রাজধানীর ক্লিনিক-ডায়াগনস্টিক সেন্টার

সরকারি হাসপাতালের রোগী ভাগিয়ে নিয়ে চলছে ব্যবসা

প্রকাশ : ০৩ মার্চ ২০২৩, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ

  ফারুক আলম

রাজধানীসহ সারা দেশে সরকারি হাসপাতালের চার পাশে গড়ে উঠেছে অসংখ্য বেসরকারি হাসপাতাল, ডায়াগনস্টিক ও হেলথকেয়ার সেন্টার। কারণ এসব বেসরকারি হাসপাতালের মূল টার্গেটে থাকছে সরকারি হাসপাতালের রোগী। রোগী ভাগিয়ে নিতে সরকারি হাসপাতাল কেন্দ্রিক পাতানো হয় ফাঁদ। এই ফাঁদে পা দিয়ে সর্বস্বান্ত হচ্ছে রোগী ও তাদের স্বজনরা।

সরেজমিন ঘুরে দেখা গেছে, রাজধানীর শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের চারপাশে বাংলাদেশ শিশু হাসপাতাল ও ইনস্টিটিউট, ২৫০ শয্যা বিশিষ্ট টিবি হাসপাতাল, জাতীয় চক্ষুবিজ্ঞান ইনস্টিটিউট ও হাসপাতাল, জাতীয় অর্থোপেডিক হাসপাতাল পুনর্বাসন প্রতিষ্ঠান (নিটোর), নিউরোসায়েন্স হাসপাতালসহ জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালের মতো সরকারি হাসপাতাল রয়েছে। আর এসব হাসপাতালের রোগীদের কেন্দ্র করেই আশপাশে বহু ডায়াগনস্টিক ও হেলথ্কেয়ার সেন্টার গড়ে উঠেছে। সোহরাওয়ার্দী মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের মতোই দেশের সবচেয়ে বড় সরকারি হাসপাতাল ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল কেন্দ্র করেও বেসরকারি হাসপাতাল, ডায়াগনস্টিক ও হেলথকেয়ার গড়ে উঠেছে। শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের ঠিক উল্টো দিকে মুক্তিযোদ্ধা টাওয়ার। এই টাওয়ারে রয়েছে ঢাকা হেলথকেয়ার হাসপাতাল, প্রাইম অর্থোপেডিক ও জেনারেল হাসপাতাল অ্যান্ড ডিজিটাল ডায়াগনস্টিক সেন্টার, রেমেডি কেয়ার লিমিটেড ডায়াগনস্টিক হাসপাতাল, যমুনা জেনারেল হাসপাতাল, রয়্যাল মাল্টিস্পেশালিটি হাসপাতাল ও ডায়াগনস্টিক সেন্টার। মুক্তিযোদ্ধা টাওয়ারের মতোই শ্যামলী শিশু পার্কের বিপরীত পাশেই রূপায়ণ শেলফোর্ড ভবনে রয়েছে এসবিএস ডায়ালাইসিস সেন্টার, নূরজাহান অর্থোপেডিক এন্ড জেনারেল হাসপাতাল, ইসলাম ডায়াগনস্টিক ল্যাব, ইসলাম লেজার ফিজিওথেরাপি, আমার বাংলাদেশ হাসপাতাল, হাই কেয়ার অর্থোপেডিকস এন্ড জেনালের হাসপাতাল, আমেনা ডায়াগনস্টিক সেন্টার। এই দুই ভবনের কাছাকাছি রয়েছে ক্রিসেন্ট হসপিটাল লিমিটেড, ভিক্টোরিয়া হেলথ্কেয়ার লিমিটেড, পাশেই ট্রমা সেন্টার, পপুলার ডায়াগনস্টিক সেন্টার লিমিডেট, হেলথকেয়ার ডায়াগনস্টিক সেন্টার লিমিটেড, সিগমা মেডিক্যাল সার্ভিসেস, আর-রাফিয়ু জেনারেল হাসপাতাল, মোহাম্মদপুর কেয়ার হাসপাতাল এন্ড ডায়াগনস্টিক (প্রা.) লিমিটেড ও শমশের হার্ট কেয়ার।

জানা গেছে, সারা দেশে যত্রতত্র বেসরকারি হাসপাতাল, ডায়াগনস্টিক ও হেলথকেয়ার যাতে গড়ে উঠতে না পারে সে জন্য স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের নীতিমালা রয়েছে। নীতিমালায় বেসরকারি হাসপাতাল, ডায়াগনস্টিক সেন্টার কিংবা হেলথকেয়ারের লাইসেন্সের আবেদনের পর প্রতিষ্ঠান স্থাপনের এক মাস আগে সরেজমিন পরিদর্শন করে মন্তব্যসহ প্রতিবেদন জমা দিতে হবে। পরিদর্শনের সময় প্রতিষ্ঠানটির অনুমোদন প্রাপ্তির ক্ষেত্রে কোনো ঘাটতি থাকলে ১৫ দিনের মধ্যে আবেদনকারীকে লিখিতভাবে অবহিত করতে হবে। এছাড়াও সরকারি হাসপাতাল থেকে এক কিলোমিটার বা বিশেষ ক্ষেত্রে আধা কিলোমিটারের মধ্যে কোনো বেসরকারি হাসপাতাল, ডায়াগনস্টিক ও হেলথ্কেয়ার সেন্টার স্থাপনের সুযোগ নেই। কিন্তু সরকারি ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল ও সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালের চার পাশে কয়েক গজের মধ্যেই বহু বেসরকারি হাসপাতাল, ডায়াগনস্টিক ও হেলথ্কেয়ার সেন্টার গড়ে উঠেছে। সরকারি হাসপাতালের নাম ভাঙিয়ে চলে এসব সেন্টার।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক (ডিজি) ডা. আবুল বাশার মোহাম্মদ খুরশীদ আলম আলোকিত বাংলাদেশকে বলেন, ‘সরকারি হাসপাতাল থেকে নির্দিষ্ট দূরত্ব বজায় রেখে বেসরকারি হাসপাতাল ও ডায়াগনস্টিক সেন্টার করার নীতিমালা সবই আছে। কিন্তু দেশের প্রেক্ষাপটে এসব নীতিমালা বাস্তবায়ন করে, ধরে রাখা কঠিন। স্বাস্থ্যের নিয়মনীতি ভঙ্গ করে যেসব বেসরকারি হাসপাতাল ও ডায়াগনস্টিক সেন্টার গড়ে ওঠে তা নিয়মিত অভিযান চালিয়ে বন্ধ করে দিই। দেখা যায়, কিছুদিন পরে আবারও ওই হাসপাতাল ও ডায়াগনস্টিক সেন্টার চালু হচ্ছে। এখানে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মনিটরিংয়ের জন্য পর্যাপ্ত জনবল নেই। নীতিমালার চেয়ে মানুষের নৈতিকতা গুরুত্বপূর্ণ। মানুষের নৈতিকতা ঠিক থাকলে নীতিমালা বাস্তবায়ন হবে।’

জামালপুর থেকে চিকিৎসা নিতে ১০ ফেব্রুয়ারি সোহরাওয়ার্দী মেডিক্যাল কলেজে এসেছেন শাবানা বেগম। গ্রাম থেকে এসে তিনি উত্তরায় আত্মীয়ের বাসায় উঠেছেন। সেখান থেকে চিকিৎসা নিতে মেডিক্যালে আসেন। প্রথম দিন কয়েকটি টেস্ট দেন চিকিৎসক, যা বাইরে থেকে করতে হয়েছে। শাবানা বেগমের মতোই উত্তরার এক গার্মেন্ট কর্মী লাভলী বেগম কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে এসেছেন। প্রথম দিনেই চিকিৎসক তাকে বেশ কয়েকটি টেস্ট করাতে বলেন, যা বেসরকারি হাসপাতাল ছাড়া উপায় নেই। বেসরকারি হাসপাতালে টেস্ট করেন, পরে তাকে হাসপাতালে ভর্তির জন্য পরামর্শ দেন চিকিৎসক। চিকিৎসকের পরামর্শে হাসপাতালে ভর্তি হলে তাকে ফের কয়েকটি টেস্ট করাতে বলা হয়। কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতালে টেস্টের ব্যবস্থা না থাকায় বেসরকারি হাসপাতালের দ্বারস্থ হন লাভলী বেগম। সরকারি হাসপাতালে রোগের টেস্টের ব্যবস্থার অপ্রতুলতার কারণে বাধ্য হয়ে রোগীরা বেসরকারি ডায়াগনস্টিক ও হেলথকেয়ারের চলে যাচ্ছেন।

কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে আসা লাভলী বেগম আলোকিত বাংলাদেশকে বলেন, গ্রামে ফসলি জমিতে ক্ষতিকর পোকা- মাকড় নিধনে কীটনাশকের পাশাপাশি পাতানো হয় ‘ফাঁদ’। সরকারি হাসপাতালেও সেই ফাঁদ তৈরি করা হয়েছে। চিকিৎসা নিতে এসে এক ধরনের ফাঁদে পড়েছি। দালাল চক্রের কারসাজিতে হাসপাতালে হয়রানি করা হচ্ছে। সরকারি হাসপাতালে কোনো রোগীকে কোনো রকম বেসরকারি হাসপাতালে নিতে পারলেই কেল্লা সাফ। সরকারি হাসপাতালের রোগীদের ভাগিয়ে নেয়াই ডায়াগনস্টিক ও হেলথকেয়ারের মূল টার্গেট। সেজন্য সরকারি হাসপাতালের কর্মকর্তা-কর্মচারী থেকে শুরু করে দালালচক্রের কিছু সদস্য সব সময় ঘোরাঘুরি করে।

অভিযোগ রয়েছে, দালালের মাধ্যমে রোগী ভাগিয়ে এনে চিকিৎসার নামে প্রতারণার ব্যবসা করতে সরকারি হাসপাতালের সন্নিকটে এসব ডায়াগনস্টিক সেন্টার গড়ে তোলা হয়েছে। তারপরও স্বাস্থ্য বিভাগের কিছু অসাধু কর্মকর্তা-কর্মচারীর মদদে অনুমোদন পেয়েছে এসব প্রতিষ্ঠান। তাদের মদদেই চিকিৎসাসেবার নামে রমরমা প্রতারণা ব্যবসা করছে প্রতিষ্ঠানগুলো। বেশিরভাগেরই প্রয়োজনীয় ভৌত (কক্ষ) সুবিধা নেই। নেই প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি, বর্জ্য ব্যবস্থাপনা। নেই ডিউটি ডাক্তার, ডিপ্লোমা নার্স, টেকনিশিয়ান, কর্মকর্তা-কর্মচারীসহ প্রয়োজনীয় জনবল। ক্লিনিক-ডায়াগনস্টিকের জন্য প্রয়োজনীয় স্বাস্থ্যসম্মত পরিবেশও নেই এসব প্রতিষ্ঠানে। এরপরও এসব প্রতিষ্ঠান স্বাস্থ্য বিভাগের নিবন্ধন পেয়েছে, নবায়নও হচ্ছে। আর এর সুবাদে উন্নত চিকিৎসাসেবার নামে মানুষ ঠকানোর ব্যবসা করছে মানহীন প্রতিষ্ঠানগুলো।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ডায়াগনস্টিক ও হেলথকেয়ার নিবন্ধন পেতে প্রয়োজনীয় ভৌত সুবিধা, সার্বক্ষণিক ডাক্তার, ডিপ্লোমা নার্স, ওয়ার্ডবয়, আয়া, ক্লিনারসহ প্রয়োজনীয় জনবল, যন্ত্রপাতি, স্বাস্থ্যসম্মত পরিবেশ থাকা আবশ্যক। কমপক্ষে ১০ বেডের একটি ক্লিনিকের অনুমোদনের ক্ষেত্রে শুধু রোগীর ওয়ার্ডের জন্য প্রতি বেডে ৮০ বর্গফুট করে মোট ৮০০ বর্গফুট জায়গা লাগবে। সেই সঙ্গে ওটি রুম, পোস্ট ওপারেটিভ রুম, ওয়াশ রুম, ইনস্ট্রুমেন্ট রুম, লেবার রুম, ডক্টরস ডিউটি রুম, নার্সেস ডিউটি রুম, অপেক্ষমাণ কক্ষ, অভ্যর্থনাকক্ষ, অফিস কক্ষ, চেইনঞ্জিং রুম, স্টেরিলাইজার রুম, ভান্ডার রুমসহ সামঞ্জস্যপূর্ণ অন্তত ১৩টি রুম থাকতে হবে। এছাড়া পুরুষ ও মহিলাদের জন্য আলাদা প্রয়োজনীয় সংখ্যক টয়লেট, প্রশস্ত সিঁড়ি, জেনারেটরসহ প্রয়োজনীয় ক্ষেত্রে (বিল্ডিং তিনতলার অধিক হলে) লিফটের ব্যবস্থা থাকতে হবে। ওটি রুমে শীতাতপ নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা, ওটি টেবিল, পর্যাপ্ত ওটি লাইট, সাকার মেশিন, অ্যানেসথেসিয়া মেশিন, ডায়াথারমি মেশিন, জরুরি ওষুধগুলোর ট্রে, রানিং ওয়াটার, অক্সিজেন, আইপিএসের ব্যবস্থা থাকতে হবে। সাধারণ বর্জ্য, ধারাল বর্জ্য, জীবাণুযুক্ত বর্জ্য, তরল বর্জ্যসহ সব ধরনের বর্জ্য ব্যবস্থাপনাও থাকা অত্যাবশ্যকীয়। কিন্তু এসব নিয়ম-নীতির কোনো তোয়াক্কা না করে ছোট ছোট তিন-চার রুমের বাসাবাড়িতে ক্লিনিক গড়ে তুলে চিকিৎসার নামে প্রতারণা চলছে হরদম।

হেলথ অ্যান্ড হোপ স্পেশালাইজড হাসপাতালের পরিচালক ও জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ডা. লেলিন চৌধুরী আলোকিত বাংলাদেশকে বলেন, ‘সরকারি হাসপাতালগুলোতে সেবার মান ও রোগীর চাপ বেশি থাকায় রোগীরা ঠিকভাবে সেবা পান না। এছাড়াও সরকারি হাসপাতালগুলোতে জনবল বৃদ্ধি ও সেবার মান উন্নত করতে হবে। উন্নত সেবার আশায় রোগী সরকারি হাসপাতাল ছেড়ে প্রাইভেট হাসপাতালে সেবা নিতে যান। এছাড়াও সরকারি হাসপাতালে কর্মকর্তা-কর্মচারী ও কিছু দালাল চক্র রয়েছে। যারা রোগী ও তাদের স্বজনদের ভুল বুঝিয়ে বেসরকারি হাসপাতালে নিয়ে যান। দালালদের দৌরাত্ম্য কমাতে হাসপাতালের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের নিয়মিত বদলি করতে হবে।’ তিনি আরও বলেন, ‘সরকারি হাসপাতালের কাছাকাছি বেসরকারি হাসপাতাল থাকতে পারবে না, স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের করা এই নীতিমালা বাস্তবায়ন করতে হবে।’ স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের জনসংযোগ কর্মকর্তা (পিআরও) মো. মাইদুল ইসলাম প্রধান আলোকিত বাংলাদেশকে বলেন, রাজধানীসহ সারা দেশে গড়ে উঠা অবৈধ হাসপাতাল ও ডায়াগনস্টিক সেন্টার বন্ধে নিয়মিত অভিযান করছে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর। আবার যেসব প্রতিষ্ঠানের লাইসেন্স নবায়ন করা হয়নি তাদের জরিমানা করা হচ্ছে।