ঢাকা ২১ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ৬ আশ্বিন ১৪৩১ | বেটা ভার্সন

পাওয়ার কোম্পানিগুলোর সঙ্গে অসম চুক্তি

কয়লা বিদ্যুতের দামেও টালমাটাল অবস্থা

কয়লা আমদানিতে নজর বেড়েছে সংশ্লিষ্ট সংস্থার
কয়লা বিদ্যুতের দামেও টালমাটাল অবস্থা

দেশে বিদ্যুৎকেন্দ্রের জ্বালানি হিসেবে ব্যবহার করা হয় তেল, গ্যাস ও কয়লা। যার বড় অংশই আমদানিনির্ভর। ফলে ডিজেল, ফার্নেস অয়েল, এলএনজির দাম আকাশচুম্মী হওয়ায় সাশ্রয়ী দামে বিদ্যুৎ উৎপাদনে কয়লাবিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণের দিকে ঝুঁকে পড়ে জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয়। এ প্রেক্ষাপটে বেশকিছু কয়লাবিদ্যুৎ কেন্দ্রের অনুমোদন দেয় মন্ত্রণালয়। বিশ্ববাজারে কয়লার দাম বাড়ায় সাশ্রয়ী দামে বিদ্যুৎ উৎপাদন সম্ভব হচ্ছে না। কয়লাবিদ্যুৎ উৎপাদন খরচ পড়ছে প্রায় ১৫ টাকা ৭৯ পয়সা। এতে কয়লাবিদ্যুৎ যে দামে কেনার আশা ছিল, এর চেয়ে এখন প্রায় দ্বিগুণ দাম পড়ছে।

জানা গেছে, বাগেরহাট জেলার রামপালে কয়লাবিদ্যুৎ কেন্দ্র প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে ২০১০ সালে বাংলাদেশ-ইন্ডিয়া ফ্রেন্ডশিপ পাওয়ার কোম্পানি (প্রাইভেট) লিমিটেডের উদ্যোগে ভারত ও বাংলাদেশ যৌথভাবে কয়লাবিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণের উদ্যোগ নেয়। বাংলাদেশ পাওয়ার ডেভেলপমেন্ট বোর্ড এবং ভারতের ন্যাশনাল থার্মাল পাওয়ার কপোরেশন (এনটিপিসি) লিমিটেডের মধ্যে ২০১২ সালের ২৯ জানুয়ারি একটি চুক্তি সই হয়। চুক্তির সময় রামপাল কয়লাবিদ্যুতের দাম ধরা হয়েছিল প্রতি ইউনিট ৮ টাকা ৮৫ পয়সা। বর্তমানে প্রতি ইউনিট বিদ্যুৎ প্রায় ১৫ টাকায় কিনতে হচ্ছে। পায়রা ও বরিশাল কয়লাবিদ্যুতের প্রায় একই অবস্থা।

তবে বিদ্যুৎ বিভাগের সংশ্লিষ্টরা বলছেন, আন্তর্জাতিক বাজারে কয়লার দাম হ্রাস-বৃদ্ধি হলে ইউনিটপ্রতি বিদ্যুতের দামও ওঠানামা করবে।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, গ্যাস ও কয়লা থেকে শুরু করে দেশের বেশিরভাগ বিদ্যুৎ উৎপাদনে জ্বালানি আমদানিনির্ভর। এই অবস্থা থেকে উত্তরণে নতুন নতুন গ্যাসক্ষেত্র অনুসন্ধান করতে হবে এবং আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার করে নিজস্ব গ্যাসের সর্বোচ্চ উৎপাদন নিশ্চিত করতে হবে।

পাওয়ার সেলের তথ্য অনুযায়ী, কয়লাবিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণের আগমুহূর্তে জ্বালানি মন্ত্রণালয়, পিডিবি ও কোম্পানিগুলোর মধ্যকার চুক্তির সময় যে দামে বিদ্যুৎ কেনার আশা ছিল, এর চেয়ে এখন প্রায় দ্বিগুণ দাম পড়ছে। যেমন পায়রা থেকে কেনা বিদ্যুতের দর পড়ার কথা ছিল ইউনিটপ্রতি সাড়ে ৬ টাকার মতো। এখন কয়লার দর টনপ্রতি ২৪৫ ডলার ধরা হলে বিদ্যুতের দাম ১৫ টাকার কাছাকাছি পড়তে পারে।

জ্বালানি মন্ত্রণালয় আশা করছে, চলতি বছরের মধ্যে রামপাল, চট্টগ্রামের ১২২০ মেগাওয়াট ও আদানি গ্রুপের কয়লাবিদ্যুৎ চালু হবে। এসব বিদ্যুৎকেন্দ্রের জ্বালানি হিসাবে কয়লা আমদানি করতে হবে।

সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, দেশে বিদ্যুৎ উৎপাদনে ভর্তুকি কমাতে সরকার ডিজেল, এলএনজি ও ফার্নেস তেলভিত্তিক বিদ্যুৎ উৎপাদন থেকে কিছুটা সরে কয়লাবিদ্যুৎ উৎপাদনে নজর দিয়েছিল। ওই সময়ে ফার্নেস তেলভিত্তিক বিদ্যুৎ উৎপাদনের (প্রতি ইউনিট) চেয়ে অর্ধেকের কম কয়লাবিদ্যুৎ উৎপাদনে খরচ হতো। কিন্তু রাশিয়া ও ইউক্রেন যুদ্ধের ফলে বিশ্বজুড়ে জ্বালানি খাতে অস্তিরতার সৃষ্টি হয়েছে। এখন ডিজেল, এলএনজি ও ফার্নেস অয়েলের সঙ্গে কয়লার দাম ঊর্ধ্বমুখী। ফার্নেস তেলভিত্তিক বিদ্যুৎ উৎপাদনের কাছাকাছি গিয়ে পৌঁছেছে কয়লাবিদ্যুৎ। ফলে কয়লাবিদ্যুৎ উৎপাদনে খুব একটা সুবিধা পাওয়া যাবে না।

বিশ্ববাজারে কয়লার দাম বাড়ায় এদিকে নজর দিয়েছে জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয়। এরইমধ্যে বিদ্যুৎ উৎপাদনে কয়লা আমদানিতে সরকারি, বেসরকারি ও যৌথ উদ্যোগে সই করা বিভিন্ন চুক্তি বিশ্লেষণ করতে পর্যালোচনা কমিটি গঠন করা হয়েছে। ৯ সদস্যের উচ্চ পর্যায়ের কমিটির নেতৃত্বে আছেন বিদ্যুৎ সচিব হাবিবুর রহমান। বিদ্যুৎসচিব ছাড়াও কমিটিতে পিডিবি চেয়ারম্যান, বিদ্যুৎ বিভাগের অতিরিক্ত সচিব (সমন্বয়), প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়, অর্থ মন্ত্রণালয় ও বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের প্রতিনিধিরা রয়েছেন। পিডিবির প্রধান প্রকৌশলী (বিদ্যুৎ উৎপাদন), বিদ্যুৎ উৎপাদন কোম্পানিগুলোর ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও বিদ্যুৎ বিভাগের উপসচিব (উন্নয়ন) কমিটির সদস্য সচিব হিসেবে দায়িত্ব পালন করবেন। কমিটিতে দেশে কয়লা সরবরাহ, ঋণপত্র খোলা ও কেনার প্রক্রিয়াসহ বিদ্যুৎ ক্রয় চুক্তি নিয়েও আলোচনা হয়েছে। অন্যান্য দেশ কীভাবে কয়লা কেনে, সেটিও দেখা হচ্ছে। এরপর কয়লা কেনার প্রক্রিয়া নিয়ে সুপারিশ বা মতামত জানাবে কমিটি। বিদ্যুৎ বিভাগ বিষয়টি অবহিত করে অভ্যন্তরীণ অফিস আদেশ জারি করেছে।

এ বিষয়ে বিদ্যুৎ-সচিব হাবিবুর রহমান বলেন, কয়লা আমদানি নিয়ে অভিজ্ঞতার ঘাটতি ছিল। বিদ্যুৎ বিভাগ গঠিত কমিটি এ বিষয়ে বিস্তারিত তথ্য সংগ্রহ করবে এবং করণীয় বিষয়ে সুপারিশ করবে। এলএনজির চেয়ে কয়লা থেকে কম দামে বিদ্যুৎ পাওয়া যাবে।

বিদ্যুৎ উৎপাদনের ক্ষেত্রে ডিজেল সবচেয়ে ব্যয়বহুল জ্বালানি হিসেবে পরিচিত। পিডিবির তথ্য অনুযায়ী বর্তমানে গ্যাস দিয়ে বিদ্যুতের উৎপাদন ক্ষমতা রয়েছে ৫০.৮৪ শতাংশ, এরপরেই রয়েছে ফার্নেস অয়েলে ২৭.৬৯ শতাংশ, কয়লায় ৭.৮৯ শতাংশ, চতুর্থ স্থানে থাকা ডিজেলের অনুপাত হচ্ছে ৬.০১ শতাংশ। আমদানি করা হচ্ছে ৫.৪২ শতাংশ, সোলার ও হাইড্রো থেকে আসছে ১.০৭ শতাংশ হারে।

পিডিবির একজন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেছেন, চুক্তি অনুযায়ী কয়লার মূল্য ‘পাস-থ্রু’ হবে যার অর্থ বাংলাদেশকে কয়লা আমদানির জন্য বাজার মূল্য পরিশোধ করতে হবে, কোনো মূল্যসীমা বা ছাড়ের বিধান ছাড়াই। ভারতের আদানি পাওয়ার সম্প্রতি পিডিবি বরাবর ডিমান্ড নোট ইস্যুর জন্য অনুরোধ করেছে। এখানে কয়লার দাম প্রতি মেট্রিক টন ৪০০ ডলার উল্লেখ করা হয়েছে যা বর্তমান আন্তর্জাতিক বাজারমূল্য থেকে অনেক বেশি। কয়লার দাম নিয়ে জ্বালানি মন্ত্রণালয় ও পিডিবি কর্মকর্তারা পর্যালোচনা করছেন।

বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের (বিপিডিবি) হিসাবে, গত অর্থবছরে কয়লাবিদ্যুৎ কিনতে (প্রতি ইউনিট) গড়ে ১৩ টাকা ৪০ পয়সা খরচ হয়েছে। তবে আমদানি কয়লা থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদনে খরচ হয়েছে ১৪ টাকা ৭৯ পয়সা। আর ফার্নেস তেলভিত্তিক কেন্দ্র থেকে বিদ্যুৎ কিনতে খরচ হয়েছে ১৬ টাকা ৮৬ পয়সা। ফলে দেখা যাচ্ছে, কয়লা থেকে উৎপাদিত বিদ্যুৎ এখন আর সস্তা নয়। দাম ফার্নেস তেলভিত্তিক থেকে উৎপাদিত বিদ্যুতের কাছাকাছি।

বিদ্যুৎ বিভাগের তথ্য মতে, ২০২২ সাল পর্যন্ত দেশে সরকারি-বেসরকারি মিলে ১৫৪টি বিদ্যুৎ কেন্দ্র রয়েছে। বর্তমানে জীবাশ্ম জ্বালানিচালিত ক্যাপটিভ ও নবায়নযোগ্য জ্বালানি মিলিয়ে দেশে বিদ্যুৎ উৎপাদন সক্ষমতা রয়েছে ২৬ হাজার ৭০০ মেগাওয়াট। যেখানে গত বছরের ১৬ এপ্রিল সর্বোচ্চ বিদ্যুৎ উৎপাদন হয়েছিল ১৪ হাজার ৭৮২ মেগাওয়াট। ৫৭টি গ্যাসভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র উৎপাদনে সক্ষমতা রয়েছে ১১ হাজার ১৭ মেগাওয়াট। কিন্তু গ্যাসের উৎপাদন কম হওয়ায় বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোতে এখন চাহিদার তুলনায় কম গ্যাস সরবরাহ হচ্ছে। ফলে এসব কেন্দ্রে অর্ধেকের কম বিদ্যুৎ উৎপাদন হচ্ছে। বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) প্রকৌশল অনুষদের ডিন, পেট্রোলিয়াম প্রকৌশল বিভাগের অধ্যাপক ম. তামিম বলেন, দেশের অভ্যন্তরীণ কয়লা উত্তোলনের যে পরিবেশগত ঝুঁকি ছিল, সেটা রাজনৈতিক কারণে সরকার নিতে চায়নি। ফলে আমদানি করা কয়লানির্ভর বিদ্যুৎকেন্দ্রের ঝুঁকি নিয়েছে। তবে বিশ্ববাজারে ডলার সংকটে উচ্চমূল্যের পরিস্থিতিতে আপাতত ভোগান্তি ছাড়া উপায় নেই। তাই এ মুহূর্তে দেশের জন্য এটাই সঠিক সিদ্ধান্ত। আমাদের নিজস্ব গ্যাসক্ষেত্র আবিষ্কারের দিকে মনোযোগ দিতে হবে। কারণ বিদ্যুতের উৎপাদন বাড়ানোর কোনো পরিকল্পনা নেই।

এ বিষয়ে তেল-গ্যাস-খনিজ সম্পদ ও বিদ্যুৎ-বন্দর রক্ষা জাতীয় কমিটির কেন্দ্রীয় সদস্য সচিব অধ্যাপক আনু মুহাম্মদ আলোকিত বাংলাদেশকে বলেন, সরকারের মধ্যেই কিছু কমিশন ভোগী রয়েছেন, যার কারণেই পরিবেশ ধ্বংস করে কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ করা হয়েছে। পরিবেশ ধ্বংসকারী প্রত্যেকটি প্রকল্পের পেছনে কমিশন রয়েছে। তিনি আরো বলেন, বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয় একটি কমিশন ভোগী প্রতিষ্ঠান। মন্ত্রণালয়টি পরিবেশ ধ্বংস করে কমিশন পাচ্ছে। যে প্রকল্পে যত বেশি কমিশন, সেই প্রকল্প তত দ্রুত অনুমোদন পায়। এতে বাংলাদেশর কতটা ক্ষতি হলো, সেটি মুখ্য বিষয় নয়, কমিশনটাই জ্বালানি মন্ত্রণালয়ের মুখ্য হয়ে দাঁড়িয়েছে।

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত