তিন উৎসবে উল্লসিত মানুষ

৫০০ কোটি টাকার ফুলের বাজার

* যশোরের গদখালীতে একদিনে ৩ কোটি টাকার ফুল বিক্রি * ব্যবসায়ীরা ফুল রপ্তানিতে নীতিমালা চান

প্রকাশ : ১৪ ফেব্রুয়ারি ২০২৩, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ

  জোনায়েদ মানসুর

শুধু ফ্যাশন কিংবা সৌখিনতার জন্য এখন আর ফুল চাষাবাদ হয় না। বাণিজ্যিকভাবেও চাষাবাদ হয়। বর্তমানে ফুল দেশের একটি সম্ভাবনাময় খাত। দেশে প্রতিদিন কোনো না কোনো উৎসব উদযাপিত হচ্ছে। প্রায় প্রতি মাসে রয়েছে নানা দিবস। এসব উৎসব ও দিবসকে ঘিরে তাজা ফুলের চাহিদাও ব্যাপক। এজন্য দেশে প্রতিনিয়ত অর্থাৎ ১২ মাসই ফুলের চাষ হচ্ছে। বর্তমানে দেশে ফুলের বাজার ১ হাজার ৬০০ কোটি টাকার। তাই বাণিজ্যিকভাবে ফুলের চাষে আরো ঝুঁকছেন কৃষক-ব্যবসায়ীরা।

বাংলাদেশ ফ্লাওয়ার সোসাইটির তথ্য মতে, বিভিন্ন দিবসকে সামনে রেখে সারা দেশেই কম-বেশি ফুলের চাষ হয়। বছরে ১ হাজার ৬০০ কোটি টাকার ফুল বিক্রি হচ্ছে। বর্তমানে সারা দেশে ৬ হাজারের বেশি ছোট-বড় ফুলের দোকান আছে। এর মধ্যে শুধু রাজধানীতেই আছে সাড়ে ৬০০ ফুলের দোকান। তবে, ভালোবাসা দিবসের দিন পাড়া-মহল্লায় ফুলের ক্ষণস্থায়ী দোকান খুলে অনেকেই এ ব্যবসায় জড়ান।

সোসাইটির তথ্য অনুযায়ী, ইংরেজি নববর্ষ তথা ১ জানুয়ারি, ফেব্রুয়ারি মাসে বসন্তবরণ উৎসব, ১৪ ফেব্রুয়ারি ভালোবাসা দিবস, ২১ ফেব্রুয়ারি, আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস, ২৬ মার্চ স্বাধীনতা দিবস, পহেলা বৈশাখ এবং বিজয় দিবস। তবে সনাতন ধর্মাবলম্বী হিন্দুদের পূজা, বিয়ে ও বিভিন্ন ধরনের অনুষ্ঠানেও ফুলের দরকার হয়।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে যশোর চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিজের নেতা মো. মঈনুল আলম টুলু আলোকিত বাংলাদেশকে বলেন, গত দু-তিন বছর ফুলের বাজার খারাপ ছিল। বর্তমানে বেশ ভালো। তিনি বলেন, ফুল যেন নিত্যসঙ্গী হয়ে গেছে। যে কোনো উৎসবে এ ফুলের বেশ চাহিদা। তাই ফুল চাষের বাণিজ্যিক নগরীখ্যাত যশোরের চাষিরা আরো বেশি চাষাবাদে ঝুঁকছে। তিনি বলেন, গত ২ বছর ৩০০ কোটি টাকার ব্যবসা ছিল। এবার ৫০০ কোটি টাকার ব্যবসা হবে বলে মনে করেন তিনি।

বাংলাদেশ ফ্লাওয়ার সোসাইটির নেতা আবদুর রহিম বলেন, দেশে উৎপাদিত ফুল দিয়েই বেশি সারা বছরের চাহিদা মেটে। তবে, বাইরে থেকেও কিছু ফুল আসে। আগে বাণিজ্যিকভাবে ফুল রপ্তানি হলেও এখন আর হচ্ছে না। তবে, ফুলের রপ্তানি বাজার গড়ে তোলার জন্য এখন বিভিন্ন দেশে মাঝেমধ্যে ফুলের স্যাম্পল পাঠান তারা।

বাংলাদেশ ফ্লাওয়ার সোসাইটির তথ্যে, এ বছর ভালোবাসা দিবসে শুধু গোলাপের চাহিদা ৪৫ লাখ। তবে, চাহিদা অনুযায়ী জোগান কিছুটা কম হতে পারে। সংগঠনটির তথ্য মতে, গত বছর ভালোবাসা দিবস ও বসন্ত বরণকে কেন্দ্র করে প্রায় ২৫০ কোটি টাকার ফুল বিক্রি হয়েছিল। এবার ৫০০ কোটি টাকার ব্যবসা হবে বলে জানা গেছে। ব্যবসায়ীরা জানান, দেশের ২৩টি জেলায় দেড় লক্ষাধিক লোক ফুল চাষের সঙ্গে জড়িত। ফুল ব্যবসায়ীরা বলেছেন, ফুল এখন লাভজনক ব্যবসা। কয়েক বছর ধরে দেশের বিভিন্ন জেলায় দেশি-বিদেশি ফুল চাষে ব্যাপক আগ্রহ তৈরি হয়েছে।

একদিনে ৩ কোটি টাকার ফুল বিক্রি : ভ্যালেন্টাইনস ডে ও পহেলা ফাল্গুনকে কেন্দ্র করে যশোরের গদখালী ফুলের বাজার জমজমাট। যশোরের গদখালীতে একদিনে ৩ কোটি টাকার বেশি ফুল বিক্রি হয়েছে। গতকাল সোমবার গদখালী পাইকারি ফুলের বাজারে কমপক্ষে ৩ কোটি টাকার গোলাপ কেনাবেচা হয়। চাহিদা বাড়ায় এদিন রেকর্ড পরিমাণ দামে গোলাপ বিক্রি হয়েছে বলে জানিয়েছেন বাজারের ব্যবসায়ীরা।

গদখালী ফুলচাষি ও ফুল ব্যবসায়ী কল্যাণ সমিতি সূত্রে জানা গেছে, গতকাল গদখালী বাজার ও গোলাপের ক্ষেত থেকে কমপক্ষে ১০ লাখ গোলাপ সারা দেশে পাঠানো হয়েছে।

ফুলচাষি আব্দুর কাদের বলেন, ৩০ বছর ধরে নানা জাতের ফুল চাষ করেছি। সবচেয়ে বেশি চাষ করেছি গোলাপ। প্রথম থেকেই বসন্ত আর ভালোবাসা দিবসে গোলাপের দাম থাকে দ্বিগুণ। তবে, গোলাপে কোনোবার ১৫ টাকার বেশি পাইকারি দাম পাইনি। এবার রেকর্ড ২৫ টাকা পর্যন্ত বিক্রি করেছি। আর চায়না গোলাপ ৪০ টাকা পর্যন্ত বিক্রি করেছি। এই দামে সব কৃষকই লাভবান হবে।

গদখালী এলাকার চাষি মো. সালাম হোসেন বলেন, ভালোবাসা দিবস ও বসন্তবরণ উপলক্ষ্যে সবচেয়ে গোলাপ ও জারবেরা ফুলের চাহিদা বেশি। তরুণীরা চুলের খোঁপায় পরার জন্য জারবেরা ফুল পছন্দ করেন। এজন্য জারবেরাসহ অন্যান্য ফুলের চাহিদাও রয়েছে।

স্থানীয় ফুলের ব্যবসায়ী আল আমিন বলেন, পাঁচ দিন আগে গোলাপের পাইকারি দাম ছিল প্রায় অর্ধেক। আরো দুই দিন চড়া দাম থাকবে।

ফুলের রকম ফের : রাজধানীর বাজারে ১৬ ধরনের ফুল দেখা যায়। চাষিরা নানা ধরনের ফুল চাষ করলেও ১১ ধরনের ফুল বেশি বিক্রি হওয়ায় এর চাষ বেশি হচ্ছে। এসব ফুলে মধ্যে অন্যতম হচ্ছে- রজনীগন্ধা, গোলাপ, গ্লাডিওলাস, জারবেরা, বেলি, গাঁদা, জিপসি, রডস্টিক, কেলেনডোলা, চন্দ্র মল্লিকা বিক্রি হচ্ছে। এর পরই চেরি, কসমস, গাজরা (চায়না বেলি), অস্টার, কিচেন টিমাস, টিউলিপ, চায়না গোলাপ ও লিলিয়াম বিক্রি হচ্ছে।

বাংলাদেশ ফ্লাওয়ার সোসাইটির তথ্য অনুযায়ী, বাজারে বিক্রি হওয়া মোট ফুলের ৩৫ শতাংশই গোলাপ ফুল। গ্লাডিওলাস ২৫ শতাংশ, রজনী ২০ শতাংশ, জারবেরা ১০ শতাংশ এবং গাদা ও অন্যান্য ফুল ১০ শতাংশ বিক্রি হয়।

চাষাবাদের হিসাব : দেশের ৬ হাজার হেক্টর জমিতে এখন ফুল চাষ হচ্ছে। চলতি অর্থবছরে চাষাবাদের হিসাব এখনো পাওয়া যায়নি। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, ২০২০-২১ অর্থবছরে, কৃষকরা ২ হাজার ২৬৪ হেক্টর জমিতে ফুল চাষ করে, যা আগের বছরের ২ হাজার ২৯৮ হেক্টরের তুলনায় কিছুটা কম। ফুলচাষের মোট জমির এক-চতুর্থাংশই যশোরে, এরপর রয়েছে ঢাকা ও চট্টগ্রাম। আর যশোর জেলার ১২টি ইউনিয়নে ১ হাজার ২০০ থেকে ১ হাজার ৫০০ হেক্টর জমিতে ফুল চাষ হয়। এ অঞ্চলের ৬ হাজার চাষি ফুল উৎপাদন করে। সারা দেশের চাহিদার প্রায় ৬৫ শতাংশ ফুল যশোরের গদখালী থেকে সরবরাহ করা হয়।

ঝিকরগাছার উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা মাসুদ হোসেন পলাশ জানান, ঝিকরগাছার ৬৩০ হেক্টর জমিতে ৭২ প্রজাতির ফুল চাষ হয়। এবার আবহওয়া অনুকূলে থাকায় এবং যথাসময়ে শীত পড়ায় ফুলের উৎপাদন ভালো হয়েছে। পাশাপাশি পোকার আক্রমণও অনেক কম। এ কারণে ফুল বিক্রি করে কৃষকরা লাভবান হচ্ছেন।

আমদানি-রপ্তানি : দেশে কিছু ফুল আমদানি হলেও কয়েক বছর ধরে রপ্তানি হচ্ছে না। বছর তিনেক আগে মধ্যপ্রচ্যের কয়েকটি দেশে ফুল রপ্তানি হতো। রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরো ইপিবি থেকে তথ্য দেয়া হয় তা হচ্ছে পান ও ফুল রপ্তানি এইচএস কোড একই। এজন্য অনেকই ফুল রপ্তানি করতে পারে। দেশে এখনো ফুল রপ্তানির কোনো নীতিমালা হয়নি। এজন্য ফুল ব্যবসায়ীরা ফুল রপ্তানির একটি নীতিমালা চান। পাশাপাশি রপ্তানির জন্য সরকারের সহযোগিতা চান তারা। ফুল আমদানি যা হয় তা তাজা ফুলের চেয়ে বেশি প্লাস্টিকের ফুল। এছাড়া যেসব ফুল দেশে উৎপাদন হয় না, সেসব ফুল মাঝেমধ্যে আমদানি হয়। যেমন- লং স্টিক রোজ, লিলিয়াম, জার্বেরা, স্টোমা, কার্নিশন।

বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) হিসাবে, বাংলাদেশে বর্তমানে ৩২ হাজার টনের বেশি ফুল উৎপাদিত হচ্ছে। এখন পর্যন্ত আট ধরনের ফুলের উৎপাদন হিসাব রাখে বিবিএস। তাদের হিসাবে, গত অর্থবছর দেশে ৩২ হাজার ১২০ টন ফুল উৎপাদিত হয়েছে। এই উৎপাদন আগের বছরের তুলনায় ১২ শতাংশ বেশি। এ সময় ৩ হাজার ৯৩০ হেক্টর জমিতে ফুলের চাষ হয়।