তুরস্ক-সিরিয়ায় দীর্ঘ হচ্ছে মৃত্যুর মিছিল

* প্রাণহানি ১১ হাজার ছাড়াল * আহতের সংখ্যা কয়েকগুণ বেশির আশঙ্কা

প্রকাশ : ০৯ ফেব্রুয়ারি ২০২৩, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ

  এএইচএম ফারুক

তুরস্ক ও সিরিয়ায় ভূমিকম্পে মৃতের সংখ্যা গতকাল নাগাদ ১১ হাজার ছাড়িয়েছে। এর মধ্যে তুরস্কে মৃত্যু হয়েছে ৮ হাজার ৫৭৪ জনের। আর সিরিয়ায় মারা গেছেন ২ হাজার ৬৬২ জন। সব মিলিয়ে দুই দেশে মোট নিহতের সংখ্যা ১১ হাজার ২৩৬ জনে পৌঁছেছে। হতাহতের সংখ্যা আরও অনেক বাড়বে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। তুরস্কের দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষ ও সিরিয়ার রাষ্ট্রীয় গণমাধ্যম সূত্রে এ তথ্য জানা গেছে। ধ্বংসযজ্ঞের যে ধরন, তাতে হতাহতের সংখ্যা এখনকার কয়েকগুণ হতে পারে বলেই আশঙ্কা করা হচ্ছে। ভয়াবহ এই ভূমিকম্প ওই অঞ্চলের ২ কোটি ৩০ লাখ মানুষের ওপর প্রভাব ফেলতে পারে বলে সতর্ক করে দিয়েছে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা।

গত সোমবার স্থানীয় সময় ভোর ৪টা ১৭ মিনিটে তুরস্ক ও সিরিয়ার সীমান্তবর্তী অঞ্চলে প্রথমে ৭ দশমিক ৮ মাত্রার ভূমিকম্প হয়। ওই ভূমিকম্পের ১৫ মিনিট পর ৬ দশমিক ৭ মাত্রার আরও একটি বড় ভূমিকম্প এবং পরে আরও অনেকগুলো আফটারশক বা শক্তিশালী পরাঘাত হয়। এতে দুই দেশে ধসে পড়েছে কয়েক হাজার ভবন। এসব ভবনের নিচে আটকা পড়েছেন বহু মানুষ। ধ্বংসস্তূপ সরানোর সঙ্গে সঙ্গে বাড়ছে লাশের সংখ্যা।

ভূমিকম্পে দুই দেশে মৃতের সংখ্যা ২০ হাজার ছাড়িয়ে যেতে পারে বলে আশঙ্কা করছে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা। সংস্থাটি বলেছে, তুরস্ক-সিরিয়ায় ভূমিকম্পে ক্ষতিগ্রস্ত এলাকাগুলোর মানচিত্রে দেখা যাচ্ছে, এসব এলাকায় ২ কোটি ৩০ লাখ মানুষের বসবাস। ভূমিকম্পের কারণে সেখানকার সবাই কোনো না কোনোভাবে সংকটে পড়েছেন। দুই দেশের ক্ষতিগ্রস্ত এলাকাগুলোতে লাখ লাখ মানুষ এখন খোলা আকাশের নিচে রয়েছে।

আর তুরস্কের দুর্যোগ ও জরুরি পরিস্থিতি ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষ বলছে, দেশটিতে ভূমিকম্পে সরাসরি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন ১ কোটি ৩৫ লাখ মানুষ। এর মধ্যে তুরস্কে আহতের সংখ্যা ৫০ হাজারের কাছাকাছি পৌঁছেছে। আর সিরিয়ায় এ সংখ্যা ৫ হাজারে দাঁড়িয়েছে বলে জানা গেছে।

এদিকে ভূমিকম্প নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের ভূতাত্ত্বিক জরিপ সংস্থা ইউএসজিএসের তাৎক্ষণিক এক বিবৃতিতে বলা হয়, তুরস্কের দক্ষিণাঞ্চীলয় কাহমানমারাস প্রদেশের গাজিয়ানতেপ শহরের কাছে ভূপৃষ্ঠের ১৭ দশমিক ৯ কিলোমিটার গভীরে ছিল ভূমিকম্পটির উৎপত্তিস্থল। সোমবারই আর এক বিবৃতিতে ইউএসজিস জানিয়েছিল, শক্তিশালী এই ভূমিকম্পে তুরস্ক ও সিরিয়ায় মৃতের সংখ্যা ১০ হাজার ছাড়িয়ে যাবে এবং এটি এক লাখে পৌঁছে যাওয়ারও শঙ্কা আছে।

ভূমিকম্প নিয়ে একাধিক আন্তর্জাতিক সংবাদ মাধ্যমের সূত্রে জানা গেছে, বহু ভবনের ধ্বংসস্তূপে এখনও চাপা পড়ে আছে শত শত লাশ। তাদের সঙ্গে আটকা পড়ে আছেন হাজার হাজার আহত মানুষও। বিপর্যয়ের যে ব্যাপকতা, তাতে উদ্ধারকর্মীদের সার্বক্ষণিক তৎপরতা সত্ত্বেও মৃতের হার আরও বৃদ্ধির সমূহ আশঙ্কা আছে।

তুরস্কের হাতায় প্রদেশে বিভিন্ন হাসপাতালের সামনে পড়ে আছে সারি সারি কম্বল বা কাপড়ে জড়ানো মৃতদেহ। ভূমিকম্পের আঘাতে ধসে পড়া বিভিন্ন ভবনের বাসিন্দাদের কেউ রাত কাটাচ্ছেন গাড়ির ভেতরে কেউবা খোলা আকাশের নিচে। এদিকে, যারা শারীরিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হননি তাদের সামনে প্রকট হয়ে উঠছে আশ্রয় ও খাদ্যসংকট। অনেক এলাকায় এখনো কোনো ত্রাণসামগ্রী পৌঁছায়নি। তুরস্কের দক্ষিণাঞ্চলীয় শহর আন্তাকিয়ার বাসিন্দা মেলেক রয়টার্সকে বলেন, তার এলাকায় গত দু’দিনে কোনো ত্রাণ আসেনি। ৬৪ বছর বয়সি এই নারী বলেন, ‘এর আগে যত দুর্যোগ এসেছে, দ্রুত খাদ্য সহায়তা পাওয়া গেছে; কিন্তু এবার দু’দিন পেরিয়ে গেলেও আমরা কোনো ত্রাণ পাইনি।’ ‘খাবার নেই, তাঁবু নেই, এই ঠান্ডায় খোলা আকাশের নিচে অভুক্ত অবস্থায় আমরা কী করে বাঁচব!’

ঠান্ডায় জমে যাচ্ছে মানুষ, ধ্বংসস্তূপে বোবা কান্না

সোমবারের ভূমিকম্পে ধ্বংস হয়ে যাওয়া ভবনের নিচে আটকেপড়া শত শত মানুষকে উদ্ধার করা কঠিন হয়ে পড়েছে। দেশ দুটির উদ্ধারকারীরা বলেছেন, তীব্র ঠান্ডা এবং বৈরী আবহাওয়ার কারণে লোকজনকে জীবিত উদ্ধারের সময় দ্রুতই ফুরিয়ে আসছে। ধ্বংসস্তূপের নিচ থেকে লোকজনকে উদ্ধারে সময়ের বিপরীতে লড়াই করতে হচ্ছে তাদের।

দীর্ঘদিনের যুদ্ধে এরই মধ্যে বিধ্বস্ত হয়ে যাওয়া তুরস্ক সীমান্ত লাগোয়া সিরিয়ার কিছু শহরে ভূমিকম্পের আঘাত অত্যন্ত তীব্র হয়েছে। এসব সীমান্ত এলাকায় প্রাণহানি ও ক্ষয়ক্ষতিও হয়েছে অনেক বেশি। সিরিয়ায় ভূমিকম্পে বেঁচে যাওয়া লাখ লাখ মানুষ এখন খোলা আকাশের নিচে রাস্তায় বাড়িঘরের ধ্বংসাবশেষ জ্বালিয়ে ঠান্ডা থেকে বাঁচার চেষ্টা করছেন। ভূমিকম্পে ক্ষতিগ্রস্ত অঞ্চলগুলোতে আন্তর্জাতিক সহায়তা মাত্র পৌঁছাতে শুরু করেছে। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে ভূমিকম্পের প্রলয়ঙ্করী ধ্বংসযজ্ঞ থেকে মানুষের বেঁচে যাওয়ার অনেক গল্পও প্রকাশিত হচ্ছে। যেমন সিরিয়ায় ধ্বংসস্তূপের নিচে সদ্যোজাত এক শিশুকে জীবিত উদ্ধার করা হয়েছে। যদিও তার নাভি বাঁধা ছিল মৃত মায়ের সঙ্গে। এই শিশুর মা ভূমিকম্পে মারা গেছেন। ওই শিশুর এক স্বজন খলিল আল-সুওয়াদি ফরাসি বার্তা সংস্থা এএফপিকে বলেছেন, আমরা ধ্বংসস্তূপ খনন করার সময় একটি কণ্ঠ শুনতে পাই। আমরা ধ্বংসাবশেষ সরিয়ে ফেলার পর মৃত মায়ের সাথে নাভি বাধা অবস্থায় নবজাতকটিকে পাই। পরে নাভি কেটে তাকে উদ্ধার করা হয়। আমার চাচাতো ভাই তাকে হাসপাতালে নিয়ে গেছে।

বর্তমানে এই শিশুটিই তার পরিবারে একমাত্র জীবিত সদস্য। তার পরিবারের বাকি সদস্যরা সিরিয়ার বিদ্রোহী নিয়ন্ত্রিত জিন্দারিস শহরে ভূমিকম্পে নিহত হয়েছেন।

সোমবার স্থানীয় সময় ভোরের দিকে সিরিয়া ও তুরস্কে যখন শক্তিশালী এ ভূমিকম্প আঘাত হানে। তখন সেখানে লোকজন ঘুমিয়ে ছিলেন। স্মরণকালের এই ভয়াবহ ভূমিকম্পে হাজার হাজার বাড়িঘর ধ্বংস হয়েছে এবং অসংখ্য মানুষ ধ্বংসস্তূপের নিচে আটকা পড়েছেন। কেন্দ্রস্থলের কাছের শহর তুরস্কের গাজিয়ানতেপ এবং কাহরামানমারাসে প্রচণ্ড ধ্বংসলীলা চালিয়েছে এই ভূমিকম্প। এই দুুই শহরের বেশিরভাগ ভবন ধসে পড়েছে।

ধ্বংসযজ্ঞের ভয়াবহতায় তুরস্কের প্রেসিডেন্ট রিসেপ তাইয়েপ এরদোয়ান মঙ্গলবার দেশটির দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলীয় ১০টি প্রদেশে তিন মাসের জন্য জরুরি অবস্থা ঘোষণা করেছেন।

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, চীন এবং উপসাগরীয় দেশগুলোসহ বিশ্বের কয়েক ডজন দেশ সহায়তার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। এরই মধ্যে বিভিন্ন দেশের উদ্ধারকারী দল ও ত্রাণ সরবরাহ আকাশপথে পৌঁছাতে শুরু করেছে।

কিন্তু সর্বোচ্চ ক্ষতিগ্রস্ত কিছু এলাকার বাসিন্দারা বলছেন, তাদের রক্ষা করার প্রচেষ্টা ছেড়ে দেয়া হয়েছে বলে মনে করছেন তারা। তুরস্কের কাহরামানমারাস শহরের বাসিন্দা আলি সাগিরোগলু বলেন, ‘আমি আমার ভাইকে ধ্বংসাবশেষ থেকে ফিরে পাব না; আমি আমার ভাগ্নেকে ফিরে পাব না। চারপাশে দেখুন, এখানে কোনো সরকারি কর্মকর্তা নেই।’ তিনি বলেন, ‘দুই দিন ধরে আমরা এখানে সরকারি কাউকে দেখতে পাইনি... শিশুরা ঠান্ডায় জমে যাচ্ছে।’

শীতকালীন ঝড় তুরস্কের অনেক রাস্তায় দুর্দশা বাড়িয়ে দিয়েছে, ভূমিকম্পে ক্ষতিগ্রস্ত অনেক সড়ক প্রায় চলাচলের অযোগ্য হয়ে পড়েছে। কিছু অঞ্চলে কয়েক কিলোমিটার পর্যন্ত যানজট সৃষ্টি হয়েছে। বাড়িঘর ছেড়ে রাস্তায় আসা লোকজনের জন্য নতুন বিপদ তৈরি করেছে শীতল বৃষ্টি আর তুষারপাত। লাখ লাখ মানুষ দেশটির মসজিদ, স্কুল, এমনকি বাস স্টেশনে আশ্রয় নিয়েছে। আর ধ্বংসাবশেষের নিচে চাপা পড়া অনেকে এখনও উদ্ধারের আশায় অপেক্ষার প্রহর গুনছেন। তবে তাদের জীবিত উদ্ধারের আশা দ্রুতই ফুরিয়ে আসছে বলে তুর্কি কর্মকর্তারা জানিয়েছেন।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (ডব্লিউএইচও) প্রধান টেড্রোস আধানোম গেব্রেইয়েসুস বলেছেন, তুরস্ক ও সিরিয়ায় এখন সময়ের বিরুদ্ধে লড়াই চলছে। আহত এবং সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণদের প্রয়োজনীয় স্বাস্থ্যসেবা প্রদানের জন্য আমরা জরুরি মেডিক্যাল টিমের নেটওয়ার্ক চালু করেছি। বিশ্বের অন্যতম সক্রিয় ভূমিকম্পপ্রবণ অঞ্চলে তুরস্কের অবস্থান। এর আগে ১৯৩৯ সালে দেশটিতে সোমবারের মতো ৭ দশমিক ৮ মাত্রার এক ভূমিকম্প আঘাত হেনেছিল। ওই ভূমিকম্পে দেশটির পূর্ব এরজিনকান প্রদেশে অন্তত ৩৩ হাজার মানুষ নিহত হয়। এরপর ১৯৯৯ সালে তুরস্কের ডুজসে অঞ্চলে ৭ দশমিক ৪ মাত্রার ভূমিকম্পে ১৭ হাজারের বেশি মানুষ মারা যায়।