ঢাকা ২১ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ৬ আশ্বিন ১৪৩১ | বেটা ভার্সন

ছাড়পত্র ছাড়াই রাজধানীর অলিতে-গলিতে পশু জবাই

স্বাস্থ্যঝুঁকিতে ক্রেতা, পরীক্ষা ছাড়া মাংস না কেনার পরামর্শ

স্বাস্থ্যঝুঁকিতে ক্রেতা, পরীক্ষা ছাড়া মাংস না কেনার পরামর্শ

সেলিম রেজা দীর্ঘ ২০ বছর ধরে রাজধানীর কামারপাড়ায় গরু-মহিষ ও ছাগলের ডাক্তারি পরীক্ষা ও ছাড়পত্র ছাড়াই মাংস বিক্রি করে আসছেন। সেলিমের মতোই রাজধানীর বিভিন্ন বাজারে গবাদি পশুর মাংস বিক্রেতারা স্বাস্থ্যবিধি না মেনে পশু জবাই করছেন। অনেক ক্ষেত্রে রোগাক্রান্ত গবাদিপশু জবাই করে মাংস বিক্রি করায় স্বাস্থ্যঝুঁকিতে রয়েছেন ক্রেতারা।

বিশাল আয়তনের ঢাকা দক্ষিণ ও ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনে মাত্র চারটি জবাইখানা ও ছয়জন ভেটেরিনারি সার্জন রয়েছেন। উত্তরে মহাখালী ও মোহাম্মদপুরে জবাইখানা চালু থাকলেও এই দুইটি জবাইখানায় মাত্র একজন ভেটেনারি সার্জন রয়েছেন। অন্যদিকে দক্ষিণে হাজারীবাগ ও কাপ্তনবাজারে জবাইখানা বন্ধ থাকলেও পাঁচজন ভেটেনারি সার্জেনকে চার মাস আগে নিয়োগ দেয়া হয়েছে। ফলে দুই সিটিতে গবাদিপশুর স্বাস্থ্য পরীক্ষা ছাড়াই যত্রযত্র জবাই করা হচ্ছে।

দুই সিটি করপোরেশনের সংশ্লিষ্টরা বলছেন, সাময়িকভাবে পশু জবাইয়ের স্থান সরকার কর্তৃক ঘোষিত চতুর্দিকে দেওয়াল বা বেড়া দ্বারা ঘেরা থাকতে হবে। যেখানে জবাইয়ের জন্য পশু সাময়িক জড়ো করা হয় বা সেখানে ভেটেরিনারি কর্মকর্তা বা ক্ষেত্রমতো, ভেটেরিনারিয়ান পশুর জবাই উপযুক্ততা পরীক্ষা করেন। জবাইখানার বাহিরে পশু জবাই নিষিদ্ধ। কিন্তু সিটি করপোরেশনের অবহেলায় এত বছরেও পশু জবাইয়ের বিষয়টি নিয়ন্ত্রণে আসেনি। শুধু ঈদুল আজহায় সিটি করপোরেশন পশু জবাইয়ের স্থান নির্ধারণ করে দেয়। বছরের বাকি সময়ে মাংস ব্যবসায়ীরা যত্রযত্র গবাদিপশু জবাই করছেন।

সরেজমিন রাজধানীর উত্তরা, আব্দুল্লাপুর, কামারপাড়া, শনিরআখড়া, যাত্রাবাড়ী, হাতিরপুল বাজারে গিয়ে দেখা গেছে, প্রত্যেক দিন সকালে ভেটেরিনারি সার্জনের পরীক্ষা ছাড়াই পশু জবাই হচ্ছে। বিভিন্ন রোগ ও ভাইরাসে আক্রান্ত পশু জবাই করে মাংস বিক্রি করা হচ্ছে কি না, তা ক্রেতাদের কাছে অজানাই থাকছে। অন্যদিকে জবাইখানা না থাকায় নিয়ম না মেনেই যে যার মতো যেখানে খুশি পশু জবাই করছেন। পশু জবাইয়ের পর যেখানে সেখানে বর্জ্যও ফেলা হয়। এতে ক্ষতিকর হয়ে ওঠে পরিবেশ।

গবাদিপশু জবাই নিয়ন্ত্রণ ও জনসাধারণের জন্য মানসম্মত মাংস প্রাপ্তি নিশ্চিতে যুগোপযোগী আইন রয়েছে। পশু জবাইখানা আইন ২০১১-এর ২৪(১) উপধারা অনুযায়ী, ‘যদি কোনো ব্যক্তি এই আইনে প্রণীত বিধির কোনো বিধান লঙ্ঘন করেন বা তদনুযায়ী দায়িত্ব সম্পাদনে অথবা আদেশ অথবা নির্দেশ পালনে ব্যর্থ হন, তাহা হইলে তিনি অনুরূপ লঙ্ঘন অথবা ব্যর্থতার দায়ে অনূর্ধ্ব ১(এক) বৎসর বিনাশ্রম কারাদণ্ড অথবা অন্যূন ৫ (পাঁচ) হাজার এবং অনূর্ধ্ব ২৫ হাজার টাকা পর্যন্ত অর্থদণ্ড, অথবা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত হবেন।’ দ্বিতীয়ত, ‘একই ব্যক্তি যদি পুনরায় এ আইন বা বিধির কোনো বিধান লঙ্ঘন করেন বা তদনুযায়ী দায়িত্ব সম্পাদনে বা আদেশ বা নির্দেশ পালনে ব্যর্থ হন, তাহা হইলে তিনি অনুরূপ লঙ্ঘন বা ব্যর্থতার দায়ে অনূর্ধ্ব-২ (দুই) বৎসরের বিনাশ্রম কারাদণ্ড বা অন্যূন ১০ (দশ) হাজার ও অনূর্ধ্ব ৫০ হাজার টাকা পর্যন্ত অর্থদণ্ড, অথবা উভয় দণ্ডনীয় হইবেন।’ গবাদিপশু জবাইয়ে আইন থাকলেও মাঠ পর্যায়ে প্রয়োগ নেই। জবাইখানা ও লোকবল সংকট থাকায় পশু জবাইখানা আইন বাস্তবায়ন করা সম্ভব হচ্ছে না বলে জানিয়েছে দুই সিটি করপোরেশনের সংশ্লিষ্টরা।

রাজধানীতে যত্রতত্র গবাদিপশু জবাই করা হলেও ঢাকা দুই সিটি করপোরেশনের নীরব ভূমিকা পালন করছে। অন্যদিকে জনসচেতনতার অভাবে পশু জবাইসহ মাংস ক্রয়-বিক্রয় হচ্ছে। আইন প্রয়োগের দায়িত্বে থাকলেও সিটি করপোরেশনের কোনো তৎপরতা নেই বললেই চলে। এতে প্রতারিত হচ্ছেন সাধারণ ক্রেতারা।

কাঁটাবন এলাকার বাসিন্দা জাহিদ চৌধুরী গতকাল মঙ্গলবার রাজধানীর সবচেয়ে বড় বাজার কারওয়ানবাজারে এসেছেন মাংস কিনতে। তিনি বলেন, প্রত্যেক সপ্তাহর কারওয়ানবাজার থেকে মাংস ও মাছ কেনা হয়। তবে পশু অসুস্থ নাকি সুস্থ ছিল তা জানা নেই। নিয়ম অনুযায়ী পশু জবাইয়ের আগে চিকিৎসক পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে ছাড়পত্র এবং পশুর শরীরে সিল দেবেন। কিন্তু তদারকির কারণে রোগাক্রান্ত গরু-মহিষ-ছাগল-ভেড়ার মাংস খাচ্ছি, তা বোঝার কোনো উপায় নেই।

গবাদিপশু জবাইয়ের আগে ভেটেরিনারি সার্জনের ছাড়পত্রের বিষয়ে মাংস ব্যবসায়ী আমিনুল ইসলাম বলেন, বেশিরভাগ পশু ভালো থাকায় ছাড়পত্র নেয়ার প্রয়োজন হয় না।

ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের (ডিএনসিসি) প্রধান স্বাস্থ্য কর্মকর্তা ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মো. জোবায়দুর রহমান আলোকিত বাংলাদেশকে বলেন, ডিএনসিসিতে দুটি পশু জবাইখানা রয়েছে- একটি মোহাম্মপুর অন্যটি মহাখালীতে। এছাড়া ভেটেরিনারি সার্জন আগে ছয়জন ছিলেন বর্তমানে একজন রয়েছেন। তবে সিটি করপোরেশন এলাকায় দৈনিক কী পরিমাণ পশু জবাই হয়, সেটি বলা সম্ভব নয়।

ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের (ডিএসসিসি) প্রধান স্বাস্থ্য কর্মকর্তা (অতিরিক্ত দায়িত্ব) ডা. ফজলে শামসুল কবির আলোকিত বাংলাদেশকে বলেন, ডিএসসিসির দুটি পশু জবাইখানা রয়েছে। এর মধ্যে হাজারীবাগের জবাইখানার নির্মাণ কাজ শেষ, এখন জবাইখানা ইজারা দেয়ার প্রক্রিয়া চলছে। কাপ্তানবাজারের জবাইখানার কাজ চলমান। ফলে দৈনিক কতসংখ্যক গবাদিপশু জবাই হয়, সেটি বলা সম্ভব নয়। একই সঙ্গে জবাইয়ের আগে পশুর স্বাস্থ্য পরীক্ষা হচ্ছে না।

ঢাকা মেট্রোপলিটন মাংস ব্যবসায়ী সমিতির মহাসচিব রবিউল আলম আলোকিত বাংলাদেশকে বলেন, রাজধানীতে গবাদিপশু জবাইয়ের আগে স্বাস্থ্য পরীক্ষা করা হয় না। উল্টো পরীক্ষা ছাড়াই চোরাইপথে ভারতীয় পশুর মাংস বাংলাদেশ ঢুকছে। ২০১৫ সালে ঢাকায় দৈনিক ৫ হাজার গরু জবাই হয়েছিল বর্তমানে ১ হাজার ৫০০ গরু জবাই হচ্ছে। ছাগল ৮ থেকে ১০ হাজারের জায়গায় এখন মাত্র ৮০০ জবাই করা হচ্ছে। আমাদের দেশে মাংসের চাহিদা থাকলেও ভারত থেকে চোরাইপথে মাংস আসছে।

জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ডা. লেলিন চৌধুরী আলোকিত বাংলাদেশকে বলেন, গবাদি পশুর ওপর স্টেরয়েড ট্যাবলেটের যে প্রভাব পড়ে, ওই পশুর মাংস খেলে মানুষের শরীরেও একই প্রভাব দেখা যায়। এর মধ্যে আছে শরীরে পানি জমে যাওয়া, মূত্রনালী ও যকৃতের বিভিন্ন সমস্যা, চামড়া পাতলা হয়ে যাওয়া, রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কমে যাওয়া।

তিনি আরও বলেন, তবে রোগাক্রান্ত পশুর মাংস কয়েক দিন খেলেই যে অসুস্থ হয়ে যাবেন তা নয়। শরীর যদি সুস্থ থাকে তাহলে হয়ত ধাক্কাটা সামলে নিতে পারবে। তবে যাদের আগে থেকেই আর্থ্রাইটিস, হাঁপানি ইত্যাদি রোগ আছে তাদের ক্ষেত্রে সমস্যা হওয়ার সম্ভাবনা বেশি থাকে। তাই পশুর মাংস কেনার আগে সাবধান হন। সুস্থ পশুর মাংস কেনার পরামর্শ এই বিশেষজ্ঞের।

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত