ঢাকা ২১ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ৬ আশ্বিন ১৪৩১ | বেটা ভার্সন

ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধের এক বছর

অর্থনৈতিক মন্দার কবলে বিশ্ব

শেখ হাসিনার দুরদর্শিতায় দেশের অর্থনৈতিক অবস্থা স্থিতিশীল
অর্থনৈতিক মন্দার কবলে বিশ্ব

ইউক্রেনে রাশিয়ার সামরিক অভিযানের এক বছর পূর্তি হচ্ছে আজ। গত বছরের আজকের এই দিনে রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের একটি নির্দেশনায় তছনছ হয়ে গোপল গোটা বিশ্ব। ভেঙে পড়ল ক্ষমতার ভারসাম্য। অচল হয়ে গেল বিশ্বব্যাপী অথনৈতিক সরবরাহব্যবস্থা। বেড়ে গেল জ্বালানি তেলের দাম। সেই সঙ্গে মার্কিন ডলারের বিনিময় হার। হু হু করে বেড়ে গেল নিত্যপণ্যের মূল্য। সারের দাম বৃদ্ধি পাওয়ায় আঘাত আসল কৃষি উৎপাদনেও। ক্ষুধা নিবারণের জন্য খাদ্য উৎপাদন বৃদ্ধির প্রয়োজন অত্যাবশীয় হয়ে উঠেছে। বিশ্বব্যাপী মন্দা পরিস্থিতি মোকাবিলা করার মতো সক্ষমতা কমে আসছে। কর্মসংস্থান সংকুচিত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে বেড়েছে বেকারত্ব। বিশ্বের খ্যাতনামা প্রতিষ্ঠানের কর্মী ছাঁটাই রোধ করা যাচ্ছে না। বেকার জীবনের দুঃসহ যন্ত্রণা লাঘব করতে বিশ্বের অনেক মানুষ ছোট-খাটো কাজের সন্ধান করছে। অর্থ সংকটে পুষ্টিকর খাবার জোগাড় করতে না পেরে অনেক দেশের মানুষকে অপ্রচলিত খাবার খেতে হচ্ছে। দিনে দিনে বেড়ে উঠছে পুষ্টিহীন বিশ্ব। কতদিন চলবে এই পরিস্থিতি তা কেউ বলতে পারছে না। বিশ্বের অভিভাবক প্রতিষ্ঠান জাতিসংঘ কোনোভাবেই এই সংকট কাটিয়ে উঠার পথ দেখাতে পারছে না। মাঝেমধ্যে কিছু প্রস্তাব পাস করে দায়িত্ব পার করতে চাচ্ছে। নিরাপত্তা পরিষদও অসহায়ত্ব প্রকাশ করছে। কোনো দেশ বা প্রতিষ্ঠান এই যুদ্ধ বন্ধ করতে মধ্যস্থতার ভূমিকা পালনের ইচ্ছা ব্যক্ত করার সক্ষমতা যেন হারিয়ে ফেলছে।

গত বছরের আজকের এই দিনে ইউক্রেনে রাশিয়ার সামরিক অভিযান শুরুর মধ্যদিয়ে বিশ্বের মানুষকে এই কঠিন পরিস্থিতি মোকাবিলা করতে হচ্ছে। রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের এই অদূরদর্শী নির্দেশনার পর দুই ভাগে বিভক্ত হয়ে পড়েছে শক্তিধর দেশগুলো। বেড়ে গেছে অত্যাধুনিক অস্ত্রের ব্যবসা। পশ্চিমা দেশগুলোর মধ্যে এরই মধ্যে শুরু হয়েছে স্নায়ু যুদ্ধ। ইউক্রেন যুদ্ধে কে বিজয়ী হবে, সেই বাসনা তাদের তাড়া করছে। মিত্র দেশগুলো থেকে পাওয়া অস্ত্র সরঞ্জাম নিয়ে রাশিয়ার মতো প্রশিক্ষিত বাহিনীর মোকাবিলা করতে গিয়ে ইউক্রেনের অর্থনীতি ভেঙে পড়েছে। দেশটির জ্বালানি অবকাঠামো ধ্বংস করার মধ্যদিয়ে শীতাত মানুষের জীবন আরো বিপন্ন হয়ে পড়ে। ক্ষেপণাস্ত্র হামলায় বিদ্যুৎ অবকাঠামোগুলো ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ায় বিচ্ছিন্ন হয়ে যায় বিদ্যুৎ সরবরাহ ব্যবস্থা। দেশটির পণ্য সামগ্রী অন্য দেশে পাঠাতে বন্দর ব্যাবহার করতে না পারায় আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয় কিয়েভ। আর গমের মতো খাদ্যশস্য না পেয়ে বিশ্বের বিভিন্ন দেশ পড়ে যায় কঠিন খাদ্য সংকটে। বেড়ে যায় খাদ্যপণ্যের দাম।

রাশিয়া ইউক্রেন যুদ্ধ শুরুর পর রাশিয়ার বিভিন্ন ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বে পশ্চিমা দেশগুলো অবরোধ দিলে রাশিয়াও পাল্টা অবরোধের পথ বেছে নেয়। ফলে কঠিন সংকটের মুখ পড়ে বাংলাদেশসহ আমদানি নিভর দেশগুলো। বৈশ্বিক করোনা পরিস্থিতি কাটিয়ে উঠতে না উঠতেই এই যুদ্ধ বিশ্বকে এক কঠিন অনিশ্চয়তার মুখে ঢেলে দিয়েছে। বিভিন্ন দেশ পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রাখতে আপ্রাণ চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা একজন দক্ষ ‘ক্রাইসিস ম্যানেজার’ হিসেবে পরিস্থিতি সামাল দিয়ে দেশের অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা বজায় রাখতে সক্ষম হয়েছেন। করোনাকালে বিভিন্ন ক্ষেত্রে আর্থিক প্রণোদনা ও সামাজিক নিরাপত্তা বলয় তৈরি করে বিশ্বে একটি অনুকরণীয় দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন তিনি। সে কারণে উচ্ছ্বসিত প্রশংসা অর্জন করেছেন। তিন ডোজের পর বুস্টার ডোজ করেনা টিকা দিয়ে জাতিকে শংকামুক্ত করেছেন। বাংলাদেশের আশপাশের দেশগুলো যুদ্ধের কারণে সৃষ্ট কঠিন অর্থনেতিক পরিস্থিতি সামাল দিতে না পারায় সেখানকার মানুষ দুর্বিসহ জীবন যাপন করছে। সে তুলনায় বাংলাদেশের জনগণ অনেকটাই ভালো আছে; বঙ্গবন্ধু কন্যার দুদশি, বিচক্ষণ ও সময়োপযোগী সিদ্ধান্তের কারণে। তিনি করোনা ও ইউক্রেন যুদ্ধ শুরুর পর দেশের সব অনাবাদী জমি চাষাবাদের আওতায় আনার জন্য দলীয় নেতাকর্মীসহ দেশবাসীর প্রতি উদাত্ত আহ্বান জানান। সেই সঙ্গে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ বন্ধে আন্তর্জাতিক অঙ্গনকে এগিয়ে আসতে বলেন। তিনি বলেন, রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধকে কেন্দ্র করে স্যাংশন, পাল্টা স্যাংশনের নির্মম শিকার হচ্ছে বাংলাদেশের মতো ‘নিরীহ’ দেশগুলো। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের অনুসৃত পররাষ্ট্র নীতি ‘সবার সঙ্গে বন্ধুত্ব, কারো সঙ্গে বৈরীতা নয়’ এই অবস্থানে অবিচল থাকায় রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের এই সংকটকালে দেশের অবস্থান সমুন্নত রাখতে সক্ষম হয়েছেন।

রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ শুরুর পর অনেক দেশ চরম অর্থনৈতিক মন্দা পরিস্থিতির মুখে পড়ে। করনার ধকল কাটিয়ে উঠার আগেই রাশিয়া ইউক্রেন যুদ্ধ মানুষের জীবন ধারণে অর্থনৈতিক সক্ষমতা কমিয়ে দেয়। বিভিন্ন দেশে আমিষ জাতীয় খাবার যোগার করার জন্য অপ্রাণ চেষ্টা চলছে। যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর বিশ্বব্যাপী জ্বালানি তেল ও খাদ্য সরবরাহ ব্যবস্থা ঝুঁকিপূর্ণ পরিস্থিতির দিকে গড়াতে থাকলে তর তর করে বেড়ে যায় জ্বালানি তেল ও খাদ্যের দাম। আটা-ময়দার দাম বেড়ে যাওয়ায় কোনো কোনো দেশের বেকারিগুলো বন্ধ হয়ে গেছে। আর যেসব কারখানা চালু রয়েছে, সেসব কারখানার উৎপাদিত পণ্যের মূল্য আকাশচুম্বী। মানুষ ক্রয় সক্ষমতা হারিয়ে ফেলায় আর্থিক খরচের তালিকা কাটছাঁট করছে। ডলারের বিনিময় হার বেড়ে যাওয়ায় পণ্যের বিক্রয় মূল্য বাড়াতে হচ্ছে। ফলে অনেক বেশি মূল্য দিয়ে মানুষ কম পণ্য কিনছে।

ইউক্রেনে রাশিয়ার অভিযানের এক বছর পর বৈশ্বিক অর্থনীতিক কারণে মানুষের দুর্ভোগ বেড়েছে। যুদ্ধের পরিণতি হিসেবে খাদ্যশস্য ও সারের সরবরাহ কমেছে। জ্বালানির মূল্যে ঊর্ধ্বগতির সঙ্গে মূল্যস্ফীতি ও অর্থনৈতিক অনিশ্চয়তায় করোনা মহামারিতে জর্জরিত মানুষের ত্রাহি অবস্থা।

যুক্তরাষ্ট্র ও অপর ধনী দেশগুলোতে ভোগ্য পণ্যের মূল্য অনেকগুন বেড়েছে। মূলত তেলের মূল্য বৃদ্ধি ও যুদ্ধের প্রভাবে এই পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ একটি মনুষ্য বিপর্যয় হওয়ায় অর্থনীতির ওপর প্রভাব পড়ছে। ইউরোপে প্রাকৃতিক গ্যাসের মূল্য তিনগুণ বেড়েছে। উৎপাদন মূল্য বেড়ে যাওয়ায় বর্ধিত পণ্য মূল্যের ধাক্কা সাধারণ ক্রেতাদের সামলাতে হচ্ছে।

খাদ্যদ্রবের লাঘামহীন মূল্যবৃদ্ধির ফলে দরিদ্র জনগণকে বেশি দুর্ভোগে পড়তে হচ্ছে। যুদ্ধের কারণে ইউক্রেন ও রাশিয়া থেকে গম ও বার্লির সরবরাহ কমেছে। বিশেষ করে আফ্রিকা, মধ্যপ্রাচ্য ও এশিয়ার কিছু দেশের প্রধান সরবরাহকারী ছিল দেশ দুটি। এর ফলে এসব অঞ্চলে খাদ্য নিরাপত্তাহীনতা তৈরি হয়েছে। বিশ্বের অন্যতম শীর্ষ সার সরবরাহকারী দেশও রাশিয়া।

যদিও জাতিসংঘের মধ্যস্থতায় গত বছর কৃষ্ণ সাগর দিয়ে চুক্তির আওতায় ইউক্রেন থেকে কিছু খাদ্যশস্য রপ্তানি শুরু হয়েছে। কিন্তু এই চুক্তিটি আগামী মাসে নবায়ন করতে হবে। রাশিয়ার সার রপ্তানি কমে যাওয়াতে কৃষকরাও সংকটে পড়েছেন। মিসরীয়রা আমিষের ঘাটতি পূরণে মুরগির পা ও মুরগির পাখা খাবার হিসেবে গ্রহণ করছে। রাশিয়ার অন্যতম শীর্ষ গম আমদানিকারক নাইজেরিয়ায় গত বছর গড়ে খাদ্যদ্রব্যের দাম বেড়েছে ৩৭ শতাংশ। গমের ঘাটতির কারণে কিছু কিছু স্থানে রুটির দাম হয়েছে দ্বিগুণ। নাইজেরিয়ার রাজধানী আবুজাতে অন্তত ৪০ শতাংশ বেকারি বন্ধ হয়ে গেছে ময়দার দাম ২০০ শতাংশ বেড়ে যাওয়ার পর।

স্পেন সার কিনতে কৃষকদের সহযোগিতা করার জন্য ৩২০ মিলিয়ন ডলার ব্যয় করছে। ইউক্রেনে যুদ্ধ শুরুর পর দেশটিতে সারের দাম বেড়ে হয়েছে দ্বিগুণ। আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) জানিয়েছে ২০২২ সালে ১ ট্রিলিয়ন মূল্যের উৎপাদন কমেছে। জ্বালানির মূল্য কমে যাওয়ার পরও উল্লেখযোগ্য নিম্নমুখিতা রয়েছে ইউরোপ এবং মহাদেশটি মন্দার ঝুঁকি কাটছে না।

আইএমএফ বলেছে, গত বছর ধনী দেশগুলোতে খুচরা মূল্য বেড়েছে ৭ দশমিক ৩ শতাংশ। ২০২২ সালের জানুয়ারির পূর্বাভাস ছিল ৩ দশমিক ৯ শতাংশ। দরিদ্র দেশগুলোতে যুদ্ধের আগে ৫ দশমিক ৯ শতাংশ পূর্বাভাস থাকলেও তা বেড়ে হয়েছে ৯ দশমিক ৯ শতাংশ। যুক্তরাষ্ট্রে মূল্যস্ফীতি বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে দ্রুত সিদ্ধান্ত গ্রহণের দিকে ঠেলে দিয়েছে। ইন্দোনেশিয়ায় মূল্যবৃদ্ধির কারণে এরই মধ্যে হিমশিম খাওয়া ক্রেতাদের কাছে বিভিন্ন পণ্য ভাগ করে বিক্রি করা হচ্ছে। দেশটিতে ক্রেতা ধরে রাখতে এক কেজি চাল আট ভাগ না করে এখন ১০ শতাংশ করা হচ্ছে।

মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন ও রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন ইউক্রেন যুদ্ধের এক বছরের পরিস্থিতি মূল্যায়ন করতে গিয়ে এই মর্মে একমত হয়েছেন যে এই যুদ্ধ কেবল ইউক্রেনের ভূখণ্ডের মধ্যে সীমাবদ্ধ নেই। এই যুদ্ধের পরিধি আরও অনেক বিস্তৃত। এই যুদ্ধ পশ্চিমা দেশ ও রাশিয়ার টিকে থাকার লড়াই। তারা বলেছেন, প্রতিপক্ষকে অবশ্যই হারাতে হবে। পুতিন ও বাইডেনের মধ্যে কেউই যুদ্ধের প্রকৃত অবস্থা তুলে ধরেননি। তবে জো বাইডেন প্রেসিডেন্ট ঝিলোনস্কিকে এই বলে স্বপ্ন দেখিয়েছেন যে, তিনি জয়ী হবেন। অত্যাধুনিক সামরিক সরঞ্জাম ও নগদ অর্থ দিলেই রাশিয়ার বিরুদ্ধে ইউক্রেন জয়লাভ করবে সেটা নির্ধারণ করা কঠিন। পুতিন বলেছেন, এই যুদ্ধ রাশিয়ার অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার অধিকার। আর বাইডেন বলেছেন, এটি মুক্তির লড়াই।

রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের নির্দেশে প্রতিবেশী দেশ ইউক্রেনে ‘বিশেষ সামরিক অভিযান’ শুরু করে তার সেনাবাহিনী। এরপর পশ্চিমা নিষেধাজ্ঞা এবং ইউরোপে সরবরাহ উল্লেখযোগ্য কমিয়ে ফেলার সিদ্ধান্তে হ্রাস পায় রাশিয়ার জ্বালানি রপ্তানি।

ইউরোপীয় কমিশন প্রেসিডেন্ট উরসুলা ভন ডের লিয়েন ধারণা করছেন, ইউক্রেনে যুদ্ধ শুরুর আট মাসের মাথায় ইউরোপে গ্যাস সরবরাজ ৮০ শতাংশ কমিয়েছে রাশিয়া। এর ফলে পশ্চিম ইউরোপের চাহিদার বিপরীতে রাশিয়া মাত্র সাড়ে ৭ শতাংশ গ্যাস সরবরাহ করেছে। ২০২১ সালে রাশিয়া ৪০ শতাংশ চাহিদা মিটিয়েছিল। ২০২২ সালে এই পরিমাণ ছিল ১০০ বিলিয়ন ঘনফুটের সামান্য বেশি।

ইউক্রেনে রাশিয়ার আক্রমণের বর্ষপূর্তি উপলক্ষ্যে পোল্যান্ডের রাজধানী ওয়ারশের রয়্যাল ক্যাসলে ভাষণে মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন বলেছেন, কিয়েভ গর্বিত, অটল ও মুক্ত। যুদ্ধ শুরুর পর প্রথমবার ইউক্রেন সফরের একদিন পর তিনি এই ভাষণ দেন। বাইডেন বলেন, এক বছর আগে বিশ্ব কিয়েভের পতনের অপেক্ষায় ছিল। কিন্তু আমি কিয়েভ সফর করে এসেছি। আমি বলতে পারি, কিয়েভ দৃঢ়তার সঙ্গে অটল রয়েছে।

মার্কিন প্রেসিডেন্ট বলেছেন, ইউক্রেনে রাশিয়ার আক্রমণে সময়ের সবচেয়ে বড় পরীক্ষার মুখোমুখি হয়েছে বিশ্ব, ন্যাটো ও সব গণতান্ত্রিক দেশ। এক বছর পরও রাশিয়ার সামরিক অভিযানকে অন্যভাবে দেখছে না বিশ্ব। জো বাইডেন বলেছেন, আমরা গণতন্ত্র ও সার্বভৌমত্ব, আগ্রাসনমুক্ত মুক্ত জীবনের অধিকারের পক্ষে দাঁড়িয়েছি।

মার্কিন প্রেসিডেন্ট বলেন, ন্যাটো বিভক্ত হবে না এবং ইউক্রেনের প্রতি সমর্থন কমবে না। রাশিয়ার নৃশংসতাকে ছাড় দেয়া হবে না এবং ইউক্রেন কখনও রাশিয়ার জয়ের ক্ষেত্র হবে না। রুশ প্রেসিডেন্টকে আক্রমণ করে বাইডেন বলেছেন, পুতিন ভেবেছিলেন পশ্চিমারা রাশিয়ার জ্বালানির ওপর নির্ভরশীল। কিন্তু উল্টো বিকল্প বাজার খুঁজে পাওয়া গেছে। ইউক্রেনে রুশ আক্রমণের প্রথম বছরে কিয়েভ এবং দেশটির সরকার শুধু টিকে থাকেনি। তারা পাল্টা হামলাও চালিয়েছে। পশ্চিমাদের থেকে পাওয়া এম-৭৭৭ হাউইটজার দিয়ে রুশ অবস্থানে পাল্টা আঘাত হেনেছে ইউক্রেনীয় সেনাবাহিনী। এক বছর আগে ইউক্রেনের সীমান্ত এবং রাজধানী কিয়েভের দোরগোড়ায় সর্বাত্মক আক্রমণের জন্য রুশ সেনারা প্রবেশ করে। মস্কো আশা করেছিল দ্রুত জয় পাওয়া সম্ভব হবে। কিন্তু এই যুদ্ধের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ দিক হলো, ইউক্রেনের পতন হয়নি কিয়েভ হারও মানেনি।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর ইউরোপের সবচেয়ে প্রাণঘাতী এই যুদ্ধে ইউক্রেনীয়দের প্রতিরোধ বিশ্বের মানুষের নজর কাড়ছে। কয়েক দিনের মধ্যে অনেকেই কিয়েভের পতন আশঙ্কা করলেও পরিকল্পনা, সাহস, কৌশল, বিদেশি সামরিক ও আর্থিক সহযোগিতা এবং রণক্ষেত্রে রাশিয়ার ব্যর্থতা মিলে এখন পর্যন্ত ইউক্রেন শত্রুদের ঠেকিয়ে রাখতে পেরেছে। রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন যুদ্ধ আরও দীর্ঘায়িত করতে দৃঢ় সংকল্পবদ্ধ বলে মনে হচ্ছে। যুক্তরাষ্ট্র ধারণা করছে, চলমান যুদ্ধে উভয় পক্ষের প্রায় ১ লাখ মানুষের প্রাণহানি হয়েছে।

২০২২ সালের ২৪ ফেব্রুয়ারি ভোরের দিকে লাখো রুশ সেনা ইউক্রেনে প্রবেশ করে। প্রথম দিনে দক্ষিণে খেরসন এবং খারকিভের দিকে সহজেই অগ্রসর হয়। তবে তাদের মূল টার্গেট ছিল রাজধানী কিয়েভ। শহরটির ৩০ লাখ মানুষকে অবরোধ, জেলেনস্কিকে বন্দি বা হত্যা করে দ্রুত ইউক্রেনের আত্মসমর্পণের প্রত্যাশা ছিল রাশিয়ার। কিন্তু কিয়েভে রুখে দাঁড়ায় ইউক্রেনীয় ন্যাশনাল গার্ড। শহরের প্রবেশ পথগুলোতে ট্যাংক-বিধ্বংসী ব্যারিকেড তৈরি করা হয়। স্থানীয় বাসিন্দাদের বলা হয় পেট্রোলবোমা দিয়ে রুশদের ওপর হামলা চালানোর জন্য। প্রথম দিকে কিয়েভের ভেতরে অনিশ্চয়তা ছিল। ছিল আতঙ্কও। বাইরে ছিল রাশিয়ার বিশাল ও দীর্ঘ সামরিক বহর। যা ছিল ৪০ মাইল দীর্ঘ। মনে হচ্ছিল কিয়েভের পতন সময়ের ব্যাপার মাত্র। শহরের বাইরে রাশিয়া হত্যাযজ্ঞ চালালেও কিয়েভের পতন হয়নি। ইউক্রেনীয় সেনারা রাশিয়ার রসদ সরবরাহ ব্যবস্থায় আঘাত হানতে সক্ষম হয়েছে। এর ফলে উড়োজাহাজে রুশ সেনারা অবতরণ করতে ব্যর্থ হয়, ধ্বংস হয় রাশিয়ার সাঁজোয়া যান এবং রণাঙ্গন কখনও শহরের ভেতরে আসেনি। আক্রমণের প্রথম মাসের মধ্যেই রাশিয়া বুঝতে পারে, তাদের দীর্ঘ লড়াই করতে হবে। একদা অভিনেতা, এখন প্রেসিডেন্ট, ইউক্রেনের দৃঢ় প্রতিরোধের মুখ হয়ে উঠেছেন তিনি। গত বছরজুড়ে খুব কম সময় মুখে হাসি ছিল সাবেক এই টেলিভিশন তারকার। সংকটকালীন সময়েও কিয়েভ ছেড়ে নিরাপদ আশ্রয় নেননি তিনি। প্রতিদিন রাতে আইফোনের মাধ্যমে ভিডিও বক্তব্য প্রচার করেছেন। লড়াইয়ে ক্ষতিগ্রস্ত এলাকা পরিদর্শন করেছেন। সহযোগিতার জন্য বিশ্বনেতাদের কাছে আহ্বান জানিয়েছেন। নিশ্চিত করেছেন যাতে করে ইউক্রেনীয়দের দুর্ভোগ থেকে বিশ্বের মনোযোগ চলে না যায়।

ইউক্রেন যে যুদ্ধে লিপ্ত তা মনে করিয়ে দিতে সব সময় খাকি পোশাক পরছেন ৪৫ বছর বয়সি জেলেনস্কি। ২০২২ সালে টাইম সাময়িকীর ‘পারসন অব দ্য ইয়ার’ তিনি নির্বাচিত হন। বিশ্বনেতাদের সমর্থন ও সহযোগিতা নিশ্চিত করার ফলে সক্ষমতা বাড়ে। আর তাতে আসতে শুরু করে সাফল্য। ইউরোপীয় ইউনিয়ন (ইইউ), ব্রিটেন ও যুক্তরাষ্ট্র অস্ত্র দিয়ে এবং রাশিয়ার ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করে ইউক্রেনের পাশে থেকেছে। গত মাসের শেষ দিক পর্যন্ত শুধু যুক্তরাষ্ট্রই ২৯ বিলিয়ন ডলারের বেশি নিরাপত্তা সহযোগিতা দেয়ার আশ্বাস দিয়েছে।

পশ্চিমা দেশগুলোর মধ্যে ব্রিটেন, জার্মানি ও পোল্যান্ড বড় ধরনের সহযোগিতা করেছে। তবে যুক্তরাষ্ট্রের তুলনায় অনেক কম। পশ্চিমা গোয়েন্দা কর্মকর্তারা বলেছেন, ইউক্রেনকে খাটো করে এবং নিজেদের সেনাবাহিনীর সামর্থ্যকে বড় দেখেছে মস্কো।

রাশিয়ার সেনাবাহিনীর তুলনায় ইউক্রেনের বাহিনী অনেক ছোট। রাশিয়া সর্বাত্মক হামলার আশঙ্কা করছিল। দক্ষিণ ও উত্তর-পূর্ব দিকে দ্রুত এগোলেও মূল লক্ষ্য কিয়েভ দখলে ব্যর্থ হয় তারা।

পশ্চিমা কর্মকর্তারা বলছেন, যেসব জায়গায় রাশিয়া অগ্রগতি অর্জন করেছে সেগুলোও পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণে আনতে পারেনি। ইউক্রেনে রুশ আক্রমণের এক বছর পূর্ণ হলেও এই সংকটের সমাধান দৃশ্যমান হচ্ছে না।

গত ২৪ ফেব্রুয়ারি রাশিয়ার ইউক্রেন আগ্রাসনের পর বহু হতাহতের ঘটনা ঘটেছে। এরই মধ্যে ইউক্রেনের চারটি অঞ্চল অধিগ্রহণের জন্য কথিত গণভোট করেছে রাশিয়া। তবে এখনো দুই পক্ষের লড়াই চলছে। সেই যুদ্ধের সমাপ্তি ঘটাতে সহায়তা করতে চায় চীন। জানা যাচ্ছে, সে জন্য শিগগির মস্কো সফর করবেন চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং। কেন এই সংঘাতের পথ বেছে নিল রাশিয়া? কোনআশঙ্কা থেকে রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন ইউক্রেনে হামলার সিদ্ধান্ত নিলেন- সেটাই এখন বিশ্ববাসীর প্রশ্ন। জানা গেছে, রাশিয়া ও ইউক্রেনের সংঘাতের নেপথ্যে মূল কারণ হিসেবে রয়েছে ন্যাটো। ন্যাটোর আওতায় রয়েছে ৩০টি দেশ। এর মধ্যে রয়েছে যুক্তরাজ্য, যুক্তরাষ্ট্র, ফ্রান্স ও জার্মানি। আর এই গোষ্ঠীভুক্ত হওয়ার চেষ্টায় রয়েছে ইউক্রেন। এ ঘটনা নিয়েই মূলত দেশ দুটির মধ্যে টানাপড়েন শুরু হয়।

বিভিন্ন ইস্যুতে আগে থেকেই রাশিয়ার সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্ক তলানিতে রয়েছে। অন্যদিকে যুক্তরাষ্ট্র রয়েছে ন্যাটোভুক্ত দেশের তালিকায়। এদিকে, ইউক্রেন চাইছে যুক্তরাষ্ট্র, ফ্রান্স, জার্মানির মতো দেশগুলোর সঙ্গে তারাও ন্যাটোর আওতায় চলে আসুক। তবে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে একই গোষ্ঠীতে প্রতিবেশী ইউক্রেনকে দেখতে নারাজ রাশিয়া। এদিকে ন্যাটো ইউক্রেনের জন্য নিজের দরজা খুলে দিয়েছে। এটি মস্কোকে খুব একটা স্বস্তিকর নয়।

ন্যাটোতে ইউক্রেনের অন্তর্ভুক্তি নিয়ে রাশিয়া ক্ষুব্ধ হওয়ার নৈপথ্যের কারণ হচ্ছে ক্ষমতার দ্বন্দ্ব। কারণ ন্যাটোভুক্ত যে কোনো দেশে বহিরাগত আক্রমণের ক্ষেত্রে বাকি সদস্যদেশগুলোর সহায়তা পেয়ে যায় ওই সংশ্লিষ্ট দেশ। আর রাশিয়ার প্রতিবেশী ইউক্রেন যদি ন্যাটোতে প্রবেশ করে, তাহলে তাকে সহায়তা করতে এগিয়ে আসবে সদস্য দেশগুলো। আর এতেই ক্ষুব্ধ ছিল রাশিয়া।

তাছাড়া ২০১৪ সালে রাশিয়া প্রথমবার ইউক্রেনে প্রবেশ করে। তখন প্রেসিডেন্ট পুতিন সমর্থিত বিদ্রোহীরা ইউক্রেনের পূর্বাঞ্চলের বেশ বড় একটি এলাকার নিয়ন্ত্রণ নিয়ে নেয়। এরপর থেকেই তারা ইউক্রেনের সেনাবাহিনীর সঙ্গে যুদ্ধ করে আসছে। এদিকে ইউক্রেনে রাশিয়ার আগ্রাসনকে বিশ্বের সম্মিলিত বিবেকের জন্য ‘অপমান’ কড়া নিন্দা জানিয়েছেন জাতিসংঘের মহাসচিব অ্যান্তোনিও গুতেরেস। তিনি বলেছেন, এটি জাতিসংঘের সনদ এবং আন্তর্জাতিক আইনের স্পষ্ট লঙ্ঘন। জাতিসংঘের প্রধান অ্যান্তোনিও গুতেরেস প্রায় এক বছর পর সাধারণ পরিষদের বৈঠকে বুধবার বক্তব্য রাখেন। গুতেরেস বলেন, ‘এই হামলা আমাদের সম্মিলিত বিবেকের অবমাননা। এটি জাতিসংঘের সনদ এবং আন্তর্জাতিক আইনের লঙ্ঘন।’

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত