ঢাকা ২১ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ৬ আশ্বিন ১৪৩১ | বেটা ভার্সন

আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস কাল

আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস কাল

স্মৃতিবহ ভাষা আন্দোলনের মহান শহীদ দিবস আগামীকাল। অমর একুশে ফেব্রুয়ারি। একই সঙ্গে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসও। মাতৃভাষা আন্দোলনের ৭১ বছর পূর্ণ হবে এদিন। জাতির জীবনে অবিস্মরণীয় ও চিরভাস্বর দিন। ১৯৫২ সালের এই দিনে মাতৃভাষা বাংলার মর্যাদা রাখতে গিয়ে বুকের

রক্ত ঢেলে দিয়েছিল রফিক, সালাম, বরকত, সফিউর, জব্বাররা। তাদের রক্তে শৃঙ্খলমুক্ত হয়েছিল দুঃখিনী বর্ণমালা, মায়ের ভাষা। বাঙালি জাতিসত্তা বিকাশের যে সংগ্রামের সূচনা সেদিন ঘটেছিল, মুক্তিযুদ্ধের গৌরবময় পথ বেয়ে স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের মধ্য দিয়ে তা চূড়ান্ত পরিণতি লাভ করে। একুশের প্রথম প্রহর থেকেই জাতি কৃতজ্ঞ চিত্তে ভাষাশহীদদের স্মরণ করছে। সবার কণ্ঠে বাজছে একুশের অমর শোকসংগীত ‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি/ আমি কি ভুলিতে পারি...।’

রাজধানী ঢাকায় কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারের বেদীতে পুষ্পস্তবক অর্পণ এবং বিভিন্ন স্থানে আলোচনা সভাসহ নানা কর্মসূচির মধ্য দিয়ে জাতি একুশের মহান শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা জানাবে। এদিন রাত ১২টা ১ মিনিটে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে পুষ্পস্তবক অর্পণের মধ্য দিয়ে একুশের কর্মসূচি শুরু হবে। এছাড়াও কালো ব্যাজ ধারণ, প্রভাতফেরি সহকারে আজিমপুর কবরস্থানে শহীদদের কবরে পুষ্পার্ঘ্য অর্পণ ও শ্রদ্ধা জানানো হবে। শহীদ দিবস ও আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস উপলক্ষ্যে রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ এবং প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পৃথক বাণী প্রদান করেছেন।

বাংলাদেশ ও বাঙালি জাতির আত্ম-অন্বেষার পটভূমি বিনির্মাণের গৌরবোজ্জ্বল দিন ২১ ফেব্রুয়ারি। ১৯৫২ সালের এদিন ‘বাংলাকে’ রাষ্ট্রভাষা করার দাবিতে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান ছাত্র ও যুবসমাজসহ সর্বস্তরের মানুষ প্রশাসনের ১৪৪ ধারা উপেক্ষা করে স্বতঃস্ফূর্তভাবে রাজপথে নেমে আসে। মায়ের ভাষা প্রতিষ্ঠার আন্দোলনে দুর্বার গতিতে পাকিস্তানি শাসকদের শঙ্কিত করে তোলায় ছাত্র-জনতার মিছিলে পুলিশ গুলি চালালে সালাম, জব্বার, শফিক, বরকত ও রফিক গুলিবিদ্ধ হয়ে শহীদ হন। ভাষাশহীদদের রক্তের বিনিময়ে বাঙালি জাতি সেদিন ‘মায়ের ভাষার’ মর্যাদা অর্জনের পাশাপাশি রাজনৈতিক ও আর্থসামাজিক উন্নয়নের ক্ষেত্রেও পায় নবপ্রেরণা। এরই পথ বেয়ে শুরু হয় বাঙালির স্বাধিকার আন্দোলন এবং একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ। পরে ১৯৭১ সালে ৯ মাস পাকিস্তানি সশস্ত্র বাহিনীর বিরুদ্ধে সশস্ত্র যুদ্ধের মধ্য দিয়ে বিশ্বের মানচিত্রে সংযোজিত হয় নতুন এক স্বাধীন সার্বভৌম দেশ ‘বাংলাদেশ’।

একুশে ফেব্রুয়ারির ভাষা আন্দোলনে নিহত শহীদদের স্মৃতিকে অমর করে রাখার উদ্দেশ্যে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ প্রাঙ্গণে একটি স্তম্ভ নির্মিত হয়, যা বর্তমানে ‘শহীদ মিনার’ নামে পরিচিত।

বাংলাপিডিয়ার সূত্রানুযায়ী, শহীদ মিনার প্রথম নির্মিত হয় ১৯৫২ সালের ২৩ ফেব্রুয়ারি। এর পরিকল্পনা, স্থান নির্বাচন ও নির্মাণকাজ সবই ঢাকা মেডিক্যাল কলেজের ছাত্রদের উদ্যোগে সম্পন্ন হয়। বর্তমান শহীদ মিনারের পূর্ব-দক্ষিণ কোণে শহীদদের রক্তভেজা স্থানে সাড়ে ১০ ফুট উঁচু এবং ৬ ফুট চওড়া ভিত্তির ওপর ছোট স্থাপত্যটির নির্মাণকাজ শেষ হলে এর গায়ে ‘শহীদ স্মৃতিস্তম্ভ’ লেখা একটি ফলক লাগিয়ে দেয়া হয়। নির্মাণের পরপরই এটি শহরবাসীর আকর্ষণের কেন্দ্রবিন্দু হয়ে ওঠে; প্রতিবাদী আন্দোলনের প্রতীকী মর্যাদা লাভ করে। এখানে দলে দলে মানুষ এসে ভিড় জমায়। ২৬ ফেব্রুয়ারি সকালে দৈনিক আজাদ পত্রিকার সম্পাদক আবুল কালাম শামসুদ্দীন আনুষ্ঠানিকভাবে শহীদ মিনার উদ্বোধন করেন। ওই দিনই বিকালে পুলিশ হোস্টেল ঘেরাও করে এটি ভেঙে ফেলে।

প্রথম নির্মিত শহীদ মিনারটি এভাবে ভেঙে ফেললেও পাকিস্তানি শাসকরা শহীদদের স্মৃতি মুছে ফেলতে পারেনি। সারা দেশে, বিশেষ করে শিক্ষাঙ্গনগুলোতে অনুরূপ ছোট ছোট অসংখ্য শহীদ মিনার গড়ে ওঠে এবং ১৯৫৩ সাল থেকে দেশের ছাত্র-যুবসমাজ একুশে ফেব্রুয়ারির দিনটিকে ‘শহীদ দিবস’ হিসেবে পালন করতে থাকে। মেডিক্যাল হোস্টেল প্রাঙ্গণে শহীদ মিনারের শূন্য স্থানটিতে লাল কাগজে শহীদ স্মৃতিস্তম্ভের অবিকল প্রতিকৃতি স্থাপন করে তা কালো কাপড়ে ঢেকে দেয়া হয়। সেই প্রতীকী শহীদ মিনার থেকেই সে বছর ছাত্রদের প্রথম প্রভাতফেরি শুরু হয়। পরের বছরও ছাত্ররা একইভাবে শহীদ দিবস পালন করেন।

মাতৃভাষা আন্দোলনের ৭০ বছর পূর্ণ হচ্ছে আজ। একুশে ফেব্রুয়ারি শোকাবহ হলেও এর যে গৌরবোজ্জ্বল অধ্যায় তা পৃথিবীর বুকে অনন্য। কারণ বিশ্বে একমাত্র বাঙালি জাতিই ভাষার জন্য জীবন দিয়েছে। জাতিসংঘের শিক্ষা, বিজ্ঞান ও সংস্কৃতিবিষয়ক সংস্থা (ইউনেস্কো) ১৯৯৯ সালে মহান একুশের প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসের স্বীকৃতি দেয়ার পর থেকে আন্তর্জাতিক পর্যায়েও গত কয়েক বছর ধরে দিবসটি পালিত হচ্ছে।

রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ ‘মহান শহীদ দিবস’ ও ‘আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস’ উপলক্ষ্যে দেয়া তার বাণীতে বলেছেন, ‘মহান ভাষা আন্দোলন আমাদের জাতীয় ইতিহাসে এক অবিস্মরণীয় ঘটনা। আমি সশ্রদ্ধচিত্তে স্মরণ করি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে, যিনি ১৯৪৮ সালে মাতৃভাষার দাবিতে গঠিত ‘সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ’ এর নেতৃত্ব দেন এবং কারাবরণ করেন। স্মরণ করি তৎকালীন গণপরিষদ সদস্য ধীরেন্দ্রনাথ দত্তসহ সকল ভাষা সংগ্রামীকে, যাদের দূরদৃষ্টি, অসীম ত্যাগ, সাহসিকতা, সাংগঠনিক দক্ষতা ও তাৎক্ষণিক সিদ্ধান্ত গ্রহণের ফলে ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি ভাষা আন্দোলন চূড়ান্ত পরিণতি লাভ করে। বাঙালি পায় মাতৃভাষার অধিকার। ভাষা আন্দোলন ছিল আমাদের মাতৃভাষার অধিকার প্রতিষ্ঠার পাশাপাশি নিজস্ব জাতিসত্তা, স্বকীয়তা ও সাংস্কৃতিক স্বাতন্ত্র্য রক্ষারও আন্দোলন। আমাদের স্বাধিকার, মুক্তিসংগ্রাম ও মুক্তিযুদ্ধে অমর একুশের অবিনাশী চেতনাই জুগিয়েছে অফুরন্ত প্রেরণা ও অসীম সাহস। ফেব্রুয়ারির রক্তঝরা পথ বেয়েই অর্জিত হয় মাতৃভাষা বাংলার স্বীকৃতি এবং এরই ধারাবাহিকতায় ১৯৭১ সালে আসে বাঙালির চিরকাঙ্ক্ষিত স্বাধীনতা, যার নেতৃত্ব দিয়েছেন সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান।’

বাণীতে তিনি আরও বলেন, ১৯৯৯ সালে কয়েকজন প্রবাসী বাংলাদেশির প্রাথমিক উদ্যোগ এবং সর্বোপরি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার স্বতঃস্ফূর্ত আগ্রহ ও ঐকান্তিক চেষ্টায় জাতিসংঘ কর্তৃক ২১ ফেব্রুয়ারি ‘আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস’ হিসেবে স্বীকৃতি লাভ করে। এটি জাতি হিসেবে আমাদের একটি অন্যতম গৌরবময় অর্জন। আমি ‘আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস ২০২২’ উপলক্ষ্যে বাংলাসহ বিশ্বের বিভিন্ন ভাষাভাষী জনগণ ও জাতিগোষ্ঠীকে জানাই আন্তরিক শুভেচ্ছা ও অভিনন্দন। মাতৃভাষা এবং নিজস্ব সংস্কৃতি ও ঐতিহ্য সংরক্ষণে এ দিবসটি উদযাপন একটি অনন্য উদ্যোগ।

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত