ঢাকা ২১ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ৬ আশ্বিন ১৪৩১ | বেটা ভার্সন

নতুন কারিকুলাম নিয়ে ধোঁয়াশা কাটেনি

নতুন কারিকুলাম নিয়ে ধোঁয়াশা কাটেনি

শিক্ষায় রূপান্তর ঘটানোর সরকারি পরিকল্পনা অনুযায়ী এ বছর তিনটি শ্রেণিতে চালু হয়েছে আলোচিত নতুন কারিকুলাম। কিছুটা দেরিতে হলেও এই কারিকুলামের পাঠ্যবই অনুযায়ী চলছে প্রথম, ষষ্ঠ ও সপ্তম শ্রেণির পাঠ কার্যক্রম। শিক্ষার্থীদের পরীক্ষা, মুখস্ত নির্ভরতা ও বাড়ির কাজ কমানোর পাশাপাশি ক্লাসেই পড়া আয়ত্বে আনা, হাতে-কলমে শেখা এবং অন্যান্য বিষয়ে পারদর্শিতা বাড়ানোর প্রতি গুরুত্ব দেয়া হয়েছে নতুন এই কারিকুলামে।

ক্লাস কার্যক্রমের ভিত্তিতে ধারাবাহিক এবং বছরে দুটি পর্বে সামষ্টিক মূল্যায়ন পদ্ধতির এই শিক্ষা কার্যক্রমে শিক্ষার্থীদের রোল নম্বর নির্ধারণ বা গতানুগতিক প্রতিযোগিতার সুযোগও থাকছে না। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে চালু থাকা এ ধরনের শিক্ষা পদ্ধতিকে অনেকে ইতিবাচক মনে করলেও যথাযথ প্রস্তুতি, প্রশিক্ষণ, তদারকি ও প্রয়োজনীয় অবকাঠামোর অভাব, শ্রেণি শিক্ষকদের অনৈতিক প্রাইভেট তৎপরতা বৃদ্ধিসহ নানা কারণে নতুন কারিকুলামের প্রকৃত উদ্দেশ্য ব্যাহত হওয়ার আশঙ্কা করছেন শিক্ষাবিদরা।

এদিকে নতুন শিক্ষাক্রমের বিভিন্ন পাঠ্যবইয়ের বিতর্কিত বিভিন্ন বিষয়বস্তু ও ভুলত্রুটি নিয়ে ব্যাপক সমালোচনা অব্যাহত আছে। এরইমধ্যে ২০২৩ শিক্ষাবর্ষের ষষ্ঠ ও সপ্তম শ্রেণির জন্য প্রণীত পাঠ্যপুস্তকের অসংগতি, ভুল বা ত্রুটি চিহ্নিত করে তা সংশোধনে প্রয়োজনীয় সুপারিশের জন্য ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের (আইইআর) পরিচালক আব্দুল হালিমকে আহ্বায়ক করে একটি কমিটি গঠন করা হয়েছে। এছাড়া ভুলত্রুটির জন্য দায়ীদের খুুঁজে বের করতে মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা বিভাগের অতিরিক্ত সচিব খালেদা আক্তারকে আহ্বায়ক করে আরেকটি কমিটি করা হয়েছে।

তবে এসব কমিটির সুপারিশের আগেই দুটি বই প্রত্যাহার করে নেয়া হয়েছে। আরো তিনটি বইয়ের সংশোধনী করা হবে বলে জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড (এনসিটিবি) জানিয়েছেন।

সূত্রমতে, নতুন শিক্ষাক্রমে ষষ্ঠ ও সপ্তম শ্রেণিতে ‘ইতিহাস ও সামাজিক বিজ্ঞান’ এবং ‘বিজ্ঞান’ বিষয়ে দুটি করে বই আছে। এর এক অংশের নাম দেয়া হয়েছে ‘অনুশীলন বই’ ও অপর অংশের নাম দেয়া হয়েছে ‘অনুসন্ধানী পাঠ’। গত শুক্রবার জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ডের (এনসিটিবি) এক বিজ্ঞপ্তিতে, দুটি শ্রেণিতেই ইতিহাস ও সামাজিক বিজ্ঞান বিষয়ের ‘অনুসন্ধানী পাঠ’ বই দুটি পাঠদান থেকে প্রত্যাহার করে নেয়া হয়। আর দুই শ্রেণির ইতিহাস ও সামাজিক বিজ্ঞান বিষয়ের ‘অনুশীলন বই’ এবং ষষ্ঠ শ্রেণির বিজ্ঞান বিষয়ের ‘অনুসন্ধানীপাঠ’ বইয়ের কিছু অধ্যায়ের প্রয়োজনীয় সংশোধন করা হবে বলে জানানো হয়।

নতুন কারিকুলাম চালু হওয়া দেশের বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষক, শিক্ষার্থী ও অভিভাবকরা জানিয়েছেন, এ কারিকুলামে শ্রেণি কার্যক্রম শুরু হলেও এখনো ধোঁয়াশা কাটেনি। কারিকুলাম বিষয়ে মাত্র ৫ দিনের প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত শিক্ষরা এখনও পাঠদান ও মূল্যায়ন পদ্ধতি আয়ত্ব করতে পারেননি। বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে এখনো নতুন বই হাতে পায়নি শিক্ষার্থীরা। এ অবস্থায় শিক্ষাবর্ষের প্রায় দেড় মাস অতিবাহিত হতে চললেও শিক্ষার্থীরা তেমন লেখাপড়া এগোতে পারেনি। আর পড়ালেখা শুরুর একপর্যায়ে দুটি বই প্রত্যাহার হওয়ায় তাদের মাঝে নানা প্রশ্ন দেখা দিয়েছে। উদ্ভুত পরিস্থিতিতে সন্তানদের শিক্ষাকার্যক্রম নিয়ে চরম উদ্বেগের মধ্যে পড়েছেন অভিভাবকরা। আর এই সুযোগ কাজে লাগিয়ে শ্রেণি শিক্ষকরা প্রাইভেট পড়ানোর তৎপরতা আরো বাড়িয়ে দিয়েছেন। অনেক শিক্ষক মূল্যায়নের ভীতি দেখিয়ে শিক্ষার্থীদের প্রাইভেট পড়তে উৎসাহী করছেন বলেও অভিযোগ পাওয়া গেছে। একইসঙ্গে কোচিং সেন্টার ও অন্যান্যদের প্রাইভেট তৎপরতাও চাঙ্গা হয়ে উঠেছে বলে জানা গেছে।

বিভিন্ন স্কুলে ষষ্ঠ ও সপ্তম শ্রেণিতেপড়ুয়া শিক্ষার্থীদের বেশ কয়েকজন অভিভাবক জানান, ক্লাসে বলা হচ্ছে যে, ধারাবাহিক মূল্যায়নের ৬০ শতাংশ মার্ক শিক্ষকদের হাতে। তাই এ মার্ক পেতে শিক্ষকদের কাছে প্রাইভেট পড়তে হবে। তাছাড়া যেহেতু শ্রেণি শিক্ষক ছাড়া বাইরের অন্য কেউ এ কারিকুলামের ট্রেনিং পাননি তাই গতানুগতিক কোনো কোচিং বা প্রাইভেট শিক্ষকদের কাছে পড়িয়ে কোনো লাভ হবে না। এজন্য বাধ্য হয়েই অভিভাবকরা তাদের সন্তানদের শ্রেণি শিক্ষকদের কাছে মোটা অঙ্কের টাকার বিনিময়ে প্রাইভেট পড়তে দিচ্ছেন। অথচ ‘শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষকদের কোচিং বাণিজ্য নীতিমালা-২০১২’ অনুযায়ী শ্রেণি শিক্ষকদের প্রাইভেট পড়ানোর সুযোগ নেই। তাছাড়া এটি নতুন কারিকুলামের মূল উদ্দেশ্য পরিপন্থি বলে মনে করেন অনেকে।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে স্বাধীনতা শিক্ষক পরিষদের (স্বাশিপ) সাধারণ সম্পাদক অধ্যক্ষ শাহজাহান আলম সাজু আলোকিত বাংলাদেশকে বলেন, নতুন যে কারিকুলাম চালু হয়েছে তা বিশ্বের বিভিন্ন দেশে আছে। সেখানে শিক্ষার্থীরা স্কুলেই হাতে-কলমে শিক্ষা অর্জন করে। এতে বাড়িতে বা কোচিং-প্রাইভেটে পড়ার প্রয়োজন হয় না। এ দেশে শিক্ষকরা যদি অনৈতিকভাবে শ্রেণির শিক্ষার্থীদের প্রাইভেট পড়ান তাহলে নতুন কারিকুলামের সেই উদ্দেশ্য ব্যাহত হওয়ার আশঙ্কা আছে। এ বিষয়ে শিক্ষকদের অনৈতিক প্রাইভেট তৎপরতা বন্ধের আহ্বান জানান তিনি।

তবে নতুন কারিকুলাম বিষয়ে জাকির হোসেন নামে একজন মাস্টার ট্রেইনার শিক্ষক বলেন, আসলে নতুন কারিকুলামে শিক্ষার্থীদের রোল নম্বর বা পরীক্ষার নম্বর নিয়ে প্রতিযোগিতা থাকছে না। এখানে কেউ ফেল করবে না। তিনটি গ্রেডিংয়ে মূল্যায়ন করা হবে। তাই তাদের পড়ালেখা কমে যাবে। প্রাইভেট পড়ারও কোনো প্রয়োজন হবে না। কিন্তু নতুন কারিকুলাম বিষয়ে অনেকেই ধোঁয়াশার মধ্যে থাকায় আতঙ্কিত হয়েই এখন প্রাইভেট পড়ানোর দিকে ঝুঁকছে।

এদিকে নতুন কারিকুলাম নিয়ে নানা সমালোচনা করে একজন শিক্ষক বলেন, এ কারিকুলাম আন্তর্জাতিক প্রেক্ষাপটে ইতিবাচক হলেও এ দেশের বাস্তবতায় তা যথাযথ বাস্তবায়ন করা কঠিন। গত বছর ষষ্ঠ শ্রেণিতে পাইলটিংয়ের সময় এ বিষয়ে নানা অসঙ্গতি তুলে ধরলেও তা আমলে নেয়া হয়নি। শিক্ষকদের কারিকুলাম বিষয়ে মাত্র ৫ দিনের যে ট্রেনিং দেয়া হয়েছে তাতে পাঠদান ও মূল্যায়ন করতে তারা তেমন দক্ষতা অর্জন করতে পারেননি। বিষয়ভিত্তিক কোনো ট্রেনিংও তারা পাননি। আর ৫ দিনের ট্রেনিংয়ের সময় অনেকের হাতেই ছিল না সংশ্লিষ্ট গাইড বই। এ সময় একটি মাত্র মডেল ক্লাস নিয়েছেন তারা। তাছাড়া ট্রেনিংয়ে অংশ নেয়া শিক্ষকদের সবাই সমান দক্ষ নন। এভাবে ট্রেনিংপ্রাপ্তরা ক্লাসে কীভাবে পড়াবেন এবং মূল্যায়ন করবে- তা নিয়ে প্রশ্ন থেকে যাচ্ছে।

অপরদিকে নতুন শিক্ষাবর্ষের প্রায় দেড় মাস চললেও এখনও ধারাবাহিক মূল্যায়নের সংশ্লিষ্ট অ্যাপস শিক্ষকদের দেয়া হয়নি। ফলে অনেকে ডাইরি ব্যবহার করছেন। দেশের একেক এলাকার স্কুলে শিক্ষকদের পাঠদান পদ্ধতিতেও ভিন্নতা দেখা গেছে। তাছাড়া কুষ্টিয়ার সরকারি একটি স্কুলে সপ্তম শ্রেণির শিক্ষার্থীরা গণিত, বাংলাসহ নতুন কারিকুলামের অনেক বই এখনো পায়নি বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে। এতে পড়ালেখা চরম ব্যাহত হচেছ। এছাড়া ক্লাস ও গ্রুপ প্রজেক্ট কর্মকাণ্ডের একপর্যায়ে হঠাৎ দুটি বই প্রত্যাহার করে নেয়ায় শিক্ষার্থীরা বেশ হতাশ হয়েছেন। নতুন কারিকুলামে শিক্ষাকার্যক্রমের বাস্তব অবস্থা তদারকিতে এখনো সরকারের কোনো তৎপরতা নেই বলেও সংশ্লিষ্টদের অভিযোগ।

প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত শিক্ষকরা জানান, নতুন কারিকুলাম অনুযায়ী শিক্ষার্থীদের গ্রুপ ওয়ার্কসহ নানা কাজে শিক্ষক-শিক্ষার্থীর যে অনুপাত থাকা দরকার দেশের বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে তার ব্যবধান অনেক বেশি। এতে শিক্ষকদের পক্ষে যথাযথভাবে পাঠদান করা সম্ভব হচ্ছে না। তাছাড়া অনেক প্রতিষ্ঠানে পর্যাপ্ত বেঞ্চ ও ক্লাসরুমসহ প্রয়োজনীয় অবকাঠামোও নেই। এদিকে সাপ্তাহিক ছুটি দুই দিন হওয়ায় বর্তমানে প্রতিদিন ক্লাসের সংখ্যাও বেড়েছে। এতে শিক্ষার্থীদের পাশাপাশি শিক্ষদের ওপর বাড়তি চাপ পড়ছে বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে। এ অবস্থায় নতুন কারিকুলামের সুফল পেতে শিক্ষকদের পর্যাপ্ত প্রশিক্ষণ এবং সরকারের সংশ্লিষ্ট দপ্তরের মাধ্যমে শিক্ষাকার্যক্রম যথাযথ মনিটরিংয়ের ওপর গুরুত্বারোপ করেছেন তারা।

নতুন কারিকুলামের দুটি বই প্রত্যাহার প্রসঙ্গে এনসিটিবির সদস্য (শিক্ষাক্রম) অধ্যাপক মো. মশিউজ্জামান বলেন, যে দুটি বই প্রত্যাহার করা হয়েছে, তা এ বছর আর দেয়া হবে না। কারণ ওই বই দুটির দুটি অংশ ছিল। এখন যে অংশটি রয়েছে তা দিয়েই বিষয়টি কাভার হবে। শিক্ষার্থীদের শিখনে কোনো সমস্যা হবে না বলেই বই দুটি প্রত্যাহার করে নেয়া হয়েছে।

তিনি আরও বলেন, ইতিহাস ও সামাজিক বিজ্ঞান বইয়ের অনুশীলন বইয়ে আমরা নানা বিশ্বের নানা সভ্যতার ইতিহাস তুলে ধরেছি। এসব ইতিহাসকে প্রদর্শন করতে গিয়ে ‘অনুসন্ধানী পাঠে’ মিসরীয় সভ্যতা, সুমেরীয় সভ্যতা ও মেসোপটেমিয়া সভ্যতাগুলো এসেছে, প্রাচীন দেব-দেবী নিয়ে কথা এসেছে, তাদের সংস্কৃতির নানা ছবি ব্যবহার হয়েছে। যদি ষষ্ঠ ও সপ্তম শ্রেণির বাচ্চাদের জন্য প্রাচীন সভ্যতার বিষয়টি কঠিন হয়ে যায়, তাহলে তা আমরা কমিটির সঙ্গে আলোচনা করে উপরের শ্রেণিতে নিয়ে যাব।

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত