রাষ্ট্রপতির বাড়িতে প্রধানমন্ত্রীর আতিথেয়তা
রচিত হলো শ্রদ্ধার এক অনন্য মহৎ দৃষ্টান্ত
প্রকাশ : ০১ মার্চ ২০২৩, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ
শাহিনুর রহমান
অবশেষে শেষ হলো অপেক্ষার পালা। তিনি আসলেন, তাকে বরণ করে নেয়া হলো। এই মহান অতিথিকে স্বাগত জানাতে একদিন আগেই নিজ বাড়িতে পৌঁছে যান রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ। গতকাল সকাল থেকেই অপেক্ষা করছিলেন কখন আসবেন সেই মহান অতিথি। পূরণ হলো যুগ যুগ ধরে লালিত স্বপ্ন। বঙ্গবন্ধু যে স্বপ্ন পুষে রেখেছিলেন, সেই একই স্বপ্ন দেখতেন তার কন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও। তাদের দুইজনেরই একান্ত ইচ্ছা ছিল, রাষ্ট্রপতি আব্দুল হামিদের বাড়িতে যাওয়ার। কিশোরগঞ্জের মিঠামইন উপজেলার কালামপুর গ্রামে রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদের গ্রামের বাড়ি। সেই বাড়িতে কোনো দিনই বঙ্গবন্ধু কিংবা শেখ হাসিনার যাওয়া হয়নি। তাদের স্বপ্ন পূরণে বাধা হয়ে দাঁড়ায় হাওর এলাকা। বছরের অধিকাংশ সময় সেখানে পানি থাকে। যাতায়াতের একমাত্র বাহন ছিল পায়ে হাঁটা কিংবা নৌকা। সেই হাওর অঞ্চলে পাকা রাস্তাঘাট, সড়ক ও সেতু নির্মাণ করে দিয়েছে বর্তমান আওয়ামী লীগ সরকার। যোগাযোগের ক্ষেত্রে সূচিত হয়েছে নবদিগন্ত। কিশোরগঞ্জের জলাশয়ের ওপর দিয়ে এলিভেটেড হাইওয়ে বাস্তবায়িত হলে হাওরাঞ্চলের দৃশ্যপট পাল্টে যাবে রাতারাতি। হাওর অঞ্চলের উন্নয়নের জন্য হাওরবাসী প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার প্রতি কৃতজ্ঞ।
সারা দেশের মতো আওয়ামী লীগ সরকারের উন্নয়নের ছোয়া পড়েছে কিশোরগঞ্জের সর্বত্র। নৌকার বদলে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা রাষ্ট্রপতির বাড়ি কালামপুরে গেলেন গাড়ি বহর নিয়ে। একদম বাড়ির আঙিনায়। প্রধানমন্ত্রীকে স্বাগত জানালেন রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদ ও তার সহধর্মিণী। এ সময় শেখ হাসিনা ছিলেন উল্লসিত আর রাষ্ট্রপতি ছিলেন উচ্ছ্বসিত। নজির সৃষ্টি হলো পরস্পরের প্রতি শ্রদ্ধার। এই মুর্হূতটি স্মরণীয় ও অনুকরণীয় হয়ে থাকবে প্রজন্মের পর প্রজন্মের জন্য। আগামী প্রজন্ম অনুপ্রাণিত হবে তাদের অনন্য মহান দৃষ্টান্ত থেকে।
মাঠে-ঘাটে আওয়ামী লীগের রাজনীতি, জাতীয় সংসদের সহকর্মী ছাড়াও পারিবারিক অঙ্গনে তাদের মধ্যকার সম্পর্ক বহুমাত্রিক। এই বাইরে আবদুল হামিদ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার একজন বিশ্বস্ত ও নির্ভরশীল অভিভাবক। আওয়ামী লীগের সংকটকালে আবদুল হামিদের মতো এমন মহান রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব শেখ হাসিনার পাশে দাঁড়ানোর কারণে আওয়ামী লীগ ২১ বছর পর ১৯৯৬ সালে আবার ক্ষমতায় আসে।
রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদ যখন জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের পৈতিক বাড়ি গোপালগঞ্জের টুঙ্গিপাড়া গিয়েছেন, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তাকে স্বাগত জানিয়েছেন। অথচ নিজ বাড়িতে স্বাগত জানানোর কোনো সুযোগ রাষ্ট্রপতি পাননি। সেই সুযোগের অপেক্ষায় ছিলেন তিনি। গতকাল মিঠামইনে বীর মুক্তিযোদ্ধা আবদুল হামিদ সেনানিবাস উদ্বোধন করতে প্রধানমন্ত্রী সেখানে যান। এই সেনানিবাসের পাশেই দেশের দীর্ঘ দিনের রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদের বাড়ি। এই সুযোগে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদের বাড়িতে গেলেন। পিতা শেখ মুজিবের ইচ্ছার একটা প্রতিফলন ঘটালেন। আর আবদুল হামিদও একটি মোক্ষম সুযোগ পেলেন। এটি যেন ছিল শেখ হাসিনার জন্য একটি প্রতিদান।
দুপুরে রাষ্ট্রপতির বাড়িতে মেহমান হলেন প্রধানমন্ত্রী। মধ্যাহ্ন ভোজে রাতাবোরো চাউলের সাদা ভাতের সঙ্গে রুই মাছ দোপেঁয়াজা, কাতল মাছ দোপেঁয়াজা, চিতল মাছ দোপেঁয়াজা, আইড় মাছ দোপেঁয়াজা, পাবদা মাছ দোপেঁয়াজা, গোলসা টেংরা মাছ দোপেঁয়াজা, কালিবাউশ মাছ দোপেঁয়াজা, শোল মাছ ভুনা, বাইম মাছ ভুনা, চিংড়ি মাছ ভুনা, বোয়াল মাছ ভুনা, গ্রাস কার্প মাছের ভুনা, বাচা মাছ ভুনা, রিটা মাছ মাখামাখা ঝোল, পাঙাশ মাছ মাখামাখা ঝোল, মশুর ডাল, সালাদ ও মিষ্টিতে রসমালাই দিয়ে প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনাকে আপ্যায়ন করেন রাষ্ট্রপতি ও তার পরিবার। জোহরের নামাজ শেষে রাষ্ট্রপতির সঙ্গে একই টেবিলে দুপুরে খাবার খান প্রধানমন্ত্রী। প্রধানমন্ত্রীকে হাওরের ২০ প্রজাতির মিঠাপানির মাছ দিয়ে আপ্যায়ন করা হয়। সঙ্গে ছিল গরু-মহিষের দুধ দিয়ে তৈরি ঐতিহ্যবাহী অষ্টগ্রামের পনির। এই পনিরের ঐতিহ্য দিল্লির মুঘল সম্রাটের দরবার পর্যন্ত ছিল। খানিকটা বিশ্রাম নিয়ে চলে যান আওয়ামী লীগের জনসভায়।
রাষ্ট্রপতির বড় ছেলে ও কিশোরগঞ্জ-৪ (ইটনা-মিঠামইন-অষ্টগ্রাম) আসনের সংসদ সদস্য রেজওয়ান আহাম্মদ তৌফিক জানান, প্রধানমন্ত্রীর এই সফরকে কেন্দ্র করে হাওরবাসীর মধ্যে উৎসবের আমেজ বিরাজ করতে থাকে। প্রধানমন্ত্রীর কাছে আমাদের হাওরবাসীর আর কোনো চাওয়া নেই। হাওরের উন্নয়নে শেখ হাসিনার অবদানের জন্য কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেন স্থানীয় জনগণ। বঙ্গবন্ধুকন্যাকে একনজর দেখার জন্য সকাল থেকে অপেক্ষা করেন স্থানীয় মানুষ। প্রধানমন্ত্রীকে কাছে পেয়েছেন এটাই ছিল তাদের সবচেয়ে বড় পাওয়া।
১৯৯৮ সালে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা প্রথমবার মিঠামইন সফর করেন। তখন আবদুল হামিদ কিশোরগঞ্জ-৪ (ইটনা-মিঠামইন-অষ্টগ্রাম) আসনের সংসদ সদস্য ও ডেপুটি স্পিকার ছিলেন। যাতায়াতের সমস্যার কারণে ওই সময় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা রাষ্ট্রপতির বাড়িতে যাননি। ‘ওই দেখা যায় তালগাছ ওই আমাদের গাঁ’ কবিতার এই পঙ্ক্তি আউড়িয়ে রাষ্ট্রপতির পৈতিক বাড়িটি দেখেছিলেন তিনি। দীর্ঘ ২৫ বছর পর প্রধানমন্ত্রী গতকাল মিঠামইন সফরে গিয়ে আবদুল হামিদের সেই ‘গাঁ’ দেখে এলেন।
‘প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে স্বাগত জানাতে কিশোরগঞ্জের মানুষ উৎসাহ ও অধীর আগ্রহের সাথে অপেক্ষা করতে থাকেন। সমগ্র জেলা ও অন্যান্য অঞ্চলের মানুষ শেখ হাসিনাকে দেখতে সমাবেশে যোগ দেন। হাওরাঞ্চলের মানুষ প্রধানমন্ত্রীর কাছে সত্যিই ঋণী। কারণ, তিনি এ অঞ্চলের ব্যাপক উন্নয়ন করেছেন।’
প্রধানমন্ত্রীকে স্বাগত জানাতে প্রধানমন্ত্রীর পোস্টার ও ব্যানার দিয়ে উপজেলার বিভিন্ন সড়কে বর্ণিল তোরণ ও গেট নির্মাণ করা হয়। প্রধানমন্ত্রীকে স্বাগত জানিয়ে দলীয় নেতারা বিলবোর্ড, ব্যানার, বেলুন, ফেস্টুন ও পোস্টার সাঁটান।
রাষ্ট্রপতির বাড়িতে দুপুরের খাবার শেষে প্রধানমন্ত্রী বিকালে মিঠামইন সদরের হেলিপ্যাডে সুধী সমাবেশে বক্তব্য দেন
এ সময় রাষ্ট্রপতি ও তার সহধর্মিণী প্রধানমন্ত্রীকে ফুল দিয়ে স্বাগত জানান।
বন্যাকবলিত এলাকা পরিদর্শনে ১৯৯৮ সালের ৩ অক্টোবর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা প্রথমবার মিঠামইন সফর করেন। তখন আবদুল হামিদ কিশোরগঞ্জ-৪ (ইটনা-মিঠামইন-অষ্টগ্রাম) আসনের সংসদ সদস্য ও ডেপুটি স্পিকার ছিলেন। দীর্ঘ ২৫ বছর পর প্রধানমন্ত্রী আবার মিঠামইন সফরে এসেছেন।
দীর্ঘ দুই যুগেরও বেশি সময় পর গতকাল সকালে মিঠামইনে এসেছেন জাতির পিতার কন্যা। বিকালে ঢাকায় ফেরেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।