ঢাকা ২০ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ৫ আশ্বিন ১৪৩১ | বেটা ভার্সন

কিশোরের হাতে মোটরসাইকেল

সড়কে গতির ঝড়ে মৃত্যু আতঙ্ক

সড়কে গতির ঝড়ে মৃত্যু আতঙ্ক

‘মোটরসাইকেল কিনে না দেয়ায় স্কুলছাত্রের আত্মহত্যা’ অথবা ‘বেপরোয়া গতিতে মোটরসাইকেল দুর্ঘটনায় স্কুলছাত্রের মৃত্যু’। বিভিন্ন গণমাধ্যমে এমন শিরোনামে প্রায়ই সংবাদ প্রকাশ হতে দেখা যায়। তবুও কিশোরদের হাতে হরহামেশাই দেখা যাচ্ছে মোটরসাইকেল। কিশোররা সড়কে মোটরসাইকেলে গতির ঝড় তোলায় প্রতিনিয়ত মৃত্যু আতঙ্ক বাড়ছে। একাধিক অভিভাবকের সঙ্গে আলাপ করে জানা গেছে, দিন দিন কিশোর বয়সি ছেলেদের নিয়ন্ত্রণ করা দুষ্কর হয়ে উঠছে। এক শ্রেণির কিশোর বেপরোয়া হয়ে উঠছে। তাদের কাছে অভিভাবকরাও জিম্মি হয়ে পড়েছেন। অনেকটা বাধ্য হয়ে কিনে দিতে হচ্ছে মোটরসাইকেল।

গত ১০ ফেব্রুয়ারি সাতক্ষীরায় দুই মোটরসাইকেলের মুখোমুখি সংঘর্ষে শেখ জুবায়ের আহমেদ (১৫) নামের এক কিশোর নিহত হয়। এতে রাহাত আলী (১৬) নামে অপর কিশোরসহ আরও দুজন গুরুতর আহত হয়। অপরদিকে গত ৩ নভেম্বর রাত ৯টার দিকে বরগুনার বেতাগী উপজেলায় মোটরসাইকেল দুর্ঘটনায় ইয়াসিন আরাফাত (১৩), মোহাম্মদ রাব্বি (১৬) ও সিয়াম (১৫) নিহত হয়। সড়কে গতির ঝড় তুলে নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে মোটরসাইকেলসহ তিনজনই রাস্তার পাশে পড়ে মারা যায়।

২০২২ সালের ২৭ অক্টোবর টাঙ্গাইলের ভূঞাপুরে বেপরোয়া গতিতে মোটরসাইকেল চালিয়ে প্রাইভেট পড়তে যাওয়ার সময় লিটন (১৫) নামে এক স্কুলছাত্র মারা যায়। জানা গেছে গতির ঝড় তুলতে গিয়ে প্রাণ হারায় ওই স্কুলছাত্র। নিহত লিটন নবম শ্রেণির ছাত্র ছিল। এ ঘটনায় তার সহপাঠী দুই বন্ধু শাওন ও মারুফসহ পথচারী জয়নাল আহত হন। একই বছরের ৬ জুলাই দুটি মোটরসাইকেল নিয়ে ঘুরতে বের হয়েছিল ছয় বন্ধু। রাজশাহীর বাগমারা উপজেলার তাহেরপুর-শিকদারী সড়কে টিকটকের জন্য মোটরসাইকেল দ্রুতগতিতে চালানোর দৃশ্য মোবাইল ফোনে ভিডিও ধারণ করছিল তারা। এ সময় নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে একটি মোটরসাইকেল সড়কের পাশে গাছের সঙ্গে ধাক্কা খায়। আহত তিনজনকে উদ্ধার করে হাসপাতালে নেয়া হলে মৃত্যু হয় আফিফ হোসেন (১৫) নামে এক কিশোরের। সেও নবম শ্রেণির ছাত্র ছিল। দুর্ঘটনায় আহত অন্য দুজনও স্কুল শিক্ষার্থী।

উপরের ঘটনাগুলো মফস্বলের হলেও ঢাকার পরিস্থিতি আরও ভয়াবহ। নিত্য নতুন মডেলের মোটরসাইকেল নিয়ে রাজধানীর বিভিন্ন রাস্তায় গতির ঝড় তুলছে কিশোররা। সড়কে এসব দুর্ঘটনায় বাড়ছে মৃত্যুর ঘটনাও। শুধু জানুয়ারি মাসেই ৫৯৩টি সড়ক দুর্ঘটনায় ৫৮৫ জন নিহত ও ৮৯৯ জন আহত হয়েছেন বলে জানিয়েছে বাংলাদেশ যাত্রী কল্যাণ সমিতি। এ সময় ২১৪টি মোটরসাইকেল দুর্ঘটনায় ২০৫ জন নিহত ও ১১৪ জন আহত হয় বলেও জানিয়েছে সংগঠনটির মহাসচিব মো. মোজাম্মেল হক চৌধুরী।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে, প্রতিবছর দেশে প্রায় ২৫ হাজার মানুষ সড়ক দুর্ঘটনায় মারা যায়। দুই ও তিন চাকার মোটরযান ব্যবহারকারীরা দুর্ঘটনায় মাথার আঘাতে মারা যায় বলে জানিয়েছে সংশ্লিষ্টরা। তারা বলেছে, মোটরসাইকেল চালকরা সঠিক হেলমেট ব্যবহার না করায় মৃত্যুঝুঁকি ৪০ শতাংশ হ্রাস করা যাচ্ছে না।

রোড সেফটি ফাউন্ডেশন জানিয়েছে, ২০২২ সালে দেশে ৬ হাজার ৮২৯টি সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত হয়েছে ৭ হাজার ৭১৩ জন। এরমধ্যে ২ হাজার ৯৭৩টি মোটরসাইকেল দুর্ঘটনায় ৩ হাজার ৯১ জন মারা গেছে। যা মোট মৃত্যুর ৪০ দশমিক ০৭ শতাংশ। প্রতিবেদন অনুযায়ী, সড়ক দুর্ঘটনায় গত বছর প্রাণ হারিয়েছে ১ হাজার ৬২৭ জন পথচারী।

সংস্থাটির নির্বাহী পরিচালক সাইদুর রহমান বলেন, দেশে কয়েক বছর ধরেই মোটরসাইকেল দুর্ঘটনার সংখ্যা ও মৃত্যু বাড়ছে। বিশেষ করে মোটরসাইকেল দুর্ঘটনায় কিশোর-তরুণদের মৃত্যুর ঘটনা বেশি। দুর্ঘটনা বৃদ্ধির কারণ হিসেবে বেশ কিছু বিষয় চিহ্নিত করা হয়েছে। এর মধ্যে বেপরোয়াভাবে কিশোর-যুবকদের মোটরসাইকেল চালানো, মোটরসাইকেল চালকদের অদক্ষতা ও অস্থিরতা, বেপরোয়া মোটরসাইকেল চালানোর ক্ষেত্রে রাজনৈতিক পৃষ্ঠপোষকতা, ট্রাফিক আইন না জানা ও না মানা, দুর্বল ট্রাফিক ব্যবস্থাপনা, সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের নজরদারির ক্ষেত্রে শিথিলতা এবং সড়ক-মহাসড়কে বিভাজক না থাকা অন্যতম।

সংস্থাটির দেয়া এক প্রতিবেদনে দেখা যায়, এ সময়ের মধ্যে আহত হয়েছে ১ হাজার ২৮৬ জন। নিহতদের মধ্যে ৩৪৭ জন (১৬ দশমিক ৫৪ শতাংশ) ১৩ থেকে ১৭ বছর বয়সি। আর নিহত ১ হাজার ৫৩৩ জন (৭৩ দশমিক ১০ শতাংশ) ১৮ ঊর্ধ্ববয়সি। এছাড়াও মোটরসাইকেলের ধাক্কায় ৯২ জন পথচারী নিহত হয়েছে ওই সময়ে। সে হিসেবে ২০২১ সালের তুলনায় গত বছর মোটরসাইকেল দুর্ঘটনা বেড়েছে ২১ দশমিক ১৭ শতাংশ এবং প্রাণহানি বেড়েছে ১৯ দশমিক ২৮ শতাংশ।

রোড সেফটি ফাউন্ডেশনের তথ্য অনুযায়ী, ২০১৯ সালে দেশে মোটরসাইকেল দুর্ঘটনায় মারা যায় ৯৪৫ জন। ২০২০ সালে তা বেড়ে হয় ১ হাজার ৪৬৩ জন। আর ২০২১ সালে মোটরসাইকেল দুর্ঘটনায় মারা যায় ২ হাজার ২১৪ জন। সড়ক নিরাপত্তা নিয়ে কাজ করা বিভিন্ন সংগঠনের গবেষণায় উঠে এসেছে, মহাসড়ক, আঞ্চলিক সড়ক ও গ্রামীণ সড়কে মোটরসাইকেল চালানোর ক্ষেত্রে অধিকাংশ চালক নিয়ম মানে না। ট্রাফিক সিগন্যাল সম্পর্কে ধারণা না থাকায় শিশু-কিশোররা মোটরসাইকেল পেলেই নিয়ম মানছেন না সড়কের। এতে যেমন মোটরসাইকেলে শিশু-কিশোরদের প্রাণ ঝরছে সড়কে, অন্যদিকে পথচারী কিংবা অন্য যানবাহন চালকরাও পড়ছেন বিপদে।

এছাড়াও অপর এক গবেষণা থেকে জানা যায়, ঢাকার জাতীয় অর্থোপেডিক হাসপাতাল ও পুনর্বাসন কেন্দ্রে (পঙ্গু হাসপাতাল) বিভিন্ন দুর্ঘটনায় আহত হওয়া যত মানুষ সেবা নেয়, তাদের ৬৫ শতাংশই মোটরসাইকেল দুর্ঘটনার শিকার। উদ্বিগ্ন অভিভাবক ও সংশ্লিষ্টদের সাথে আলাপকালে সড়কে কেন প্রায়ই দুর্ঘটনা ঘটে- এর উত্তর খুঁজতে গিয়ে পাওয়া গেছে সাতটিটি কারণ : এক. ফাঁকা সড়কে বেপরোয়া গতিতে গাড়ি চালানো। দুই. সড়কের বাঁকেও গাড়ির গতি না কমানো। তিন. রাতে গাড়ি ও মোটরসাইকেল রেস। চার. উল্টোপথে গাড়ি চালানো। পাঁচ. রাতের আলো-আঁধারে সড়কে গাড়ি পার্কিং, ছয়. ছিনতাই চক্র এবং কিশোর বয়সিদের মোটরসাইকেল চালানো। বিআরটিএর এক হিসাবে জানা যায়- দেশে নিবন্ধিত মোটরযানের ৭১ শতাংশই মোটরসাইকেল। শুধু রাজধানীতেই চলছে ১৫ লাখের বেশি মোটরসাইকেল। সার্বিক বিবেচনায় বর্তমানে অনেকটাই প্রাণঘাতী বাহনে পরিণত হয়েছে মটরসাইকেল। উচ্চগতিতে বেপরোয়াভাবে চালাতে গিয়েই বেশিরভাগ ক্ষেত্রে দুর্ঘটনা বাড়ছে। দেশের আইনে লাইসেন্স পাওয়ার জন্য ন্যূনতম বয়স ১৮ হলেও সড়কে মোটরসাইকেল দাপিয়ে বেড়ানোদের অনেকেরই বয়স আঠারোর নিচে। এসব কিশোররা দ্রুতগতিতে চালানোর প্রতিযোগিতায় মেতে উঠা এবং সেসব দৃশ্য ভিডিও ধারণ করতে গিয়েও ঘটছে দুর্ঘটনা।

প্রশ্ন দেখা দিয়েছে লাইসেন্স ছাড়াই শিশু-কিশোররা মোটরসাইকেল নিয়ে সড়কে বের হয় কীভাবে? সংশ্লিষ্টরা মনে করছেন আদরের সন্তানের আবদারে মোটরসাইকেল দিচ্ছেন অভিভাবকরা। কিন্তু তা ‘মৃত্যুফাঁদ’ তৈরি করছে সন্তানদের জন্য। তবুও একশ্রেণির অভিভাবক সন্তানের আবদার মেটাতে ‘ভয়ঙ্কর মৃত্যুফাঁদ মোটরসাইকেল’ তুলে দিচ্ছেন তাদের হাতে। অনেক সময় মোটরসাইকেলের প্রতি সন্তানের ঝোঁক দেখে এসএসসি পরীক্ষায় জিপিএ-৫ পেলে মোটরসাইকেল কিনে দেওয়ার আশ্বাসও দেন এসব অভিভাবক। সম্প্রতি মোটরসাইকেল দুর্ঘটনার হার উদ্বেগজনক মাত্রায় বেড়েছে। এতে উদ্বিগ্ন সচেতন মহল এবং উৎকণ্ঠা দেখা দিয়েছে অভিভাবক মহলেও।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, গত কয়েক বছরে ১২ থেকে ১৮ বছর বয়সি অনেক কিশোর মোটরসাইকেল দুর্ঘটনায় প্রাণ হারিয়েছে। এটি অবশ্যই উৎকন্ঠার। সন্তানদের মন রক্ষা করতে ও তাদের দাবি মানতে গিয়ে যাতে সন্তানের বড় ক্ষতি বয়ে আনে এমন কিছু না করার পরামর্শ তাদের।

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত