ঢাকা ২০ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ৫ আশ্বিন ১৪৩১ | বেটা ভার্সন

তুরস্ক-সিরিয়ায় ভয়াবহ ভূমিকম্প

মৃত ছাড়াল ১৬ হাজার

* প্রবল ঠান্ডার মধ্যে চলছে উদ্ধারকাজ * ২১ বাংলাদেশিকে আঙ্কারায় স্থানান্তর
মৃত ছাড়াল ১৬ হাজার

স্মরণকালের শক্তিশালী ভূমিকম্পে তুরস্ক ও সিরিয়ার উত্তরাঞ্চলে নিহতের সংখ্যা ১৬ হাজার ছাড়িয়ে যাওয়ার পথে। প্রবল ঠান্ডায় দুর্গতরা আশ্রয়, পানি, জ্বালানি ও বিদ্যুৎবিহীন থাকায় অনেকই প্রাণ হারাতে পারেন বলে আশঙ্কা করছে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা। গত সোমবার ভোররাতের ৭ দশমিক ৮ মাত্রার ভূমিকম্পের পর থেকে ৭২ ঘণ্টার সময়সীমা পার হয়ে গেছে, ফলে মৃত্যুর সংখ্যা দ্রুত বাড়বে বলে ধারণা বিশেষজ্ঞদের। আন্তর্জাতিক গণমাধ্যম বিবিসি, আল-জাজিরা ও রয়টার্স সূত্রে এসব তথ্য জানা গেছে। সূত্রগুলোর তথ্য অনুযায়ী গতকাল সকালে তুরস্কে মৃতের সংখ্যা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১২৮৭৩ জনে। অপরদিকে সিরিয়ায় মৃতের সংখ্যা ৩০০০ ছাড়িয়ে গেছে বলে দেশটির সরকার ও বিদ্রোহী নিয়ন্ত্রিত এলাকার উদ্ধারকারী পরিষেবা হোয়াইট হেলমেট জানিয়েছে।

সূত্রগুলো বলছে- একদিকে ধ্বংসস্তূপের পাহাড় জমেছে, অন্যদিকে প্রকৃতিতে নেমে এসেছে ভয়াবহ শীত। এ কারণে চরম বিপদে পড়েছে ভূমিকম্পে ক্ষতিগ্রস্ত মানুষ। ধ্বংসস্তূপের নিচে এখনো আটকে রয়েছে অনেকেই। ক্ষুধার পাশাপাশি প্রচণ্ড ঠান্ডার সঙ্গেও লড়তে হচ্ছে তদের। চরম প্রতিকূল আবহাওয়ায় বিলম্বিত হচ্ছে উদ্ধারকাজ।

এসবের জেরে সময় যত গড়াচ্ছে, ধ্বংসস্তূপ থেকে জীবিত ব্যক্তিদের উদ্ধারের আশা ততই কমে আসছে। আর এ পরিস্থিতিতে ভূমিকম্পে ক্ষতিগ্রস্ত মানুষের মধ্যে ক্ষোভ ও হতাশা তৈরি হয়েছে। তদের মতে, সরকার যথাযথভাবে সাড়া দিতে ব্যর্থ হয়েছে। এ কারণে ভূমিকম্পের পরে ধ্বংসস্তূপ থেকে যাদের জীবিত উদ্ধারের সম্ভাবনা রয়েছে, তারাও মৃত্যুর মুখে পড়েছে। অনেকেই খাদ্য ও আশ্রয়ের জন্য ছুটছেন। যাদের স্বজনরা এখনো ধ্বংসস্তূপের নিচে আটকে রয়েছেন, তদের অসহায়ত্ব আরও বেশি। কেউ কেউ বলছেন, ধ্বংসস্তূপের নিচ থেকে স্বজনদের উদ্ধারের আকুতি তারা শুনছেন। তবে তারা কিছু করতে পারছেন না।

তুরস্কের হাতায়ে শহরের একটি কিন্ডারগার্টেনের শিক্ষক সেমির কোবান। তিনি ভূমিকম্প থেকে প্রাণে বেঁচে গেছেন। এই শিক্ষক বলেন, তার ভাগ্নে, ভগ্নিপতি, ভগ্নিপতির বোন ধ্বংসস্তূপের নিচে আছেন। এখন তদের বেঁচে থাকার কোনো সম্ভবনা নেই।

ভূমিকম্পে দুই দেশে মৃতের সংখ্যা ব্যাপকভাবে বেড়ে চলেছে। তুরস্ক ও সিরিয়া সরকারের হিসাব অনুসারে, প্রথম দিন শেষে মৃত মানুষের সংখ্যা ছিল আড়াই হাজারের বেশি। দ্বিতীয় দিন এই সংখ্যা সাড়ে ৬ হাজার ছাড়িয়েছে। এখন পর্যন্ত এ সংখ্যা ছাড়িয়ে গেল সাড়ে ১৫ হাজার। ভূমিকম্পে তুরস্কের ১০টি ও সিরিয়ার ৪টি প্রদেশ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।

মরদেহের সংখ্যার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে স্বজনহারা মানুষের কান্না; বাড়ছে ঘরবাড়ি হারানো লোকজনের দুর্ভোগও। কেননা, যে পরিমাণ ধ্বংসযজ্ঞ ভূমিকম্প রেখে গেছে, তাতে উদ্ধারকাজে এখনো উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি হয়নি। এমনকি হতাহত এবং নিখোঁজ নারী-পুরুষ ও শিশুর সঠিক সংখ্যাটিও জানা যায়নি।

উদ্ধারকাজের ধীরগতি নিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করছেন নিখোঁজ ব্যক্তিদের স্বজনেরা। ভূমিকম্পের পর প্রাথমিকভাবে যেসব পদক্ষেপ নেয়া দরকার ছিল, সেসব নিতে দেরি হচ্ছে- এমন অভিযোগ তদের।

তুরস্কের প্রেসিডেন্ট রিসেপ তাইয়েপ এরদোয়ানও উদ্ধারকাজে ধীরগতির এসব অভিযোগের কথা স্বীকার করেছেন। গত বুধবার কাহরামানমারাস শহরে যান এরদোয়ান। তখন সেখানে পুরোদমে উদ্ধারকাজ চলছিল। এ সময় এরদোয়ান সাংবাদিকদের বলেন, উদ্ধার কার্যক্রম চালাতে গিয়ে সমস্যায় পড়তে হচ্ছে। ভূমিকম্পের কারণে সড়ক ও বিমান যোগাযোগব্যবস্থা ভেঙে পড়ায় এ সমস্যা হচ্ছে। তবে সময়ের সঙ্গে সঙ্গে উদ্ধারকাজের গতি বাড়বে।

উদ্ধারকাজে ধীরগতির চিত্র দেখা গেছে সিরিয়াতেও। দেশটির উত্তরাঞ্চলের শহর জানদারিস। সেখানকার উদ্ধারকর্মী ও বাসিন্দারা জানিয়েছেন, বেশ কয়েকটি ভবন বিধ্বস্ত হয়েছে। জানদারিস শহরের একটি ভবনে ৩২টি অ্যাপার্টমেন্ট ছিল। এই ভবনের বেশ কয়েকজন বাসিন্দা বেঁচে গেছেন। তারা বলেন, ভূমিকম্পের পর এখান থেকে কাউকে জীবিত উদ্ধার করা সম্ভব হয়নি। উদ্ধারকাজের জন্য যেসব যন্ত্রপাতি দরকার, সেগুলো না থাকায় কাজ ধীরে চলছে।

এদিকে জাতিসংঘে সিরিয়ার রাষ্ট্রদূত বলেছেন, ভয়াবহ এই ভূমিকম্পের পর দ্রুত উদ্ধারকাজ পরিচালনার জন্য তার সরকারের সক্ষমতা এবং প্রয়োজনীয় উপকরণ ও সরঞ্জামের অভাব রয়েছে। এক দশকের বেশি সময় ধরে চলমান গৃহযুদ্ধ ও পশ্চিমা নিষেধাজ্ঞার আওতায় থাকায় সিরিয়া এই সক্ষমতা অর্জন করতে পারেনি বলেও অভিযোগ করেছেন তিনি।

১৮ মাসের মাশাল জীবিত উদ্ধার : তুরস্কের দক্ষিণাঞ্চলের কাহরামানমারাস প্রদেশে গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন ছিলেন কিরাচাকালি দম্পতি। সঙ্গে তদের ১৮ মাস বয়সি মেয়ে মাশালও ঘুমাচ্ছিল। এ সময় হঠাৎ কেঁপে ওঠে চারপাশ। ভবন দুলতে থাকে। এই দম্পতি কিছু বুঝে ওঠার আগেই ধসে পড়ে ভবনটি। ধ্বংসস্তূপের নিচে চাপা পড়েন স্বামী-স্ত্রী এবং তদের শিশুসন্তান।

ভূমিকম্পের কিছুক্ষণ পর ধ্বংসস্তূপ থেকে বের হন ওমের কিরাচাকালি। কিন্তু ধ্বংসস্তূপের নিচে চাপা পড়ে থাকেন তার স্ত্রী ইয়েলিজ কিরাচিকালি ও মেয়ে মাশাল। এরপর কেটেছে ৫৫ ঘণ্টা। অবশেষে বুধবার ধ্বংসস্তূপের নিচ থেকে মাশালকে উদ্ধার করা হয়েছে। তবে ইয়েলিজ এখনো সেখানে। তাঁকে উদ্ধার করার চেষ্টা চলছে।

তুরস্কের সংবাদমাধ্যমের খবর, ইয়েলিজ বেঁচে আছেন। তার সঙ্গে কথা হয়েছে উদ্ধারকর্মীদের। ইয়েলিজ উদ্ধারকর্মীদের জানিয়েছেন, ভূমিকম্পে ধ্বংসস্তূপের নিচে চাপা পড়ার পর থেকে মাশালকে নিজের বুকের দুধ খাইয়ে বাঁচিয়ে রাখার চেষ্টা করেছেন তিনি।

গুরুত্বপূর্ণ ৭২ ঘণ্টা : সময় যত গড়াচ্ছে, তুরস্ক ও সিরিয়ার ধসে যাওয়া ভবনগুলো থেকে জীবিত মানুষদের উদ্ধারের সম্ভাবনা তত কমে যাচ্ছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ভূমিকম্পের পর উদ্ধারকাজের জন্য ৭২ ঘণ্টা গুরুত্বপূর্ণ। এ প্রসঙ্গে যুক্তরাজ্যের ইউনিভার্সিটি কলেজ লন্ডনের অধ্যাপক ইলান কেলমান বলেন, ভূমিকম্পের পর যাদের জীবিত উদ্ধার করা হয়, তদের মধ্যে ৯০ শতাংশ উদ্ধার হন তিন দিনের মধ্যে।

তবে এটাও নির্ভর করে ঘটনাস্থলের আবহাওয়া ও উদ্ধারকারী দলের কাজের গতির ওপর। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এসব বিবেচনায় তুরস্ক ও সিরিয়া পিছিয়ে আছে। দেশ দুটিতে যেমন পর্যাপ্ত উদ্ধারকর্মী নেই, তেমনি যন্ত্রপাতির সংকট রয়েছে। আবার আবহাওয়াও বৈরী।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার প্রধান তেদরোস আধানোম গেব্রেয়াসুস সতর্ক করে বলেছেন, ভূমিকম্পে আহত ও ধ্বংসস্তূপের নিচে চাপা পড়ে থাকা মানুষের জন্য সময় দ্রুত ফুরিয়ে যাচ্ছে। সংস্থাটির আশঙ্কা, ভয়াবহ এ ভূমিকম্পে দুই দেশে মৃত মানুষের মোট সংখ্যা ২০ হাজার ছাড়িয়ে যেতে পারে।

তুরস্কে ১০ হাজার ভ্রাম্যমাণ বাড়ি পাঠাচ্ছে কাতার

ভূমিকম্পে বিধ্বস্ত তুরস্ক ও সিরিয়ায় ১০ হাজার ভ্রাম্যমাণ বাড়ি ও উদ্ধারকারীর দল পাঠাচ্ছে কাতার। এ ছাড়া একটি ফিল্ড হাসপাতালের সরঞ্জাম এবং মানবিক সহায়তাও পাঠাচ্ছে দেশটি। কাতারের পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কথা জানিয়েছেন। এক বিবৃতিতে তিনি বলেন, এটা সিরিয়া ও তুরস্কে ভূমিকম্পে ক্ষতিগ্রস্ত মানুষদের সহায়তায় কাতারের প্রচেষ্টার অংশ।

কাতারের আমির শেখ তামিম বিন হামাদ আল থানি তুরস্কে ভূমিকম্পে ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তিদের সাহায্য করার জন্য আকাশপথে মানুষ ও পণ্য পরিবহন চালুর নির্দেশ দিয়েছেন। কাতারের রাষ্ট্রীয় বার্তা সংস্থা কিউএনএ জানিয়েছে, কাতার উদ্ধারকারী দল, একটি ফিল্ড হাসপাতাল, ত্রাণ সহায়তা, তাঁবু এবং শীতকালীন সরবরাহ পাঠাচ্ছে।

২১ বাংলাদেশিকে আঙ্কারায় স্থানান্তর, দুজন হাসপাতালে

তুরস্কে ভূমিকম্পে ক্ষতিগ্রস্ত এলাকা থেকে ২১ বাংলাদেশিকে রাজধানী আঙ্কারায় সরিয়ে নেয়া হয়েছে, তদের মধ্যে দুজন আছেন হাসপাতালে। গতকাল বৃহস্পতিবার পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সাপ্তাহিক ব্রিফিংয়ে মুখপাত্র সেহেলী সাবরীন এ তথ্য জানান।

তিনি বলেন, ভূমিকম্পে ক্ষতিগ্রস্ত গাজিয়ান্তে শহর থেকে বুধবার ১৯ বাংলাদেশি শিক্ষার্থীকে আঙ্কারায় স্থানান্তর করার কথা জানিয়ে সেহেলী বলেন, তদের গাজিয়ান্ত থেকে আঙ্কারায় শিফট (স্থানান্তর) করা হয়েছে। আমাদের দূতাবাস থেকে তদের সঙ্গে দেখা করে তদের অবস্থা সম্পর্কে বিস্তারিত জানবেন। এছাড়া ‘নিখোঁজ’ বলে খবর এসেছিল এমন দুই বাংলাদেশি বর্তমানে আঙ্কারায় চিকিৎসাধীন বলে জানান সাবরীন।

তিনি বলেন, সর্বশেষ প্রাপ্ত তথ্যমতে, উদ্ধারকৃত বাংলাদেশি ছাত্র নূরে আলম ও গোলাম সাইদ রিংকু চিকিৎসাধীন অবস্থায় রয়েছেন। ভূমিকম্প বিধ্বস্ত তুরস্কে উদ্ধারকারী ও চিকিৎসক দল পাঠানোর ধারাবাহিকতায় সিরিয়াতেও একই ধরনের দল পাঠানোর পরিকল্পনা করছে সরকার।

মুখপাত্র বলেন, বন্ধুপ্রতিম তুরস্কের এই ক্রান্তিকালীন ও দুর্যোগপূর্ণ সময়ে ৬১ সদস্য বিশিষ্ট একটি মেডিকেল ও উদ্ধারকারী দল প্রেরণ করা হয়েছে, যারা আগামী এক সপ্তাহ তুরস্কে অবস্থান করে বিভিন্ন প্রকার মানবিক সাহায্য প্রদান করবে এবং উদ্ধার কাজে অংশগ্রহণ করবে। পাশাপাশি সিরিয়াতেও একইভাবে উদ্ধার দল প্রেরণের বিষয়টি সক্রিয় বিবেচনাধীন রয়েছে।

ভূমিকম্পে ক্ষতিগ্রস্ত এলাকার প্রবাসীদের জন্য আঙ্কারায় বাংলাদেশ দূতাবাস দুটি হটলাইন চালু করেছে বলেও জানান মুখপাত্র। তুরস্ক ও সিরিয়ায় হাজারো মানুষের প্রাণহানিতে গতকাল বৃহস্পতিবার রাষ্ট্রীয় শোক দিবস পালন করেছে বাংলাদেশ।

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত