ঢাকা ২১ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ৬ আশ্বিন ১৪৩১ | বেটা ভার্সন

‘গুলশানে বহুতল ভবনে লিফট থেকেই আগুনের সূত্রপাত’

‘গুলশানে বহুতল ভবনে লিফট থেকেই আগুনের সূত্রপাত’

রাজধানীর গুলশান ২-এ ১২ তলাবিশিষ্ট বহুতল ভবনে আগুন লাগার কারণ অনুসন্ধানে কাজ করছে ফায়ার সার্ভিস। এজন্য গঠন করা হয়েছে পাঁচ সদস্যের তদন্ত কমিটি। এরইমধ্যে ভবনটি মালিকদের জিম্মায় বুঝিয়ে দেয়া হয়েছে। প্রাথমিকভাবে ধারণা করা হচ্ছে আগুনের সূত্রপাত হয়েছিল লিফটের শর্টসার্কিট থেকে। গতকাল সোমবার ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স অধিদপ্তরের মহাপরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মো. মাইন উদ্দিন এ তথ্য জানিয়েছেন। তিনি বলেন, ফায়ার সার্ভিস কর্মকর্তারা প্রাথমিকভাবে ধারণা করছেন, ওই লিফটের শর্টসার্কিট থেকেই এই আগুনের সূত্রপাত হয়েছে।

ফায়ার সার্ভিস এখনো এ ঘটনার তদন্ত করছে উল্লেখ করে তিনি আরো বলেন, এ বিষয়ে পরবর্তীতে আরো বিস্তারিত জানা যাবে। গুলশানে বহুতল ভবনে রোববার সন্ধ্যায় লাগা আগুন রাত ১১টার দিকে নিয়ন্ত্রণে আসে বলেও জানান তিনি। গতকাল সোমবার সকালে ভবনটিতে তল্লাশি চালায় ফায়ার সার্ভিস। গুলশান-২ নম্বরের ১০৪ নম্বর সড়কের ২ নম্বর হোল্ডিংয়ের ভবনটির ১১ তলায় আগুন লাগে। একপর্যায়ে আগুন ভবনের ১২ তলায় ছড়িয়ে পড়ে। ফায়ার সার্ভিসের ১৯টি ইউনিট প্রায় চার ঘণ্টার চেষ্টায় আগুন নিয়ন্ত্রণে আসে। এ ঘটনায় দুজনের মৃত্যু হয়েছে। অগ্নিকাণ্ডের সময়ে তারা ভবন থেকে লাফিয়ে পড়ে মারা যান বলে জানায় পুলিশ। অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় আহত হয়েছেন কয়েকজন।

তবে ঘটনার সঙ্গে সঙ্গে ফায়ার সার্ভিসসহ বিভিন্ন সংস্থার পক্ষে দ্রুত পদক্ষেপ না নিলে প্রাণহানির ঘটনা আরো বেশি হতো বলে ধারণা করা হচ্ছে।

বৈদ্যুতিক শর্টসার্কিট থেকে আগুনের সূত্রপাত হয় বলে পুলিশের পক্ষ থেকেও জানিয়েছে। গতকাল দুপুরের দিকে ঘটনাস্থলে উপস্থিত হয়ে সাংবাদিকদের এসব তথ্য জানান গুলশান বিভাগের উপ-পুলিশ কমিশনার আব্দুল আহাদ। তিনি বলেন, ভবনের নকশা এবং আগুনের কারণসহ অন্য কোনো ত্রুটি ছিল কি না তা খতিয়ে দেখবে ফায়ার সার্ভিস ও রাজউক। আমরা প্রাথমিকভাবে ফায়ার সার্ভিসের মাধ্যমে জানতে পেরেছি, সূত্রপাত ঘটেছিল বৈদ্যুতিক শর্টসার্কিটের কারণে।

উপ-পুলিশ কমিশনার আব্দুল আহাদ আরো বলেন, অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় এখন পর্যন্ত দুইজন মারা গেছেন। গত রোববার আনোয়ার নামে একজন এবং গতকাল ভোর ৪টার দিকে রাজু নামে আরেকজন মারা গেছেন। এ পর্যন্ত আমরা দুইজনের মৃত্যুর সংবাদ পেয়েছি। আরো দুইজন হাসপাতালে ভর্তি রয়েছেন এবং তাদের অবস্থা আশঙ্কাজনক। আরো কয়েকজন আহত হয়েছেন এবং তারা চিকিৎসা নিয়েছে বলে আমরা জেনেছি। অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় এখনো কোনো মামলা হয়নি।

গুলশান বিভাগের ডিসি বলেন, আমরা বারবার বলেছি যে, আপনারা নিজে লাফ দেবেন না। তারা যদি লাফ না দিতেন হয়তো মারা যেতেন না। যারা লাফ না দিয়ে কষ্ট করে ছিলেন, তাদের উদ্ধার করা সম্ভব হয়েছে। ভবনটির বর্তমান পরিস্থিতির বিষয়ে ডিসি আহাদ বলেন, ভবনটি এখন মালিকদের জিম্মায় রয়েছে। আমরা নিরাপত্তার বিষয়টি দেখছি।

এদিকে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনাটি তদন্তে ফায়ার সার্ভিসের পরিচালক (অপারেশন ও মেইনটেন্যান্স) লেফটেন্যান্ট কর্নেল মোহাম্মদ তাজুল ইসলাম চৌধুরীকে প্রধান করে পাঁচ সদস্যের একটি কমিটি করা হয়েছে।

আগুনে গুলশানের সেই ভবনের ১০ তলার সবকিছু পুড়ে ছাই হয়ে গেছে বলে জানিয়েছেন প্রকৌশলী মাহফুজুল হাসান। তিনি ভবন নির্মাণের সময় প্রকৌশলী হিসেবে কাজ করেছেন। গতকাল ভবনটি ঘুরে এসে এসব তথ্য জানান তিনি।

মাহফুজুল হাসান বলেন, আগুন লাগার সঙ্গে সঙ্গে অ্যালার্ম বেজেছে। সেটা শুনে যারা নিচের দিকে ছিলেন, তারা নেমেছেন। আগুন লাগার পরে প্রত্যেকেই যদি সিঁড়ি দিয়ে বের হয়ে যেতেন, তাহলে সবাই নিরাপদ হয়ে যেতে পারতেন। অনেক সময় ভুল অ্যালার্ম হয়। যারা বাসায় ছিলেন, তারা মনে করেছিলেন ভুল অ্যালার্ম হয়েছে। যখন তারা দেখেছেন আগুন এবং নিচ থেকে বলছিল আগুন লেগেছে, সবাই নেমে যান, তখন যারা পেরেছেন, নেমে এসেছেন।

মাহফুজুল হাসানের দাবি, অগ্নিদুর্ঘটনা থেকে বাঁচার জন্য সব ব্যবস্থাই ছিল। ভবনে অগ্নিনির্বাপন প্রশিক্ষণের একটি টিমও ছিল, তারা তাৎক্ষণিক ব্যবস্থাও নিয়েছে। প্রত্যেক বাসায় সচেতন করেছে।

দ্রুত আগুন ছড়িয়ে যাওয়ার পেছনে কারণ হিসেবে মাহফুজুল হাসান বলেন, পুরো ভবনটিতেই কেন্দ্রীয় শীতাতপনিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা রাখা হয়েছিল। প্রতি বাসায় সেখান থেকে সংযোগ নেয়া হয়েছিল। যখনই একটি বাসা থেকে প্রথমে ধোঁয়া যায়, আগুন কিন্তু যায়নি। ধোঁয়ার জন্যই বেশি সমস্যা হয়েছে। আর আগুন উপরে দুই দিক থেকে বেশি হয়েছে। অগ্নিকাণ্ডে ভবনটিতে ক্ষয়ক্ষতির বিষয়ে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, নিউ এজ গার্মেন্টের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) আরিফ ইব্রাহিমের ১০ ও ১১ তালা পুড়ে ছাই হয়ে গেছে। আমি সব ফ্লোরে গিয়েছি, তবে অন্যান্য ফ্লোরে মূল দরজা বন্ধ আছে।

ভবনটির নিরাপত্তার জন্য সব ব্যবস্থাই রাখা হয়েছে দাবি করে মাহফুজুল হাসান আরো বলেন, ভবনটিতে সব সিস্টেমই করা আছে। রাজউক থেকে যে সার্টিফিকেট দেয়, ওটাও নেয়া আছে।

ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের (ডিএনসিসি) মেয়র আতিকুল ইসলাম বলেছেন, আগুন যে কোনো সময়েই লাগতে পারে। ভবনটি সব নিয়ম মেনেই করা হয়েছে। কিন্তু এত সুন্দর ভবন, অথচ আগুন লাগল। জরুরি পরিস্থিতির জন্য ফায়ার ড্রিল করার মতো গার্ড ও বাসিন্দারা প্রশিক্ষিত ছিল কি না, তা জানা নেই। সাধারণত থাকে না। মেয়র দাবি করেন, আমরা ফ্যাক্টরিতে বা গার্মেন্টে প্রতিনিয়ত অগ্নিমহড়া করছি, সচেতনতামূলক কর্মসূচি পালন করছি। কিন্তু বাসাবাড়িতে সাধারণত সেটা হয় না। ফ্ল্যাট কেনেন কিংবা নিজে বাড়ি করেন, সচেতনতার কোনো বিকল্প নেই।

গতকাল বেলা সোয়া একটার দিকে ভবনটি পরিদর্শনে এসে সাংবাদিকদের এসব কথা বলেন মেয়র আতিকুল ইসলাম। মেয়র আরো বলেন, যে কোনো সময় যে কোনো জায়গায় আগুন লাগতেই পারে; কিন্তু যেটা দরকার সেটা হচ্ছে, নিরাপত্তা ও সচেতনতা। এই ভবনে যারা ছিলেন, তারা যথেষ্ট সম্পদশালী ও শিক্ষিত। কিন্তু একটা আগুনেই তারা ভবনে আটকে গেছেন। আজকে তারা আটকে গেছেন, কালকে আমিও আটকাতে পারি, আপনি আটকে যেতে পারেন।

মেয়র বলেন, ভবনটি বিল্ডিং কোড মেনেই করা হয়েছে। কিন্তু আর্থিং লাইন ও ইলেকট্রনিক লাইন একই পাইপে উঠেছে। দুই লাইনের মাঝে সেপারেশন থাকে। সেটা যদি না থাকে বা মাঝে যদি কোনো দাহ্য পদার্থ থাকে, তাহলে কিন্তু সেপারেশন হলো না। সেটা আমি ইঞ্জিনিয়ার ও ফায়ার সার্ভিসকে দেখতে বলেছি। সেন্ট্রাল এসি ছিল। সেটা থেকে কোনো কারণে আগুনের ঘটনা ঘটেছে কি না, সেটা তদন্ত হবে। ফায়ার সার্ভিস আগুনের কারণ অনুসন্ধানে তদন্ত কমিটি করেছে।

রাজধানীর গুলশানে ১২ তলা ভবনে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় ভেতরে আটকে পড়াদের উদ্ধারে বিমানবাহিনীর হেলিকপ্টার মোতায়েন করা হয়েছিল। আগুন নিয়ন্ত্রণে ঘটনাস্থলে বিমানবাহিনীর ৫টি ইউনিট এসেছিল। ৫টি ইউনিটের নেতৃত্বে থাকা বিমানবাহিনীর গ্রুপ ক্যাপ্টেন মোমিনুল ইসলাম এসব তথ্য নিশ্চিত করেছেন।

তিনি বলেন, খবর পাওয়া মাত্রই বিমানবাহিনীর ৫টি ইউনিট ঘটনাস্থলে আসে। আমরা আগুন নেভানোর কাজে ফায়ার সার্ভিসকে সাহায্য করেছি। এছাড়া ভেতরে আটকেপড়াদের উদ্ধারের জন্য হেলিকপ্টার ঘটনাস্থলে এসেছে।

উদ্ধার অভিযানে সেনাবাহিনীও মোতায়েন করা হয়। রোববার রাতে আন্তঃবাহিনী জনসংযোগ পরিদপ্তর আইএসপিআর এ তথ্য নিশ্চিত করেছে।

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত