মশা নিধনে শিগগিরই ‘মেয়র সামিট’

প্রকাশ : ০৫ ফেব্রুয়ারি ২০২৩, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ

  ফারুক আলম

দেশে প্রথমবারের মতো ‘মেয়র সামিট’ আয়োজনের উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। এতে আর্থিক ও টেকনিক্যাল সহায়তা দেবে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা। এই সম্মেলনে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়সহ দেশের ১২টি সিটি করপোরেশনের প্রতিনিধিরা থাকবেন। এ সময় সিটি করপোরেশনগুলোকে একই ধরনের কীটনাশক ব্যবহারের নির্দেশনা দেয়া হতে পারে।

সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, মেয়র সম্মেলনের পাশাপাশি ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন মশার ওষুধ পরিবর্তনের পরিকল্পনা করছে। কেননা মশা দমনে দীর্ঘদিন ধরে একই ধরনের কীটনাশক ব্যবহার হয়ে আসছে। যার ফলে মশা কীটনাশক প্রতিরোধী হয়ে উঠছে। তাই মশার ওষুধ প্রয়োগ তালিকায় নতুন ও কার্যকরী কীটনাশক লার্ভিসাইড যোগ হচ্ছে। অনেক দেশেই লার্ভিসাইড হিসেবে বিটিআই (বেসিলাস থুরেনজিনেসিস প্রোডাক্ট : তরল/পাউডার) ব্যবহৃত হচ্ছে। ডিএনসিসিতেও পরীক্ষামূলকভাবে বিটিআই প্রয়োগ করা হবে।

ঢাকা দুই সিটি করপোরেশনের বিভিন্ন ওয়ার্ডে দেখা গেছে, নগরে মশা নিধনে প্রতিটি ওয়ার্ডে রুটিন করে সকাল-বিকাল কীটনাশক (স্প্রেইং/ফগিং) প্রয়োগ করা হচ্ছে । তবে কীটনাশক ব্যবহারে সঠিক পরিকল্পনা থাকা উচিত এবং এ বিষয়ে বিশেষ মনোযোগী হওয়া প্রয়োজন। ডিএনসিসি সংশ্লিষ্টরা জানান, ঢাকা শহরে এতোদিন ভুল পদ্ধতিতে মশা নিধন কার্যক্রম চালানো হচ্ছে বলে মনে করছেন ডিএনসিসির মেয়র আতিকুল ইসলাম। যুক্তরাষ্ট্রের মিয়ামি শহরে গিয়ে মশা নিধন কার্যক্রম দেখে তাঁর এই উপলব্ধি হয়েছে। দেশে ফিরেই মশা নিধন কার্যক্রম নিয়ে ডিএনসিসির সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের সঙ্গে বৈঠক করেছেন। ওই বৈঠকে মশা নিধনের কার্যক্রম নিয়ে বেশকিছু সিদ্ধান্ত হয়েছে। এসব সিদ্ধান্তের মধ্যে রয়েছে- ডিএনসিসিতে আধুনিক ল্যাব স্থাপন, বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা নিয়োগ, মশার প্রজাতি চিহ্নিতকরণ ও নতুন মশার ওষুধ আমদানিতে গবেষণা চালানো।

বছরের পর বছর মশা নিধনে সিটি করপোরেশন ওষুধ ছিঁটালেও সফলতা যেন অধরাই থেকে গেছে। মশকনিধনে ব্যর্থই বলা যায় ঢাকার দুই সিটি করপোরেশনকে। এ কারণে ভয়াবহ এক ডেঙ্গুর মৌসুম দেখল নগরবাসী। ২০২২ সালে এডিস মশার কামড়ে প্রায় ১৫০ জন ডেঙ্গু রোগী মারা গেছে। এর বড় অংশই শিশু। রাজধানীতে কিউলেক্সের পাশাপাশি এডিস মশার উপদ্রব বেড়েছে ।

ডিএনসিসির মেয়র আতিকুল ইসলাম আলোকিত বাংলাদেশকে বলেন, মশার কামড়ের যন্ত্রণা থেকে নগরবাসীকে রেহাই দিতে সিটি করপোরেশনের আন্তরিকতার কোনো ঘাটতি নেই। প্রতিটি ওয়ার্ডে মশকনিধন কর্মীরা ওষুধ ছিঁটাচ্ছে। কিন্তু আমাদের মশার ওষুধ ছিঁটানো পদ্ধতিগত ভুল আছে, সেজন্যই এবার নতুনত্ব কিছু পরিকল্পনা করা হচ্ছে। মশার ওষুধ কিভাবে ছিঁটাতে হবে, সেটিও গুরুত্বপূর্ণ। তিনি আরও বলেন, মশার নতুন ওষুধ আমদানিতে পরীক্ষার প্রয়োজন রয়েছে। পরীক্ষা ছাড়া মশার ওষুধ আমদানি করা যাবে না।

এর আগে ডিএনসিসির জনসংযোগ বিভাগের এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে ডিএনসিসির মেয়র বলছেন, ‘আমরা এত দিন ভুল পদ্ধতি প্রয়োগ করেছি। তাতে মশা তো ধ্বংস হয়নি; বরং অর্থের অপচয় হয়েছে। মিয়ামি আর ঢাকার আবহাওয়া এবং মশার ধরন একই। তাই তারা সফল হলে অবশ্যই আমরাও সফল হব। এখন আর পিছিয়ে থাকার সময় নেই। উন্নত দেশের পদ্ধতি অনুসরণ করতে পারলে ঢাকাকেও মশামুক্ত করা সম্ভব।’

মশা নিয়ন্ত্রণের বিষয়ে কীটতত্ত্ববিদ ও জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক ড. কবিরুল বাশার আলোকিত বাংলাদেশকে বলেছেন, ‘সিটি করপোরেশনের মশকনিধন কার্যক্রমে গলদ আছে, সেটি বারবার বলেছি, কিন্তু মেয়ররা কথাগুলো এত দিন আমলে নেননি। যুক্তরাষ্ট্রে মশকনিধন কার্যক্রম দেখে ডিএনসিসির মেয়র এত দিনে বুঝলেন। এখন মিয়ামি থেকে অর্জিত জ্ঞানের সফল বাস্তবায়নের মাধ্যমে ঢাকা উত্তর সিটিকে মশামুক্ত রাখতে চান তিনি। এ জন্য দ্রুত ঢাকা উত্তর সিটিতে মশার প্রজাতি চিহ্নিত করার জন্য একটি ল্যাব স্থাপন করতে চান। এ ছাড়া তিনি দেশের কীটতত্ত্ববিদদের নিয়ে ঢাকাকে মশামুক্ত করার কর্মপদ্ধতি ঠিক করবেন।’ মশা নিধনে শুধু ডিএনসিসিতে বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি প্রয়োগে সফলতা আসবে না। এ জন্য সব সিটি করপোরেশনের সমন্বয় প্রয়োজন বলে মনে করেন অধ্যাপক ড. কবিরুল বাশার। তিনি বলেন, ‘দীর্ঘদিন ধরে মশক নিয়ন্ত্রণে সমন্বিত নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থার কথা বলে আসছি। কারণ সমগ্র বিশ্বে সমন্বিতভাবে খুব সহজেই মশক নিয়ন্ত্রণ করা হয়ে থাকে। বাংলাদেশে ১২৩ প্রজাতির মশার রেকর্ড রয়েছে। তার মধ্যে বর্তমানে ঢাকায় প্রায় ১৪ প্রজাতির মশা দেখা যায়। মশার প্রতিটি প্রজাতির প্রজনন, আচরণ ও রোগ বিস্তারের ক্ষমতা ভিন্ন। এদের ঠিকভাবে নিয়ন্ত্রণ করতে গেলে মশার প্রজাতি ও আচরণভেদে নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা আলাদা আলাদাভাবে নিতে হবে। সেজন্য সমন্বিত ব্যবস্থাপনার প্রয়োজন।’

অধ্যাপক ড. কবিরুল বাশার আরও বলেন, ‘ডিএনসিসির মেয়র যুক্তরাষ্ট্র থেকে ফিরে ডিএনসিসিতে একটি সভার আয়োজন করেন। ওই সভায় স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তা, সিটি করপোরেশনের কর্মকর্তা, কীটতত্ত্ববিদসহ বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার প্রতিনিধিরা উপস্থিত ছিলেন। সভায় সিদ্ধান্ত অনুযায়ী- খুব শিগগিরই ‘বাংলাদেশ মেয়র সামিট বা মেয়র সামিট’ নামে একটি সম্মেলন করা হবে। এই সম্মেলনে আর্থিক ও টেকনিক্যাল সহায়তার আশ্বাস দিয়েছেন বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার প্রতিনিধি। ’

ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের প্রধান স্বাস্থ্য কর্মকর্তা ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মোঃ জোবায়দুর রহমান আলোকিত বাংলাদেশকে বলেন, মশা নিধনে বিটিআই প্রয়োগের পরিকল্পনা রয়েছে। মশা নিধনে এটি বিভিন্ন দেশে প্রয়োগ করা হয়। তবে এখন পর্যন্ত আমদানিকারক প্রতিষ্ঠান নির্ধারণ করা হয়নি। বিটিআইয়ের মাধ্যমে ড্রেন ও জলাশয়ে থাকায় মশার লার্ভা নিধন করা হবে।

তিনি আরও বলেন, ডিএনসিসি এলাকায় মশা নিধনে নতুন করে পরিকল্পনা চলছে। ফগার মেশিনে গুরুত্ব কমিয়ে লার্ভিসাইটের দিকে জোর দেয়া হয়েছে। ফগার মেশিনের তুলনায় লার্ভিসাইটে বেশি মশা মরে। তবে ফগার মেশিন থেকে পুরোপুরি সরে আসেনি সিটি করপোরেশন। কারণ ফগার মেশিনে মশা নিধনে অর্থের অপচয় হচ্ছে না। বিশ্বের কোথাও ফগার মেশিন উঠে যায়নি।