তুরস্ক-সিরিয়ায় ভয়াবহ ভূমিকম্প
হাজারো মানুষের প্রাণহানি
মৃতের সংখ্যা ১০ হাজার ছাড়িয়ে যেতে পারে : ইউএসজিএস
প্রকাশ : ০৭ ফেব্রুয়ারি ২০২৩, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ
আলোকিত ডেস্ক
তুরস্কে ভয়াবহ ভূমিকম্পে হাজার হাজার মানুষের প্রাণহানির আশঙ্কা করা হচ্ছে। গতকাল ভোরের দিকে দেশটির দক্ষিণাঞ্চলীয় প্রদেশ খারমানমারাসের গাজিয়ানতেপ শহরের কাছে ভূমিকম্পটি আঘাত হানে। সিরিয়া সীমান্তের কাছে আঘাত হানা এই ভূমিকম্পের মাত্রা ছিল ৭ দশমিক ৮। ভূমিকম্পের গভীরতা ছিল ভূপৃষ্ঠ থেকে ১৭ দশমিক ৯ কিলোমিটারে। অল্প সময়ের ব্যবধানে দুটি ভূমিকম্প আঘাত হানে। এই ভূমিকম্প সিরিয়ায়ও অনুভূত হয় এবং সাইপ্রাস ও লেবাননেও ভূমিকম্প পরবর্তী কম্পন অনুভূত হওয়ায় সেখান থেকেও ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতির খবর পাওয়া যায়। শেষ খবর পাওয়া পর্যন্ত তুরস্কে প্রায় ৩ হাজার জন এবং সিরিয়ায় মারা গেছে ১ হাজারেরও বেশি মানুষ। একাধিকবার আফটার শক হওয়ায় মানুষের মধ্যে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে। তুরস্ক ও সিরিয়ায় ভূমিকম্প আঘাত হানার পর অনেক অবকাঠামো ভেঙে পড়ে। অনেক মানুষ ধ্বংস্তুপের মধ্যে আটকা পড়ায় তাদের উদ্ধার তৎপরতা জোরদার করা হলেও বাধ সাধে প্রচন্ড ঠান্ডা ও তুষারপাত।
ভোর বেলা ভূমিকম্প আঘাত হানার সময় অধিকাংশ মানুষ ঘুমিয়ে ছিল। ফলে, তারা ঘটনার আকস্মিকতায় নিরাপদ স্থানের উদ্দেশ্যে বাড়ি-ঘর ছেড়ে যাওয়ার আগেই ধ্বংস্তুপের মধ্যে আটকা পড়ে। দিনের আলো ফোটার সঙ্গে সঙ্গে বাড়তে থাকে প্রাণহানির সংখ্যা। হাসপাতালগুলো পরিপূর্ণ হয়ে যায় আহতদের দিয়ে। তাদের চিকিৎসায় ডাক্তার, নার্স ও সহায়ক চিকিৎসা কর্মীরা ব্যস্ত হয়ে ওঠেন। বিপুল সংখ্যক মানুষ মারাত্মকভাবে আহত হওয়ায় মৃত্যের সংখ্যা আরও বাড়তে পারে বলে আশংকা করা হচ্ছে। খবর বিবিসি, আল-জাজিরা ও সিএনএনের।
পরিস্থিতিকে ট্র্যাজেডি বলে অ্যাখ্যা দিয়ে তুরস্কের প্রেসিডেন্ট রজব তাইয়্যেব এরদোয়ান বলেন, সম্মিলিত প্রচেষ্টায় এ দুর্যোগ কাটিয়ে উঠবো আমরা। নিহতদের পরিবারের প্রতি শোক এবং আহতদের দ্রুত আরোগ্য কামনা করেন তিনি। শক্তিশালী ভূমিকম্প আঘাতের পরপরই উদ্ধারকাজে নামে জরুরি বিভাগ। অন্যান্য উদ্ধারকারী বিভাগও সতর্ক অবস্থানে রয়েছে বলে জানান তিনি।
তুরস্কে ভূমিকম্প আঘাত হানার পর যুক্তরাষ্ট্র ও ভারতসহ বিশ্বের অন্তত ৪৫টি দেশ তুরস্ককে সহায়তার প্রস্তাব দিয়েছে। রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন বলেছেন, ভয়াবহ ভূমিকম্পে ক্ষতিগ্রস্ত সিরিয়া ও তুরস্ককে সহযোগিতার প্রস্তাব দিয়েছে রাশিয়া। এরদোয়ানকে পাঠানো এক বার্তায় পুতিন বলেছেন, আপনার দেশে শক্তিশালী ভূমিকম্পে ব্যাপক প্রাণহানি ও বড় ধরনের ক্ষয়ক্ষতির ঘটনায় আমি গভীর শোক জানাচ্ছি। এ বিষয়ে যে কোনও সহযোগিতা প্রদানে আমরা প্রস্তুত। সিরীয় প্রেসিডেন্ট আসাদকেও প্রায় একই ধরনের বার্তা পাঠিয়েছেন পুতিন।
৮ দশকের বেশি সময়ের মধ্যে রেকর্ড সর্বোচ্চ মাত্রার ভূমিকম্প আঘাত হানার পর মার্কিন ভূতাত্ত্বিক জরিপ সংস্থা ইউএসজিএস জানায়, দক্ষিণ তুরস্কের ভূমিকম্পে মৃতের সংখ্যা ১০ হাজার ছাড়িয়ে যেতে পারে। মার্কিন ভূতাত্ত্বিক জরিপ সংস্থাটি ওই অঞ্চলের ইতোপূর্বে আঘাত হানা ভূমিকম্প, সর্বাধিক কম্পনের আওতাধীন এলাকার জনসংখ্যার কাঠামো এবং সবচেয়ে বেশি আঘাতপ্রাপ্ত অঞ্চলের অবকাঠামো দুর্বলতার ওপর ভিত্তি করে প্রাণহানির এই সংখ্যা প্রকাশ করেছে।
ইউএসজিএস বলেছে, তুরস্কে ভূমিকম্পে প্রাণহানি এক হাজার থেকে ১০ হাজার জনে পৌঁছানোর সম্ভাবনা ৪৭ শতাংশ। ভয়াবহ এই ভূমিকম্পে আর্থিক ক্ষতি ১০০ কোটি ডলার থেকে এক হাজার কোটি ডলারের মধ্যে হতে পারে; যা তুরস্কের জিডিপির প্রায় ২ শতাংশের সমান। ভূমিকম্প বিশ্লেষকদের অনেকে বলছেন, তুরস্কে এই ভূমিকম্প ৮ দশকের বেশি সময়ের মধ্যে সবচেয়ে শক্তিশালী। ৮০ বছরেরও বেশি সময় আগে দেশটিতে আজকের মতো শক্তিশালী এক ভূমিকম্প আঘাত হেনেছিল।
ইউনিভার্সিটি কলেজ লন্ডনের ভূতাত্ত্বিক স্টিফেন হিকস বলেন, আগের সবচেয়ে বড় ভূমিকম্পটিও ৭ দশমিক ৮ মাত্রার ছিল। সেটি ১৯৩৯ সালের ডিসেম্বরে উত্তর-পূর্ব তুরস্কে আঘাত হানে এবং এতে ৩০ হাজার মানুষ মারা যায়।
এর আগে, ২০২০ সালের জানুয়ারিতে দেশটির পূর্বাঞ্চলীয় শহর এলাজিগে ৬ দশমিক ৭ মাত্রার শক্তিশালী ভূমিকম্প আঘাত হানে। এতে অন্তত ৪১ জন নিহত ও এক হাজার ৬০০ জনের বেশি আহত হয়। এদিকে, সিরিয়ার জাতীয় ভূমিকম্প কেন্দ্রের প্রধান রায়েদ আহমেদ রাষ্ট্রীয় এক রেডিও স্টেশনকে জানান, এই ভূমিকম্প তাদের ভূকম্প কেন্দ্রের ইতিহাসে রেকর্ড করা সবচেয়ে শক্তিশালী ভূমিকম্প। তুরস্কের দক্ষিণ এবং সিরিয়ার উত্তরাঞ্চলে আঘাত হানা শক্তিশালী ভূমিকম্পের আঘাতে হু হু করে বাড়ছে হতাহতের সংখ্যা। ব্রিটিশ দৈনিক দ্য গার্ডিয়ান বলছে, শক্তিশালী ভূমিকম্পে কেঁপে উঠেছে তুরস্ক ও সিরিয়া। ভূমিকম্পে হাজার হাজার বাড়িঘর ধ্বংস হয়েছে। সিরিয়ার আলেপ্পো এবং হামা শহর থেকে তুরস্কের দিয়ারবাকির পর্যন্ত উত্তর-পূর্বাঞ্চলের ৩৩০ কিলোমিটারের বেশি বিস্তৃত আন্তঃসীমান্ত এলাকায় অসংখ্য ভবন ধসে পড়ার খবর পাওয়া গেছে।
তুরস্কের ভাইস-প্রেসিডেন্ট ফুয়াত ওকতে বলেছেন, তুরস্কের গজিয়ানতেপ এবং কাহরামানমারাস প্রদেশে প্রায় ৯০০টি ভবন ধ্বংস হয়েছে। তুরস্কের ভূমিকম্পে আটকে পড়াদের উদ্ধার কাজে পূর্ণ গতি আনা সম্ভব হচ্ছে না; সবচেয়ে বড় কারণ ঠান্ডা-ভেজা আবহাওয়া ও তুষারপাত। দেশটির আবহাওয়া দপ্তরের বরাত দিয়ে আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, রোববার তুরস্কের দক্ষিণাঞ্চলে তাপমাত্রা ৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস ছিল। গতকাল তা আরও নেমে যায়। ভূমিকম্পের পর থেকেই উদ্ধার তৎপরতা শুরু করে তুরস্কের সরকারি দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা দপ্তরের কর্মীরা। তবে বৈরী আবহাওয়ার কারণে ব্যাহত হয় উদ্ধার তৎপরতা। তুষারাচ্ছন্ন রাস্তা-ঘাটে শীতের কাপড় ছাড়া দীর্ঘসময় বাইরে থাকা অসম্ভব। ধ্বংসস্তুপের মধ্যে যারা জীবিত আছেন, তাদের জন্য গরম কাপড়, খাবার ও পানির ব্যবস্থা না করা না গেলে প্রাণহানির সংখ্যা আরও বাড়তে পারে।
ভূমিকম্পে ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতির শিকার তুরস্কে সহায়তা পাঠানোর নির্দেশ দিয়েছেন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন। এ তথ্য জানিয়েছেন প্রেসিডেন্টের জাতীয় নিরাপত্তা বিষয়ক উপদেষ্টা জ্যাক সুলিভান। তিনি বলেন, তুরস্ক ও সিরিয়ায় বিধ্বংসী ভূমিকম্পের ঘটনায় যুক্তরাষ্ট্র গভীরভাবে উদ্বিগ্ন। এই দুর্যোগে তুরস্ককে সব প্রকার সহায়তার জন্য আমরা প্রস্তুত।
হোয়াইট হাউসের এক কর্মকর্তা জানিয়েছেন, প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন ইতোমধ্যে যুক্তরাষ্ট্রের কেন্দ্রীয় সরকারের আন্তর্জাতিক উন্নয়ন সংস্থা ও সরকারি অন্যান্য সরকারি সংস্থাকে তুরস্ক ও সিরিয়ার পরিস্থিতি পর্যালোচনা ও সহায়তা পাঠানোর ব্যাপারটি দেখভাল করার নির্দেশ দিয়েছেন।
প্রতিবেশী দেশ সিরিয়াতেও বাড়ছে নিহতের সংখ্যা। সিরিয়ার স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, পরিস্থিতি বিবেচনায় উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলে জরুরি অবস্থা জারি করা হয়েছে। একইসঙ্গে আন্তর্জাতিকভাবে মানবিক সহায়তার আহ্বান জানিয়েছে দেশটি। নিহতদের প্রতি শোক বার্তা পাঠিয়ে সহায়তার প্রস্তাব দিয়েছে বিশ্ব নেতারা। তুরস্কে নিহতদের পরিবারের প্রতি গভীর শোক জানিয়েছেন ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কি। এক শোকবার্তায় তিনি বলেন, এই দুঃসময়ে তুরস্কের পাশে আছি আমরা। দুর্যোগ কাটিয়ে উঠতে দেশটিকে সব ধরনের প্রয়োজনীয় সহায়তা দিতে প্রস্তুত কিয়েভ। ভূমিকম্পে প্রাণহানি ও ক্ষয়ক্ষতিতে মর্মাহত হয়ে শোক জানিয়েছেন ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি। তিনি বলেন, এই বিপর্যয় কাটিয়ে উঠতে সম্ভাব্য সব ধরণের সহায়তা দিতে আছে দিল্লি প্রস্তত রয়েছে। পাকিস্তানও সহায়তার প্রস্তাব দিয়েছে তুরস্ক ও সিরিয়াকে। এই দুই দেশের জনগণকে ধৈর্য ধরার আহ্বান জানিয়েছেন পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী শাহবাজ শরীফ। ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী আইজ্যাক হারজোগ সম্ভাব্য সহায়তা দিতে তার দেশের প্রস্তুতির কথা জানিয়েছেন।