ঢাকা ২১ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ৬ আশ্বিন ১৪৩১ | বেটা ভার্সন

কিয়েভের পক্ষে জাতিসংঘে সমর্থন

রাশিয়ার সেনাদের নিঃশর্তে ইউক্রেন ছাড়ার আহ্বান

রাশিয়ার সেনাদের নিঃশর্তে ইউক্রেন ছাড়ার আহ্বান

রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ দ্বিতীয় বছরে গড়াল। গতকাল এই যুদ্ধ শুরুর এক বছর পূর্তির প্রাক্কালে পূর্ব ইউরোপের দেশ ইউক্রেনে রুশ আগ্রাসন বন্ধের আহবান পুনর্ব্যক্ত করেছে জাতিসংঘ। রাশিয়াকে অবিলম্বে নিঃশর্তভাবে কিয়েভ থেকে রুশ সৈন্য প্রত্যাহারের আহ্বান জানিয়েছে এই বিশ্ব সংস্থা। বৃহস্পতিবার ভোটাভুটির মাধ্যমে এই আহ্বান জানায় জাতিসংঘ। যুদ্ধ বন্ধের পাশাপাশি দেশটিতে স্থায়ী শান্তি প্রতিষ্ঠারও আহ্বান জানানো হয়।

ইউক্রেনের সমস্ত এলাকা থেকে বিনাশর্তে রুশ সৈন্য প্রত্যাহারের আহবান জানিয়ে আনা প্রস্তাবের ভোটাভুটিতে ব্যাপক সমর্থন পেয়েছে কিয়েভ। ভোটাভুটিতে জাতিসংঘের ১৯৩ সদস্যের মধ্যে ১৪১ সদস্যের সমর্থন পায় ইউক্রেন। প্রস্তাবের বিরোধিতা করে সাত সদস্য রাষ্ট্র। এছাড়া ভারত ও চীনসহ ৩২টি সদস্য রাষ্ট্র ভোটদান থেকে বিরত ছিল। এই ভোটভুটিতে গত বছরের অক্টোবরের তুলনায় কিয়েভের প্রতি সমর্থন সামান্য পরিবর্তিত হয়েছে। সেসময় ১৪৩টি দেশ রাশিয়ার চারটি ইউক্রেনীয় অঞ্চলকে সংযুক্ত করার ঘোষণার নিন্দায় ভোট দিয়েছিল।

ইউরোপীয় ইউনিয়নের পররাষ্ট্র নীতির প্রধান জোসেপ বোরেল বলেছেন, এই ভোট এটাই প্রমাণ করে যে, আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় ইউক্রেনের পাশে দাঁড়িয়েছে। টানা দুই দিনের বিতর্কের পর বৃহস্পতিবার এই ভোটাভুটির সময় ইউক্রেনের পররাষ্ট্রমন্ত্রী দিমিত্রো কুলেবা আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে ‘ভালো এবং মন্দের মধ্যে’ যেকোনো একটিকে বেছে নেয়ার আহ্বান জানান।

ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কির চিফ অব স্টাফ অ্যান্ড্রি ইয়ারমাক ‘রুশ আগ্রাসনের বার্ষিকীতে ইউক্রেনের পক্ষে দাঁড়ানো’ সকলের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে বলেন, বিশ্ব বোঝে সত্য কার পক্ষে।

এদিকে ভোটভুটিতে পাস হওয়া প্রস্তাবে ইউক্রেনের ‘সার্বভৌমত্ব’ এবং ‘আঞ্চলিক অখণ্ডতা’ এর পক্ষে সমর্থন পুনঃনিশ্চিত করা হয়েছে। এছাড়া রুশ দখলে চলে যাওয়া ইউক্রেনীয় অংশগুলোতে রাশিয়ার যে কোনো দাবি প্রত্যাখ্যান করা হয়েছে ওই প্রস্তাবে।

একইসঙ্গে এই প্রস্তাবে ‘রাশিয়ান ফেডারেশনকে অবিলম্বে, আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত সীমানার মধ্যে ইউক্রেনের ভূখণ্ড থেকে তার সমস্ত সামরিক বাহিনীকে সম্পূর্ণ এবং নিঃশর্তভাবে প্রত্যাহার করার’ দাবি করার পাশাপাশি ‘শত্রুতা বন্ধ করার’ আহ্বানও জানানো হয়েছে।

এর আগে ইউক্রেনে যুদ্ধ বন্ধে আরও একবার জোরালো ভাষায় আহ্বান জানান জাতিসংঘ মহাসচিব। এই যুদ্ধ ইউরোপ এবং সারা বিশ্বকে কতটা বিপদগ্রস্ত করে তুলেছে তা তুলে ধরার চেষ্টা করেন তিনি।

যুদ্ধের এক বছর পূর্তির একদিন আগে বুধবার রাতে জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের সভায় ভাষণে অ্যান্তনিও গুতেরেস বলেন, এই যুদ্ধ ‘আঞ্চলিক অস্থিরতা’ উসকে দিচ্ছে এবং সেই সাথে বিশ্বজুড়ে উত্তেজনা এবং বিভেদ সৃষ্টি করছে। তিনি বলেন, আর এ কারণে বিশ্বের গুরুত্বপূর্ণ বিভিন্ন সংকট সমাধানের ওপর থেকে নজর এবং সম্পদ সরে যাচ্ছে। গুতেরেস হুঁশিয়ার করেন, পারমাণবিক অস্ত্র ব্যবহারের পরোক্ষ হুমকির কথাও উচ্চারিত হচ্ছে। ধ্বংসের দ্বারপ্রান্ত থেকে সরে আসার এখন উপযুক্ত সময়।

করোনাভাইরাস মহামারির সংকট কাটিয়ে উঠতে না উঠতেই নতুন এক যুদ্ধের সামনে দাঁড়াতে হলো বিশ্বকে। ইউক্রেনে রাশিয়ার সেই যুদ্ধ গতকাল দ্বিতীয় বছরে গড়িয়েছে। ব্যাপক সেনা সমাবেশ ঘটিয়ে ২০২২ সালের ২৪ ফেব্রুয়ারি ইউক্রেনে হামলার নির্দেশ দেন রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন। যুদ্ধে এখন পর্যন্ত দুই দেশ হারিয়েছে লাখো সেনা ও সামরিক সরঞ্জাম। লড়াই দুই দেশের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকেনি, ইউক্রেনের হয়ে পরোক্ষভাবে সংঘাতে জড়িয়ে পড়েছে যুক্তরাষ্ট্রসহ ইউরোপের মিত্র দেশগুলো। মস্কোর পক্ষে অবস্থান নিয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের সবচেয়ে বড় প্রতিদ্বন্দ্বী চীন। এমন বাস্তবতায় পুরো বিশ্বে পড়ছে যুদ্ধের প্রভাব।

হামলা থেকে প্রাণে বাঁচতে লাখ লাখ ইউক্রেনীয় দেশ ছাড়তে বাধ্য হয়েছে। জাতিসংঘের শরণার্থী সংস্থা বলছে, যুদ্ধ শুরুর পর ১ কোটি ৮৬ লাখ মানুষ ইউক্রেন ছেড়েছে। সবশেষ তথ্যে জানা গেছে, সবচেয়ে বেশি আশ্রয় নিয়েছে পার্শ্ববর্তী দেশ পোল্যান্ডে। এছাড়া রোমানিয়া, হাঙ্গেরি, স্লোভাকিয়া, যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্যসহ আরও কয়েকটি দেশে শরণার্থী হিসেবে জায়গায় হয়েছে ইউক্রেনীয়দের।

দুনিয়ার সবচেয়ে বড় সামরিক জোট ন্যাটো। প্রেসিডেন্ট পুতিনের হুমকিকে পাত্তা না দিয়ে যুদ্ধে সরাসরি যুক্ত না হলেও কিয়েভকে অস্ত্র, সামরিক প্রশিক্ষণ, গোয়েন্দা তথ্য দিয়ে সহায়তা করে আসছে ন্যাটো। সামরিক শক্তির দিক দিয়ে বিশ্বে তালিকার পঞ্চম অবস্থানে রাশিয়া। এই যুদ্ধ শুরুর আগে রাশিয়ার ৯ লাখ সক্রিয় সেনা সদস্য ছিল। আর ইউক্রেনের ছিল ২ লাখ ৯ হাজার। গত বৃহস্পতিবার যুক্তরাজ্যের প্রতিরক্ষামন্ত্রী বেন ওয়ালেস দাবি করেছেন, ১২ মাসে ইউক্রেনের মাটিতে ১ লাখ ৮৮ হাজার সেনা হারিয়েছে রাশিয়া।

গোয়েন্দা সূত্রের বরাতে তিনি বলেন, ট্যাংক, ইরানি ড্রোন ও হেলিকপ্টার হারিয়ে নজিরবিহীন বিপর্যয়ের মুখে মস্কো। তবে ইউক্রেনের কেমন ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে, এ নিয়ে মুখ খোলেনি কিয়েভ।

রাশিয়া শুরুতে কিয়েভসহ পুরো ইউক্রেন দখল করতে চেয়েছিল। এতে ব্যর্থ হয়ে নতুন লক্ষ্য ডনবাস অঞ্চল দখল করায় মনোযোগী হয়। ইউক্রেন চায় ২০১৪ সালে রাশিয়ার দখল করা ক্রিমিয়াসহ সব ইউক্রেনীয় ভূখণ্ড থেকে রুশ সেনাদের তাড়িয়ে দিতে। এক বছর পার হলেও রাশিয়া বা ইউক্রেন কেউই তাদের লক্ষ্য অর্জন করতে পারেনি। অনেকেই বলছেন, যুদ্ধে কারা জয়ী তা মূল্যায়নের সময় আসেনি।

মার্কিন সেনাবাহিনীর জয়েন্ট চিফস অব স্টাফের চেয়ার জেনারেল মার্ক মিলি কয়েক দিন আগে বলেছিলেন, এই যুদ্ধে রাশিয়া বা ইউক্রেন কেউই নিজেদের লক্ষ্য সামরিক উপায়ে অর্জনে ব্যর্থ হতে পারে।

যুদ্ধ বন্ধ অবসানের কার্যকর আলোচনায় বসছে না দুই দেশ। এর মধ্যেই ইউক্রেনকে বিলিয়ন বিলিয়ন ডলারের সামরিক সহায়তা দিয়ে আসছে যুক্তরাষ্ট্র ও ব্রিটেনসহ মিত্র দেশগুলো। দীর্ঘদিন ধরে সামরিক ও মানবিক সহায়তায় দিয়ে আসায় অস্ত্রের মজুত ফুরিয়ে আসছে ইউরোপের। যুদ্ধের কারণে অর্থনৈতিক সংকটে পড়েছে উন্নয়নশীল দেশগুলো। রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, দ্রুত কোনো সমাধানে না পৌঁছানো গেলে ভুগতে হবে সবাইকে।

তুরস্কের প্রেসিডেন্ট রজব তাইয়্যেব এরদোয়ান শুরুর দিকে মধ্যস্থতাকারীর ভূমিকা নেয়ার পর কয়েক দফা আলোচনা হলেও সেগুলো ফলপ্রসূ হয়নি। এবার যুদ্ধের এক বছর পূর্তিতে শান্তি প্রস্তাব হাজির করতে পারে চীন। তবে ইউক্রেন ও রাশিয়া নিজেদের লক্ষ্য অর্জন থেকে পিছু হটার কোনো ইঙ্গিত না দেওয়ায় চলতি বছরের সংঘাত আরও তীব্র হওয়ার আশঙ্কাও রয়েছে।

মস্কো-কিয়েভের মধ্যে যুদ্ধবিরতির আহ্বান জানিয়ে, ১২ দফা শান্তি পরিকল্পনা প্রস্তাব করেছে রাশিয়ার মিত্র দেশ চীন। গতকাল ইউক্রেন যুদ্ধের বর্ষপূর্তিতে চীন জানিয়েছে, ইউক্রেন সংকট নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাওয়া ঠেকাতে কার্যকর ভূমিকা রাখতে চায় বেইজিং। এ বিষয়ে বেশ কিছু প্রস্তাবনা তুলে ধরা হয়েছে।

চীনের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে ১২ দফা শান্তি পরিকল্পনার প্রস্তাব রাখা হয়েছে। শান্তি পরিকল্পনার প্রথমেই আলোচনার উদ্যোগ নেয়া এবং রাশিয়ার ওপর পশ্চিমা নিষেধাজ্ঞা অবসানের আহ্বান জানানো হয়েছে। এছাড়া, পারমাণবিক স্থাপনার নিরাপত্তা, বেসামরিক নাগরিকদের সরিয়ে নিতে মানবিক করিডোর গঠনের প্রস্তাব রাখা হয়েছে। ইউক্রেন যুদ্ধ শেষ করার প্রচেষ্টায় চীনের শান্তি প্রস্তাবকে স্বাগত জানিয়েছে কিয়েভ।

এদিকে রাশিয়ার আর্থিক খাতের বিরুদ্ধে ৫০ বছরের নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে ইউক্রেন। গত বৃহস্পতিবার ইউক্রেনের পার্লামেন্ট এই নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে। এতে বলা হয়েছে, রাশিয়ার কেন্দ্রীয় ব্যাংক, দেশটির সকল বাণিজ্যিক ব্যাংক, বিনিয়োগ তহবিল, বীমাকারী এবং অন্যান্য উদ্যোগসহ বিভিন্ন রুশ আর্থিক প্রতিষ্ঠানের ওপর ৫০ বছরের জন্য ব্যাপক নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে ইউক্রেনের পার্লামেন্ট।

রাশিয়া ও ইউক্রেন যুদ্ধকে কেন্দ্র করে পারমাণবিক অস্ত্র ব্যবহারের ঝুঁকি বেড়েছে। অনেকেই আশঙ্কা করছেন যেকোনো সময় ঘটতে পারে অনাকাঙিক্ষত ঘটনা। এমন পরিস্থিতিতে পারমাণবিক অস্ত্র ব্যবহারের বিরুদ্ধে সতর্ক করলো চীন। দেশটি জানিয়েছে, রাশিয়া-ইউক্রেনে পারমাণবিক অস্ত্র ব্যবহার করা অবশ্যই উচিত নয়।

বেসামরিক নাগরিকদের রক্ষার কথা জানিয়ে দেশটি আরও জানায়, আন্তর্জাতিক মানবাধিকার আইন মেনেই দুই পক্ষের কার্যক্রম পরিচালনা করা উচিত। বেসামরিক নাগরিকদের ওপর অথবা তাদের স্থাপনায় হামলা পরিহার করা উচিত বলেও জানায় বেইজিং।

মূলত ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধের এক বছর উপলক্ষে কিয়েভ ও মস্কোর যুদ্ধবিরতি চায় চীন। ইউক্রেনের সংকটকে নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাওয়া রোধ করতে চায় তারা। চীনের এই পরিকল্পনায় শান্তি আলোচনা শুরু করার আহ্বান জানানো হয়।

যুদ্ধের বছর পূর্তিতে ইউক্রেনকে আরও ২০০ কোটি ডলার দেয়ার ঘোষণা দিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র। গত কয়েক দিন ধরেই ইউক্রেনে অস্ত্র সরবরাহের ঘোষণা দিয়ে আসছে পশ্চিমাদেশগুলো। এতে মুখ্য ভূমিকা পালন করছে মার্কিন প্রশাসন। এর আগে যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষ থেকে বলা হয়, যত দিন প্রয়োজন তত দিন ইউক্রেনের পাশে দাঁড়ানো হবে। হোয়াইট হাউজের জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা জেক সুলিভান বলেছেন, ইউক্রেনকে অতিরিক্ত ২০০ কোটি ডলার নিরাপত্তা সহায়তা দেয়া হবে।

তিনি বলেন, ইউক্রেনের কী প্রয়োজন সেদিকে আমার নজর রাখছি। ইউক্রেনের যা প্রয়োজন তাই আমারা সরবরাহ করছি। বিশেষ করে যুদ্ধক্ষেত্রের দিকে বিশেষ নজর রাখা হচ্ছে।

কয়েকদিন আগে হঠাৎ করেই কিয়েভ সফরে যান মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন। সাধারণত, যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট কোথাও গেলে যেভাবে আগে থেকেই ঢাকঢোল পেটানো হয়, এবার ছিল তার পুরো বিপরীত চিত্র। অত্যন্ত গোপনীয়তার সঙ্গে সবার চোখ ফাঁকি দিয়ে কিয়েভ পৌঁছান তিনি।

সে সময় বাইডেন বলেন, গত বছর যুদ্ধ শুরুর সময় ভ্লাদিমির পুতিন মনে করেছিলেন, ইউক্রেন খুবই দুর্বল এবং পশ্চিমা দেশগুলো বিভক্ত। কিন্তু রুশ প্রেসিডেন্ট যদি মনে করেন, তিনি ইউক্রেন ও তার পশ্চিমা মিত্রদের বিরুদ্ধে বিজয়ী হবেন, তাহলে বিরাট ভুল করেছেন।

সূত্র : বিবিসি ও আলজাজিরা

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত