বাসে ই-টিকিটে ভাড়া আদায়

শৃঙ্খলার চেয়ে বিশৃঙ্খলাই বেশি

* ভাড়া নিয়ে যাত্রীদের সঙ্গে তর্ক * পজ মেশিন নষ্ট, সব বাসস্ট্যান্ডের নাম নেই

প্রকাশ : ১১ ফেব্রুয়ারি ২০২৩, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ

  ফারুক আলম

রাজধানীতে অতিরিক্ত বাস ভাড়া নিয়ে প্রতিনিয়ত যাত্রী, গণপরিহণ চালক ও চালকের সহকারীর মধ্যে তর্কাতর্কির ঘটনা ঘটছে। এই অনাকাঙ্ক্ষিত পরিস্থিতি এড়াতে এবং যাত্রী হয়রানি বন্ধে রাজধানীতে ই-টিকিটিং ব্যবস্থা চালু করা হয়েছে। তবে ই-টিকিটিং ব্যবস্থাপনা নিয়ে যাত্রী ও চালকদের মধ্যে অসন্তোষ দেখা গেছে।

কেননা রাজধানীর সাইন্সল্যাব থেকে গুলিস্তান পর্যন্ত প্রায় তিন কিলোমিটারের জন্য যে ভাড়া নেয়া হচ্ছে, একই ভাড়া নেয়া হচ্ছে শাহবাগ থেকে গুলিস্তানের দুই কিলোমিটার দূরত্বের জন্য। দূরত্ব কমলেও বাড়তি ভাড়া দিতে হচ্ছে। ভাড়া নিয়ে কথা কাটাকাটির জেরে যাত্রী মারধরের ঘটনাও ঘটছে।

আবার ই-টিকিটিং মেশিনে (পজ মেশিন) সব বাসস্ট্যান্ডের নাম নেই। যেসব স্টেশনের নাম নেই সেসব স্টেশনের জন্য যাত্রীদের কাছ থেকে পরবর্তী স্টেশনের জন্য নির্ধারিত ভাড়া নেয়া হচ্ছে। আবার কোনো কোনো বাসে পজ মেশিন নষ্ট দেখিয়ে আগের মতোই ভাড়া আদায় করা হচ্ছে। যাত্রীরা বলছেন, পজ মেশিনে দূরত্ব অনুযায়ী ভাড়া নির্ধারণ করা দরকার। যাত্রীরা যে পর্যন্ত ভ্রমণ করবে, ঠিক সেই পর্যন্ত ভাড়া রাখতে হবে। এ ব্যবস্থা সব পরিবহণে চালু হলে কমবে ভোগান্তি এবং বন্ধ হবে অতিরিক্ত ভাড়া আদায়।

জানা গেছে, গত বছরের নভেম্বরে বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন মালিক সমিতি গণপরিবহণে ই-টিকিটিং ব্যবস্থার ঘোষণা দেয়। সব বাসেই ই-টিকিটিংয়ের মাধ্যমে যাত্রী নেয়ার কথা থাকলেও গাবতলী, মোহাম্মদপুর ও আজিমপুরে ই-টিকিটিংয়ের মাধ্যমে কিছু কিছু বাসে আধুনিক এই পদ্ধতিতে যাত্রী নেয়া শুরু হয়েছে। তবে রাস্তায় দেখা যাচ্ছে তার উল্টো চিত্র। হতাশ যাত্রীরা ক্ষোভ প্রকাশেরও জায়গা পাচ্ছেন না।

রাজধানীর শনিরআখড়া, মোহাম্মদপুর, পল্টন ও ফার্মগেট এলাকা ঘুরে দেখা গেছে, অধিকাংশ বাসে ই-টিকিটিং ব্যবস্থা চালু হয়নি। আবার যেসব বাসে ই-টিকিটিং ব্যবস্থা রয়েছে সেগুলোর যাত্রীরা নানা অভিযোগ করছে। মেঘলা পরিবহনে শনিরআখড়া থেকে এমএ আহাদ শাহীন নামে একজন যাত্রী মৎস্য ভবনে আসার জন্য টিকিট কাটেন। তার কাছ থেকে ৩০ টাকা ভাড়া রাখা হয়েছে। একই বাসে আরেকজন যাত্রী শনিরআখড়া থেকে সাইন্সল্যাব যাবেন তার কাছ থেকেও ৩০ টাকা ভাড়া রাখা হয়েছে। এই নিয়ে চালকের সহকারী হেলাল উদ্দিনের সঙ্গে যাত্রীর বাকবিতণ্ডার ঘটনা ঘটে। পরে হেলাল উদ্দিন বলেন, ই-টিকিটিং পদ্ধতি চালু করা হয়েছে। শনিরআখড়া থেকে মৎস্যভবন, শাহবাগ কিংবা কাঁটাবন ও সাইন্সল্যাবে নামলে একই ভাড়া দিতে হবে। এখানে আমার করার কিছু নেই। এছাড়াও আসাদগেট, মানিক মিয়া অ্যাভিনিউ, মোহাম্মদপুর বাসস্ট্যান্ড ও জিগাতলা বাসস্ট্যান্ড এলাকায় বাসগুলোতে ই-টিকিট বিক্রির ‘পজ মেশিন’ ব্যবহার করা হচ্ছে। বাসের যাত্রীরাও টিকিটে আসা নির্ধারিত ভাড়ার টাকা পরিশোধ করছেন। শ্রাবণ পরিবহণের চালক জাহিদ হোসেন বলেন, ই-টিকিট সম্পর্কে আমাদের এখনো কিছু বলা হয়নি। মেশিনও দেয়া হয়নি। কবে দেয়া হবে এই বিষয়ে কিছু জানি না।

ই-টিকিটিংয়ে ভোগান্তির পাশাপাশি কিছুটা স্বস্তিও প্রকাশ করেছেন যাত্রীরা। তারা বলছেন, আগে টিকিট ছিল না। এখন টিকিট দেয়া বাধ্যতামূলক হওয়ায় বাসের সুপারভাইজাররা ইচ্ছামতো আর ভাড়া আদায় করতে পারছেন না। কিন্তু আগে সুযোগ পেলেই নানা অজুহাতে বেশি ভাড়া নেয়া হতো। কোনো কোনো গন্তব্যে ই-টিকিটিংয়ে আবার আগের চেয়ে ভাড়া কিছুটা বেড়েছে বলেও জানালেন অনেক যাত্রী।

চালকের সহকারী ও পরিবহন-সংশ্লিষ্টরা বলছেন, টিকিটের ব্যবস্থা থাকলেও অনেক যাত্রী টিকিট নিতে চান না। তারা আগের মতো ভাড়া দিতে চান। অনেকে আবার টিকিটে যে ভাড়া আসে, সেটাই দেন। এ ছাড়া সর্বনিম্ন ভাড়া নিয়েও যাত্রীদের সঙ্গে তর্কে জড়াতে হচ্ছে; বিশেষ করে শিক্ষার্থীদের সঙ্গে।

বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন মালিক সমিতির ঘোষণা অনুযায়ী, গাবতলী, মোহাম্মদপুর ও আজিমপুরে ১৫টি বাস কোম্পানির ৭১১টি বাস ই-টিকিটিংয়ের মাধ্যমে যাত্রীদের কাছ থেকে ভাড়া আদায় করবে। চলতি মাসের ২৮ তারিখের মধ্যে ঢাকা ও আশপাশের জেলায় চলাচলকারী সব বাস কোম্পানিই ই-টিকিটিংয়ের আওতায় আনা হবে।

মিলন সরকার মোহাম্মদপুর এলাকার বাসিন্দা। কিন্তু কাজের জন্য তাকে মগবাজার যেতে হয়। মিলন বলেন, ভাড়া আগের চেয়ে ৫ টাকা বেড়েছে। মগবাজারের ভাড়া আগে দিতাম ১৫ টাকা। এখন ২০ টাকা দিতে হচ্ছে। মিলনের এমন বক্তব্যের বিষয়ে সাগর হাসান নামের স্বাধীন পরিবহনের একটি বাসের সুপারভাইজার বলেন, আগে আমাদের বাসের চেকার (যাত্রীর সংখ্যা গণনা করেন যিনি) ছিল মগবাজার উড়ালসড়কের আগে। তিনি চেকারের আগে নামতেন। তাই ৫ টাকা কম রাখা যেত। এখন মেশিনে স্টপেজ অনুযায়ী ভাড়া ধরা আছে।

বাস চালকরা বলছেন, আগে যাত্রীদের বাসভাড়া নিজেদের মনঃপূত না হলেই ভাড়ার তালিকা চাইতেন, টিকিট চাইতেন কিংবা নানান ঝামেলা করতেন। এখন আর সেসব ঝামেলা নেই। মেশিনে চাপ দিয়ে টিকিট দিয়ে যাত্রীদের কাছ থেকে ভাড়া নেয়া হচ্ছে। আগের মতো বাসে কোনো ঝামেলা হচ্ছে না। যাত্রীদের টিকিট দেয়ায় তারা খুশি। তবে যাত্রীদের নিয়ে ঝামেলা না থাকলেও শিক্ষার্থীদের সর্বনিম্ন ভাড়া নিয়ে একটু সমস্যা হচ্ছে। কারণ, সর্বনিম্ন ভাড়া ১০ টাকা। পজ মেশিনে অর্ধেক (হাফ) ভাড়া দেয়ার সুযোগ নেই। কিন্তু শিক্ষার্থীরা এখানেও হাফ ভাড়া দিতে চান।

ভাড়া নিয়ে যাত্রী ও বাসের কর্মীদের মধ্যে তেমন কোনো বাগ্?বিতণ্ডা না হলেও ই-টিকিটিংয়ে ভাড়া কাটার যন্ত্র ব্যবহার করতে গিয়ে বিড়ম্বনায় পড়ছেন অনেক বাসের সুপারভাইজার। যন্ত্রটি ব্যবহারে নানা জটিলতা তৈরি হচ্ছে বলে জানান অনেকেই। মালঞ্চ পরিবহনের সুপারভাইজার জিহাদুল ইসলাম বলেন, সকালে গাড়ি নিয়ে বের হওয়ার সময় মেশিন ঠিক ছিল। ভাড়া কাটতে গিয়ে দেখি, মেশিন কাজ করছে না। পরে প্রথম ট্রিপের ভাড়া আগের মতো আদায় করতে হয়েছে। অনেকে টিকিট চাইলে মেশিন নষ্ট বলে, আগের মতোই ভাড়া নিতে হয়েছে।

এই বাসের যাত্রী একটি সরকারি হাসপাতালের নার্স সুমি জান্নাতের দাবি, ভাড়া আগের চেয়ে বেড়েছে। তিনি মোহাম্মদপুর থেকে শাহবাগ পর্যন্ত আগে ১০ টাকা ভাড়া দিতেন। এখন একই গন্তব্যে তাকে ১৫ টাকা ভাড়া দিতে হচ্ছে। ই-টিকিটিংয়ের মাধ্যমে ভাড়া আদায়ের কারণে ট্রিপপ্রতি মোট ভাড়া আদায়ের পরিমাণ কমে গেছে বলেও জানালেন বাসচালক ও সুপারভাইজাররা। যে কারণে কোনো কোনো বাসচালক নিজেরা বাস না চালিয়ে বদলি চালক দিয়ে বাস চালাচ্ছেন।

আধুনিক গণপরিবহণ সেবায় ই-টিকিটিং ব্যবস্থাকে স্বাগত জানিয়ে যাত্রী কল্যাণ সমিতির মহাসচিব মোজাম্মেল হক চৌধুরী বলেন, পরিবহন খাতে দীর্ঘ দিনের পুঞ্জীভূত সমস্যা সমাধানের পাশাপাশি এই খাতের আমূল সংস্কার করা না গেলে ই-টিকিটিং সিস্টেমে সিটিবাস সার্ভিস ব্যবস্থা টিকিয়ে রাখা সম্ভব হবে না।