চট্টগ্রামে ‘ওয়ান সিটি টু টাউন’র স্বপ্ন এখন বাস্তব রূপ লাভ করার পথে। কর্ণফুলী নদীর তলদেশে বহুল প্রতীক্ষিত টানেলে যানবাহন চলাচলের অপেক্ষার পালা শেষ হচ্ছে। টানেলের কাজ শেষ হয়েছে প্রায় ৯৬ শতাংশ। বাকি ৪ দশমিক কাজও অনেকটা শেষ ধাপে। এরপর দ্বার খুলবে স্বপ্নের এই টানেলের। এটির নাম ‘বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান টানেল’। চলতি মার্চেই টানেল খুলে দেয়ার পরিকল্পনা ছিল। তবে চালু হওয়ার দিনক্ষণ এপ্রিল পর্যন্ত গড়াতে পারে বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা। টানেলে চলাচলকারী গাড়ির টোল হারও চূড়ান্ত পর্যায়ে। কী ধরনের গাড়ি চলাচল করতে পারে, এবং টোল হার কত হতে পারে তা নিয়ে একটি চিত্রও তৈরি হয়েছে। টানেলে চলবে মোটরসাইকেল ও থ্রি হুইলার যানবাহন। সব মিলে ১২ ধরনের যানবাহনের জন্য টোল হার প্রস্তাবনা চূড়ান্ত করেছে কর্তৃপক্ষ। এ ব্যাপারে প্রকল্পের পরিচালক হারুন উর রশিদ গতকাল আলোকিত বাংলাদেশকে বলেন, টানেলের সিভিল ওয়ার্ক পুরোপুরি শেষ। এখন বাকি আছে ইলেক্ট্রো মেকানিক্যাল কাজ। আমরা আশা করছি সেই কাজটা শেষ হবে এপ্রিলের প্রথম দিকে। এরপর বলা যায় শতভাগ কাজ শেষ হবে। এই মুহূর্তে ৯৬ শতাংশ কাজ শেষ হয়েছে। বাকি আছে মাত্র চার শতাংশ কাজ।
ইলেক্ট্রো মেকানিক্যাল কাজ কি- এ প্রশ্নে তিনি বলেন, ভৌত অবকাঠামো বা সিভিল ওয়ার্ক শেষ। এখন চলছে মূলত যানবাহন চলাচলের নিরাপত্তা সংশ্লিষ্ট ছোট পরিসরের কাজগুলো। বড় কোনো কাজ বাকি নেই। এটাই ইলেক্ট্রো মেকানিক্যাল কাজ।
সেতু বিভাগ সূত্র জানায়, টানেলে প্রাইভেট কার ও জিপের টোল হবে ২০০ টাকা। একই ধরনের গাড়িতে শাহ আমানত সেতুতে টোল দিতে হয় ৭৫ টাকা। মাইক্রোবাসে টানেলে টোল দিতে হবে ২৫০ টাকা। এই গাড়িতে বর্তমানে সেতুতে টোল দিতে হয় ১০০ টাকা। পিকআপের জন্য টানেলে টোল দিতে হবে ২০০ টাকা। কিন্তু এখন সেতুতে দিতে হয় ১৩০ টাকা।
যানবাহন মালিক চালকরা বলেছেন, টোল হার অনেক বেশি নির্ধারণ হচ্ছে। এতে টোল হারের কারণে টানেল ব্যবহারও কমতে পারে। তাতে রাজস্ব আয়ে নেতিবাচক প্রভাব পড়বে।
বিষয়টি নিয়ে প্রকল্প পরিচালক মো. হারুনুর রশিদ বলেন, টানেলের টোল হার নির্ধারণ করবে সেতু বিভাগ। আমরা অবকাঠামো নির্মাণকাজের সাথে যুক্ত। তবে জানতে পেরেছি টোলের হার নির্ধারণও চূড়ান্ত ধাপে।
সেতু কর্তৃক্ষ সূত্র জানায়, নির্মাণের আগে করা সমীক্ষা প্রতিবেদনে বলা হয়, টানেল চালুর পর এর ভেতর দিয়ে বছরে ৬৩ লাখ গাড়ি চলাচল করতে পারবে। সে হিসাবে দিনে চলতে পারবে ১৭ হাজার ২৬০টি গাড়ি। ২০২৫ সাল নাগাদ টানেল দিয়ে গড়ে প্রতিদিন ২৮ হাজার ৩০৫টি যানবাহন চলাচল করবে, যার মধ্যে অর্ধেক থাকবে পণ্যবাহী পরিবহণ। ২০৩০ সাল নাগাদ প্রতিদিন গড়ে ৩৭ হাজার ৯৪৬টি এবং ২০৬৭ সাল নাগাদ ১ লাখ ৬২ হাজার যানবাহন চলাচলের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা আছে।
টানেল নির্মাণ কাজ বাস্তবে আদৌ শুরু হবে কি না, তা নিয়ে জল্পনা-কল্পনা ছিল। কিন্তু ২০১৬ সালের ১৪ অক্টোবর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং প্রকল্পের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন। এরপর টানেলের ধারনা বাস্তব রুপ লাভ করতে শুরু করে। ২০১৯ সালের ২৪ ফেব্রুয়ারি টানেলের নির্মাণকাজ আনুষ্ঠানিকভাবে উদ্বোধন করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এরপর থেকে শুরু হয় টানেলের মহাকর্মযজ্ঞ। মাঝখানে ভয়াবহ করোনা মহামারি টানেলের কাজের গতি শ্লথ করে দেয়। পরে পুরোদমে শুরু হয় কাজ। এখন টানেলের স্বপ্ন বাস্তব রূপ পেতে যাচ্ছে।
গত বছরের ২৬ নভেম্বর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান টানেলের দক্ষিণ প্রান্তের একটি টিউবের পূর্তকাজের সমাপ্তি উদযাপন করা হয়েছে। এই উদযাপন অনুষ্ঠানে গণভবন থেকে ভার্চুয়ালি যুক্ত হন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। দেশের প্রথম এই টানেল নির্মিত হচ্ছে চীনের আর্থিক ও কারিগরি সহযোগিতায়। নদীর তলদেশে হওয়ায় যেকোনো সময় পানি জমতে পারে আশঙ্কায় টানেলের মধ্যে বসানো হচ্ছে ৫২টি সেচ পাম্প। টানেলে দুই প্রান্তে নির্মাণ করা হয়েছে প্রায় ৫ দশমিক ৩৫ কিলোমিটার অ্যাপ্রোচ সড়ক ও ৭৭২ মিটার দীর্ঘ ফ্লাইওভার।
প্রকল্পকাজে সংশ্লিষ্টরা জানান, টানেল চালু হলে চট্টগ্রাম নগরীর পরিধি দ্রুত পরিবর্তন হবে। অর্থাৎ পরিধি বাড়বে। চীনের সাংহাই শহরের আদলে ‘ওয়ান সিটি টু টাউন’ পরিকল্পনার অংশ হিসাবেই নির্মিত হচ্ছে টানেল। টানেলের কাজ শেষ হওয়ার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে আনোয়ারা উপজেলার অংশের জমির দাম বাড়ছে দ্রুত। বিভিন্ন শিল্প গ্রুপ নতুন নতুন কারখানা স্থাপনের জন্য এরই মধ্যে সম্ভাব্যতা যাচাই শুরু করেছে।
মূল টানেলের দৈর্ঘ্য ৩ দশমিক ৩২ কিলোমিটার। তবে সংযোগ সড়কসহ টানেলের সর্বমোট দৈর্ঘ্য ৯ দশমিক ৩৯ কিলোমিটার। নদীর নিচে সুড়ঙ্গের মাধ্যমে তৈরি করা হয়েছে ১০ দশমিক ৮০ মিটার ব্যাসের দুটি টিউব। এর প্রতিটির দৈর্ঘ্য ২ দশমিক ৪৫ কিলোমিটার। টানেলে টিউব দুটি থাকলেও সংযোগ পথ আছে তিনটি। এর মধ্যে একটি বিকল্প পথ হিসেবে প্রথম দুটির সঙ্গে যুক্ত থাকবে। দুই সুড়ঙ্গের মধ্যে প্রথম সংযোগ পথের দৈর্ঘ্য ১২ দশমিক ১৪ মিটার। দ্বিতীয় বা মধ্যবর্তী সংযোগ পথের দৈর্ঘ্য ১২ দশমিক ৩৪ মিটার। শেষটির দৈর্ঘ্য ১০ দশমিক ৭৪ মিটার। প্রতিটির ব্যাস গড়ে সাড়ে ৪ মিটার।