সংগঠন ‘জামায়াতুল আনসার ফিল হিন্দাল শারক্বীয়া’র সঙ্গে পলাতক দুই জঙ্গির কোনো সমঝোতা হলে সেটিও হবে ভয়াবহ।

বিশেষজ্ঞদের মতে, সাবধানতা ও সতর্ক বার্তার মধ্যেই ২০১৬ সালের ১ জুলাই রাজধানী ঢাকায় হলি আর্টিজান রেস্তোরাঁয় ইতিহাসের জঘন্যতম জঙ্গি হামলা ঘটে। অনলাইন প্ল্যাটফর্ম থেকে জঙ্গি-উগ্রবাদী তৎপরতা বেড়েছে। জঙ্গিবিরোধী তৎপরতায় আত্মতৃপ্তির সুযোগ নেই।

মামলার তদন্ত কর্মকর্তারা বলছেন, আদালত থেকে ছিনিয়ে নেয়া দুই আসামি গ্রেপ্তারে কাজ করছেন গোয়েন্দারা। আশা করা যাচ্ছে, দ্রুত সময়ের মধ্যেই তারা গ্রেপ্তার হবেন। তারা যদি বিদেশে পালান, ইন্টারপোলের মাধ্যমে তাদের ফিরিয়ে আনা হবে। এখন পর্যন্ত বিদেশে পালানোর বিষয়ে কোনো ধরনের গোয়েন্দা তথ্য পাওয়া যায়নি।

পলাতক দুই জঙ্গিকে গ্রেপ্তার করতে না পারলেও ওই ঘটনায় জড়িত মেহেদী হাসান অমি ওরফে রাফি (২৪) ও প্রয়াত রেলমন্ত্রী সুরঞ্জিত সেনগুপ্তের এপিএস ওমর ফারুককে গ্রেপ্তার করে কাউন্টার টেরোরিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম (সিটিটিসি)। রাফি মোটা অঙ্কের টাকা এনেছিলেন। এই টাকা ছিনিয়ে নেয়া জঙ্গিদের হাতে দেন তিনি। যাতে জঙ্গিরা টাকা-পয়সা দিয়ে তাদের পরবর্তী কার্যক্রম চালাতে পারেন। সন্ত্রাসবিরোধী আইনের একটি মামলায় গ্রেপ্তার মেহেদী আগে থেকেই পরিকল্পনা করেছিলেন ছিনিয়ে নেয়ার পর জঙ্গিদের হাতে টাকা দেবেন। অমি প্রধান সমন্বয়ক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন।

জানা যায়, পলাতক দুই জঙ্গি নিষিদ্ধঘোষিত আনসার আল ইসলামের সঙ্গে জড়িত। আনসার আল ইসলাম কাট আউট (একই কাজে যুক্ত এক দলের তথ্য অন্য দল জানে না) পদ্ধতিতে কাজ করার কারণে গ্রেপ্তার মেহেদীকে জিজ্ঞাসাবাদ করেও কোনো তথ্য জানতে পারেনি পুলিশ। জঙ্গি ছিনিয়ে নেয়ার ঘটনায় অংশ নেয়া আরো সাতজনকে চিহ্নিত করা গেলেও তাদের অবস্থানের বিষয়ে এখনো নিশ্চিত কোনো তথ্য পাওয়া যায়নি। ছিনিয়ে নেয়া দুই জঙ্গি জাগৃতি প্রকাশনীর প্রকাশক ফয়সল আরেফিন দীপন এবং লেখক ও ব্লগার অভিজিৎ রায় হত্যা মামলার মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত আসামি। এছাড়া আরও কয়েকটি হত্যা মামলারও আসামি তারা।

এদিকে দুই জঙ্গি ছিনিয়ে নেয়ার ঘটনায় চার সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সুরক্ষা সেবা বিভাগ। সুরক্ষা সেবা বিভাগের অতিরিক্ত সচিব (কারা অনুবিভাগ) মো. হাবিবুর রহমানকে প্রধান করে এ কমিটি গঠন করে আদেশ জারি করা হয়। কমিটিতে সদস্য হিসেবে রয়েছেন পুলিশ মহাপরিদর্শকের প্রতিনিধি (ডিআইজি পদমর্যাদার নিচে নন), অতিরিক্ত কারা মহাপরিদর্শক ও ঢাকার অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট।

পুলিশ সদরদপ্তরের একজন ডিআইজিকে প্রধান করে চার সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়। কমিটির প্রধান পুলিশ সদরদপ্তরের ডিআইজি (অডিট) মো. আমিনুল ইসলাম ও সদস্য সচিব অতিরিক্ত ডিআইজি (ক্রাইম মেট্রো) মো. হাসানুজ্জামান। কমিটির অন্য সদস্যরা হলেন- সিটিটিসির ড. এএইচএম কামরুজ্জামান ও সিআইডির বিশেষ পুলিশ সুপার (মেট্রো সাউথ) মো. আনিচুর রহমান।

দুই জঙ্গি মইনুল হাসান শামীম ওরফে সিফাত সামির ও মো. আবু ছিদ্দিক সোহেল ওরফে সাকিব পালানোর ঘটনায় অতিরিক্ত পুলিশ কমিশনারকে সভাপতি করে তদন্ত কমিটি গঠন করে ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ (ডিএমপি)। তদন্ত কমিটির সভাপতি হলেন ডিএমপির অতিরিক্ত পুলিশ কমিশনার (ক্রাইম আ্যন্ড অপস) একেএম হাফিজ আক্তার। কমিটির সদস্যরা হলেন ডিএমপির যুগ্ম-পুলিশ কমিশনার (অপারেশনস), যুগ্ম-পুলিশ কমিশনার (সিটিটিসি), লালবাগ বিভাগের উপ-পুলিশ কমিশনার ও ডিএমপির সিআরও’র অতিরিক্ত উপ-পুলিশ কমিশনার।

ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ (ডিএমপি) কমিশনার খন্দকার গোলাম ফারুক বলেন, আদালত থেকে পালিয়ে যাওয়া দুই জঙ্গির বিষয়ে পুলিশের একাধিক ইউনিট কাজ করছে। পুলিশ এর আগে অনেক বড় বড় জঙ্গি নেতাদের গ্রেপ্তার করে আইনের আওতায় এনেছে। পলাতক দুই জঙ্গি যেখানেই পালিয়ে থাকুক তাদের গ্রেপ্তার করে আইনের মুখোমুখি করা হবে।

পলাতক দুই জঙ্গির বিষয়ে র্যাব কাজ করছে জানিয়ে সংস্থাটির লিগ্যাল অ্যান্ড মিডিয়া উইংয়ের পরিচালক কমান্ডার খন্দকার আল মঈন বলেন, হলি আর্টিজানের মতো ঘটনা বারবার হবে না। জঙ্গিরা নতুন কোনো প্ল্যানে কাজ করতে পারে। তবে র্যাব এক্ষেত্রে সব সময় সতর্ক আছে। পলাতক দুই জঙ্গিসহ তাদের সহযোগিদেরও আইনের আওতায় আনতে র্যাবের গোয়েন্দা দল ও সবগুলো ইউনিট কাজ করছে।

হলি আর্টিজানে জঙ্গি হামলার পর সেনা অভিযানে নেতৃত্ব দেন তৎকালীন ব্রিগেডিয়ার জেনারেল ড. নাঈম আশফাক চৌধুরী। পরবর্তিতে তিনি মেজর জেনারেল হিসেবে অবসরগ্রহণ করেন। নিরাপত্তা বিশ্লেষক হিসেবে আদালত পাড়া থেকে জঙ্গিদের ছিনতাই এবং পলাতক জঙ্গিদের বিষয়ে জানতে চাইলে মেজর জেনারেল (অব.) ড. নাঈম আশফাক চৌধুরী বলেন- জঙ্গিদের নজরদারিতে রাখা জরুরি।

দেশে হলি আর্টিজান হামলার পর জঙ্গি অভিযান ও গোয়েন্দা তৎপরতার প্রেক্ষাপটে জঙ্গিরা দুর্বল হয়ে আসে। তাদের সক্ষমতা কমে যায়। কিন্তু অতীতে পলাতক জঙ্গিদের গ্রেপ্তার করতে না পারায় এবং তাদের কর্মকা-ের জন্য উপযুক্ত বিচারের ব্যবস্থা করতে না পারায় এখন সময়ের ব্যবধানে জঙ্গিদের সাহস বেড়ে গেছে। তাদের সক্ষমতাও বেড়েছে। যার ফলে আদালতের মতো গুরুত্বপূর্ণ জয়গা থেকে মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত আসামি (জঙ্গি) ছিনতাই করার সাহস দেখিয়েছে।

ড. নাঈম আশফাক চৌধুরী আরও বলেন, আমরা অনেকদিন পর জঙ্গিদের এই তৎপরতা দেখলাম, হয়তো তারা ভিন্ন কৌশল অবলম্বন করতে শুরু করেছে। তিনি বলেন, জঙ্গি নিয়ন্ত্রণে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী এবং সাধারণ মানুষ সবাইকে সমন্বিতভাবে কাজ করতে হবে।

জঙ্গিদের নিয়ন্ত্রণে আনতে চাইলে গোয়েন্দা তৎপরতা বাড়াতে পরামর্শ দিয়েছেন এ নিরাপত্তা বিশ্লেষক।

পালানো দুই জঙ্গিকে গ্রেপ্তার না করা পর্যন্ত ঝুঁকি রয়েই যায় উল্লেখ করে সাবেক পুলিশ মহাপরিদর্শক (আইজিপি) একেএম শহীদুল হক বলেন, দুই জঙ্গিকে গ্রেপ্তারে নিশ্চয়ই আইনশৃঙ্খলা বাহিনী সর্বোচ্চ চেষ্টাই করে যাচ্ছে। তাদের শনাক্ত করতে না পারলে গ্রেপ্তার করা খুব কঠিন। দুই জঙ্গিকে গ্রেপ্তার করতে না পারলে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর অস্বস্তি রয়ে যাবে।

তিনি বলেন- ‘হলি আর্টিজানের পরে আমি আইজিপি হিসেবে দায়িত্ব পাই। তখন সারা দেশে জঙ্গিদের আস্তানা খুঁজে খুঁজে অভিযান পরিচালনা করে নির্মূল করি। জঙ্গিদের অনেকগুলো আত্মঘাতী দল হয়েছিল তখন। জঙ্গিরা নতুন করে সৃষ্টি হচ্ছে ঠিক, তবে হলি আর্টিজানের মতো ঘটনা ঘটানোর সক্ষমতা জঙ্গিদের নেই।’

পুলিশের সাবেক মহাপরিদর্শক (আইজিপি) মো. নূরুল আনোয়ার বলেন, যখন কোনো মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত আসামি পলায়ন করে তখন খুব সহসা ধরা পড়বে না, সেভাবে তারা পালিয়ে যায়। তারা খুব ভালো করেই জানতেন তাদের মৃত্যুদণ্ড কার্যকর হবে। হলি আর্টিজানের মতো ঘটনা ঘটবে কি না তাৎক্ষণিকভাবে কেউ বলতে পারবে না উল্লেখ করে তিনি বলেন, তারা হলি আর্টিজানের চেয়েও বড় কোনো হামলা ঘটাতে পারে। আমি শঙ্কা থেকে বলছি- কোনো মসজিদ কিংবা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে তারা হামলা করতে পারে। তখন মানুষ মসজিদে যেতে ভয় পাবে। আর সেটি আন্তর্জাতিকভাবে প্রচার পাবে। তবে এখন পর্যন্ত এমন কোনো ইনফরমেশন নেই। হলি আর্টিজানের ঘটনা আমাদের দেশের আপামর জনসাধারণ সমর্থন করেনি। তবে নির্বাচন সামনে, জঙ্গিরা ধরা না পড়া পর্যন্ত হামলার আশঙ্কা উড়িয়ে দিতে পারি না।

সম্প্রতি ঢাকার আদালত থেকে দুই মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত জঙ্গিকে ছিনিয়ে নেয়াসহ পলাতক জঙ্গিদের গ্রেপ্তার করতে না পারা ইত্যাদি বিষয়ে জানতে চাইলে নিরাপত্তা বিশ্লেষক মেজর জেনারেল (অব.) মো. আব্দুর রশীদ বলেন- জঙ্গি ছিনতাইয়ের ঘটনাটি একটি অবহেলা। এর সঙ্গে কে বা কারা জড়িত রয়েছে বা ঘটনাটি কীভাবে ঘটেছে সেই বিষয়ে সঠিক তদন্ত করে ঘটনাটির আসল রহস্য বের করতে হবে। তিনি বলেন, অনেক সময় দেখা গেছে জঙ্গিরা জামিনে বের হওয়ার পর তারা হারিয়ে যায়। তাদেরও গোয়েন্দা মনিটরিং করতে হয়। ওই সব জঙ্গিদের মনিটরিংয়ের মধ্যে না রাখার কারণে ছোট ছোট কিছু ঘটনার মোকাবিলা করতে হয় পুলিশকে। যেটা হলো আদালত থেকে জঙ্গি ছিনতাইয়ের মতো ঘটনা।