এলএনজি-এলপিজি নিয়ে নৈরাজ্য

প্রকাশ : ০৮ ফেব্রুয়ারি ২০২৩, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ

  ফারুক আলম

দেশজুড়ে গৃহস্থালিতে গ্যাস সংকট চরম আকার ধারণ করেছে। বছরের পর বছর গ্যাস সংকটের পরও পাইপলাইন গ্যাসের চুলার বিল দিতে হচ্ছে গ্রাহকদের। লাইনে গ্যাস সংকট ও সংযোগ বন্ধে একচেটিয়া ব্যবসা করছে তরলীকৃত পেট্রোলিয়াম গ্যাসের (এলপিজি) বেসরকারি খাতের কোম্পানিগুলো। এতে এলপিজির চাহিদা বেড়েছে কয়েক গুণ। এই সুযোগে সরকারের নির্ধারিত দামের চেয়েও খুচরা পর্যায়ে এলপিজি সিলিন্ডারপ্রতি প্রায় ২০০ টাকা বেশি নেয়া হচ্ছে। গৃহস্থালিতে গ্যাসের সংকট ও দাম নৈরাজ্য সহজেই সমাধান হবে না বলে জানায় বাংলাদেশ তেল, গ্যাস ও খনিজসম্পদ করপোরেশন (পেট্রোবাংলা) ও তিতাস গ্যাস ট্রান্সমিসন অ্যান্ড ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি লিমিটেড (তিতাস গ্যাস)।

দেশের বৃহত্তম গ্যাস বিতরণকারী সংস্থা তিতাসের আওতাধীন গ্রাহকরা গ্যাস পাচ্ছেন না। পাইপলাইন সংযোগ থাকলেও কাঙ্ক্ষিত বা চাহিদা অনুযায়ী চাপে ও পরিমাণে গ্যাস পাচ্ছেন না তারা। এ বিষয়ে তিতাস গ্যাসের সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, গত বছরের জুন থেকে তরলীকৃত প্রাকৃতি গ্যাস (এলএনজি) আমদানি বন্ধ রাখা হয়েছে। এখন পর্যন্ত আমদানি করা হয়নি। ফলে রাজধানীজুড়ে গ্যাসের সংকট চলছে। সহসা রান্নার গ্যাস সংকট নিরসন হবে না। অন্যদিকে জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ বিভাগ এবং পেট্রোবাংলা সূত্র জানায়, দেশের বাইরে থেকে এলএনজি আমদানি হলেও সেটি বাসাবাড়ির রান্নার জন্য নয়, বিদ্যুৎ উৎপাদনে ব্যবহৃত হচ্ছে। বাসাবাড়িতে গ্যাস সংকট থাকবে, এটি নিরসন হবে না।

টঙ্গী এলাকার গৃহিণী নাজিমা বেগমের বাড়িতে লাইনের গ্যাসের চুলা থাকার পরও ঘরের বাইরে মাটির চুলা পেতে বসেছেন। চারিদিকে রান্নার সামগ্রী ছড়ানো-ছিটানো। চুলা থেকে ধোঁয়া বের হচ্ছিল। চোখ ডলতে ডলতে মাটির চুলার মুখে ফুঁ দিচ্ছিলেন তিনি। লাইনের গ্যাসের চুলার মাসে মাসে বিল দিলেও রান্না করতে পারছেন না। তাই বাধ্য হয়ে নাজিমা বেগম মাটির চুলায় প্রতিদিন রান্না করছেন। মাটির চুলায় রান্না না হলে তিনজনের সংসারের সবাইকে না খেয়ে থাকতে হবে।

আক্ষেপ করে নাজিমা বেগম বলেন, কয়েক মাস আগেও দিনের সময় মোমবাতির মতো টিমটিম করে চুলা জ্বলত। দিনে গ্যাস না থাকলেও রাত ১১টা থেকে পরের দিন ভোররাত ৫টা পর্যন্ত সামান্য গ্যাস পাওয়া যেত। রাত জেগে, কষ্ট করে বাড়ির রান্নার কাজ করতাম। কয়েক দিন ধরে দিন-রাতের কোনো সময় গ্যাস পাচ্ছি না। ইলেকট্রিক চুলায় বা সিলিন্ডার গ্যাসে রান্নার সামর্থ্য নেই। দেশের সর্বত্র গ্যাসের তীব্র সংকট। গ্যাস না পাওয়ায় রান্না করতে পারছেন না তিতাস গ্যাসের গ্রাহকরা। নিরুপায় হয়ে অনেকে মাটির চুলা, এলপি গ্যাসের সিলিন্ডার এবং বৈদ্যুতিক চুলা দিয়ে রান্নার কাজ সেরে নিচ্ছেন।

রাজধানীর টঙ্গী, কামারপাড়া, উত্তরা, মোহাম্মদপুর ও মাতুয়াইল এলাকায় গিয়ে দেখা যায়, অনেক গৃহিণী বাড়ির সামনেই মাটির চুলায় রান্না বসিয়েছেন। চুলায় রান্না করার জন্য অপেক্ষায় বসে আছেন আরও কয়েকজন নারী। তারা বলছেন, ‘গ্যাস সংকট দিন দিন আরও তীব্র হচ্ছে। চুলায় দিন-রাতের কখনোই গ্যাস পাচ্ছি না। তাই বাধ্য হয়ে কখনো গ্যাসের সিলিন্ডারে আবার কখনো মাটির চুলায় রান্না করি।

পাইপলাইনে গ্যাস সংকট থাকায় এলপিজি সিলিন্ডারের চাহিদা বাড়ায় বাড়তি দামে এলপিজি বিক্রি করতে দেখা গেছে শনিরআখড়া এলাকায়। এই এলাকার পান্না এন্টারপ্রাইজ ও সাদ্দাম এন্টারপ্রাইজ দোকানে ১ হাজার ৭০০ টাকায় গ্যাস সিলিন্ডার বিক্রি হচ্ছে। এই দোকান থেকে গ্যাসের সিলিন্ডার নিয়ে বাড়ি যাচ্ছিলেন সিরাজ তালুকদার। তিনি বলেন, ১ হাজার ৭০০ টাকায় কিনেছেন সিলিন্ডারটি। সরকারি নির্ধারিত দামটি জানা থাকার পরও বেশি দামে সিলিন্ডার কেনার কারণ প্রসঙ্গে সিরাজ বললেন, বাসায় গ্যাস নেই, রান্না বন্ধ হয়েছে। আমার তো উপায় নেই। এর চেয়ে কম দামে কেউ গ্যাস সিলিন্ডার বিক্রি করছেন না। আমরা জিম্মি অবস্থায় আছি।

মাতুয়াইল এলাকার গ্যাস বিক্রেতা সাদ্দাম হোসেন আলোকিত বাংলাদেশকে বলেন, তিনি ১২ কেজি সিলিন্ডারের দাম নিচ্ছেন ১ হাজার ৭০০ টাকা। অথচ এক সপ্তাহ আগেই ১২ কেজি গ্যাস সিলিন্ডারের দাম দেড় হাজার টাকা নিয়েছেন। সরকার নির্ধারিত দামের কথা উল্লেখ করলে তিনি বলেন, সরকার দাম নির্ধারণ করেছে ঠিকই, কিন্তু সরকার তো গ্যাস দেয় না, ডিলারদের কাছ থেকে ১ হাজার ৬০০ টাকায় গ্যাস নিতে হয়। এমন অবস্থায় সরকার নির্ধারিত দামে গ্যাস বিক্রি করলে সিলিন্ডার প্রতি ১০২ টাকা করে লোকসান গুনতে হবে। বর্তমানে গ্যাসের সিলিন্ডার সংকট তৈরি হয়েছে।

রামপুরায় এলপিজি সিলিন্ডারের দাম বেশি নেয়া হচ্ছে। রামপুরার উলন রোডের ভাই ভাই এন্টারপ্রাইজের বিক্রেতা শাহ আলম বলেন, দোকানে কয়েকটি গ্যাস সিলিন্ডার আছে, চায়ের দোকানিদের দিতে হবে। ১২ কেজি সিলিন্ডারের দাম ১ হাজার ৭০০ টাকায় নেয়া হচ্ছে। সিলিন্ডারের প্রকারভেদে দামের কিছু তারতম্য রয়েছে। ইস্পাতের তৈরি সিলিন্ডার ১ হাজার ৬৫০ এবং ফাইবারের সিলিন্ডার ১ হাজার ৭০০ টাকায় বিক্রি করা হয়।

বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশন (বিইআরসি) সর্বশেষ ১২ কেজি গ্যাসের একটি সিলিন্ডারের খুচরা পর্যায়ে ১ হাজার ৪৯৮ টাকা নির্ধারণ করেছে। তবে খুচরা বাজারে ১২ কেজি সিলিন্ডারের দাম ১ হাজার ৬০০ থেকে ১ হাজার ৮০০ টাকা বিক্রি করা হচ্ছে। রাজধানীর বিভিন্ন এলাকার গ্যাস বিক্রেতাদের ও ক্রেতাদের সঙ্গে কথা বলে এ তথ্য জানা গেছে। বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশন (বিপিসি) সূত্র বলছে, সারা দেশে কমবেশি ৬০টি কোম্পানি এলপিজির ব্যবসা করতে লাইসেন্স নিয়েছে। এর অর্ধেক কোম্পানি বর্তমানে বাজারে সক্রিয়। এর মধ্যে ২০টি কোম্পানি সরাসরি আমদানি করে।

জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ বিভাগের অতিরিক্ত সচিব (পরিকল্পনা) মো. হুমায়ুন কবীর আলোকিত বাংলাদেশকে বলেন, আন্তর্জাতিক বাজারে তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাসের (এলএনজি) দাম কমেছে, সেজন্য নিয়মিত সরকার টু সরকার ও খোলাবাজার (স্পটমার্কেট) থেকে এলএনজি আমদানি করা হচ্ছে। তবে গৃহস্থলিতে গ্যাস সরবরাহের বিষয়টি পেট্রোবাংলার দায়িত্ব।

বিইআরসির সদস্য (পেট্রোলিয়াম) মো. কামরুজ্জামান আলোকিত বাংলাদেশকে বলেন, তারা খুচরা বাজারে এলপিজি গ্যাসের দাম নির্ধারণ করে দেয়। নির্ধারিত দামের চেয়েও গ্রাহকের কাছ থেকে টাকা বেশি নেয়ার সুযোগ নেই। এর আগে মাঠপর্যায়ে গিয়ে দেখা গেছে- এলপিজি সিলিন্ডার প্রতি ৫০ থেকে ৬০ টাকা বেশি নিচ্ছেন খুচরা ব্যবসায়ীরা। কারণ হিসেবে- গ্রাহকের বাসায় সিলিন্ডার পৌঁছে দেয়ার জন্য ৫০ টাকা বেশি নিচ্ছে। এরপরও ভোক্তা অধিকার ও জেলা পর্যায়ে জেলা প্রশাসক সিলিন্ডারের দাম নিয়ন্ত্রণ করছে। এবারই খুচরা পর্যায়ে এলপিজির দাম বেশি নেয়া হচ্ছে বলে অভিযোগ এসেছে।

তিতাস গ্যাসের অফিসের ইমার্জেন্সি ব্যবস্থাপক সাবিউল আউয়াল আলোকিত বাংলাদেশকে বলেন, খোলাবাজারে এলএনজির দাম বাড়ায় গত বছরের জুন থেকে আমদানি বন্ধ রাখা হয়েছে। সেজন্য পাইপলাইনে গ্যাস সংকট তৈরি হয়েছে। কবে নাগাদ এলএনজি আমদানি হবে সেটিও সুনির্দিষ্ট দিকনির্দেশনা নেই।

তিনি আরও বলেন, আবাসিকে পার মিটার কিউব ১৮ টাকা ধরা হয়েছে, এই ১৮ টাকার মধ্য থেকে তিতাস মাত্র ১৩ পয়সা পায়। বাকি টাকা পেট্রোবাংলা, এনবিআরসহ সরকারের বিভিন্ন খাতে চলে যায়। বাণিজ্যি রেটের ক্ষেত্রে ১৩ পয়সা পায়।

পেট্রোবাংলা পরিচালক (অপারেশন অ্যান্ড মাইনস) প্রকৌশলী মো. কামরুজ্জামান খান আলোকিত বাংলাদেশকে বলেন, বাসাবাড়ির জন্য এলএনজি আমদানি করা হচ্ছে না, বিদ্যুৎ ও শিল্পের জন্য আমদানি করা হচ্ছে। গৃহস্থালির গ্যাসের সংকট সারা বছর থাকবে।

তিনি আরও বলেন, রাশিয়া ও ইউক্রেনে যুদ্ধ চলছে। যুদ্ধাবস্থায় এলএনজি আমদানি আমাদের নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে গেছে। ৩০০ কোটি টাকার কার্গো জাহাজে আমদানি করতে এখন ৯০০ কোটি টাকা লাগছে।

কনজ্যুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) জ্বালানিবিষয়ক উপদেষ্টা অধ্যাপক এম শামসুল আলম বলেন, সরকারের নির্ধারিত দামের চেয়ে বেশি নেয়া দণ্ডনীয় অপরাধ। গ্রাহকরা ইচ্ছা করলে জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরে অভিযোগ করতে পারবেন। এতে যেসব খুচরা ব্যবসায়ী নির্ধারিত দামের চেয়ে অতিরিক্ত দাম নিচ্ছে তাদের বিরুদ্ধে আইন অনুযায়ী ব্যবস্থা গ্রহণ করা যাবে।