এক দফা আন্দোলনের চাপ বাড়ছে বিএনপিতে

প্রকাশ : ০৪ মার্চ ২০২৩, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ

  রকীবুল হক

গত বছরের ১০ ডিসেম্বর থেকে বর্তমান সরকারের পদত্যাগসহ ১০ দফা দাবিতে যুগপৎ আন্দোলন শুরু করে বিএনপি ও সমমনা দলগুলো। পর্যায়ক্রমে বিভিন্ন কর্মসূচির মাধ্যমে দলটির কেন্দ্র থেকে তৃণমূল পর্যন্ত নেতাকর্মীদের মধ্যে বেশ উৎসাহ-উদ্দীপনাও ছড়িয়ে পড়ে। তবে প্রায় তিন মাসেও আন্দোলনের ধীরগতি দেখে বর্তমানে অনেকেই হতাশ হয়ে পড়ছেন। সরকার পতনে দ্রুত একদফার আন্দোলনে যাওয়ার পক্ষে মত দিচ্ছেন তারা। গণতন্ত্র ও ভোটাধিকার প্রতিষ্ঠায় বর্তমান সরকারের পতন ঘটানো বিএনপির মূল দাবি হওয়া উচিত বলে গতকাল মন্তব্য করেছেন দলটির স্থায়ী কমিটির সদস্য গয়েশ্বর চন্দ্র রায়। এছাড়া আগামী কোরবানির ঈদের আগেই কঠোর আন্দোলনের জন্য বিএনপির হাইকমান্ডকে পরামর্শ দিয়েছেন দলের তৃণমূল জনপ্রতিনিধিরা।

তবে বিএনপি ও সমমনা বিভিন্ন দলের নেতারা জানিয়েছেন, চলমান কর্মসূচির মাত্রা কম-বেশি হলেও যথাসময়ে কঠোর ও তীব্র আন্দোলন শুরু হবে। এজন্য যাবতীয় প্রস্তুতি চলছে। অতীতের অভিজ্ঞতা নিয়ে আগামী দিনের আন্দোলন অনেক তীব্র হবে এবং সেই আন্দোলনের মাধ্যমে নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে নির্বাচনের দাবিও আদায় হবে। তবে রোজা ও কোরবানির ঈদের পরই এই চূড়ান্ত আন্দোলন হতে পারে বলে সংশ্লিষ্টরা আভাস দিয়েছেন।

সূত্র মতে, গত ১০ ডিসেম্বর থেকে ১০ দফা দাবিতে যুগপৎ আন্দোলন শুরু হলেও তা চূড়ান্ত আন্দোলন নয় বলে জানিয়েছেন বিএনপির শীর্ষ নেতারা। মূলত নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে আগামী জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠানের দাবি আদায়ের চূড়ান্ত আন্দোলনের জন্য প্রস্তুতি নিতেই বিভিন্ন কর্মসূচি পালন করা হচ্ছে। এরই মধ্যে ঘুরে ফিরে, ঢাকাসহ বিভাগীয় শহর, জেলা, উপজেলা, পৌরসভা ও ইউনিয়ন পর্যায়ে বিক্ষোভ, অবস্থান, পদযাত্রা ইত্যাদি কর্মসূচি পালিত হয়েছে। সর্বশেষ কর্মসূচি হিসেবে আজ সব মহানগরের থানায় থানায় পদযাত্রা অনুষ্ঠিত হবে। এ কর্মসূচি সফলে কেন্দ্রীয় নেতাদের মাধ্যমে সমন্বয় টিম গঠন সহ নানা প্রস্তুতিও নেয়া হয়েছে। এ পদযাত্রা শেষে ঘোষণা করা হবে নতুন কর্মসূচি। একইভাবে আসন্ন রমজানে ইফতার পার্টিতে সীমাবদ্ধ হতে পারে চলমান কর্মসূচি। রোজার ঈদের পর কর্মসূচি আরও জোরদার করা হলেও মূলত, কোরবানির ঈদের পর চূড়ান্ত আন্দোলনে নামতে পারে বিএনপি।

এদিকে চূড়ান্ত আন্দোলনের জন্য দল গোছানো এবং যুগপৎ আন্দোলনের শরিকদের সঙ্গে যোগাযোগ ও আলোচনা পর্বও অব্যাহত রাখছে রাজপথের প্রধান বিরোধীদল বিএনপি। গত ২৩ ফেব্রুয়ারি থেকে বিএনপি থেকে নির্বাচিত ইউনিয়ন পরিষদের বর্তমান ও সাবেক চেয়ারম্যানদের সঙ্গে মতবিনিময় পর্ব চালাচ্ছে বিএনপির হাইকমান্ড। এরই মধ্যে রংপুর, খুলনা, সিলেট, বরিশাল ও ঢাকা বিভাগের জনপ্রতিনিধিদের সঙ্গে মতবিনিময় করেছেন বিএনপির শীর্ষ পর্যায়ের নেতারা। এ সময় আগামী আন্দোলনকে ঘিরে নানা পরামর্শ ও খোলামেলা আলোচনা করেছেন তারা।

সূত্র মতে, গত ২৮ মার্চ অনুষ্ঠিত মতবিনিময় সভায় সরকার হটাতে কোরবানির ঈদের আগেই কঠোর আন্দোলনে নামতে বিএনপির হাইকমান্ডকে পরামর্শ দেন দল সমর্থিত সিলেট ও খুলনা বিভাগের বর্তমান ও সাবেক জনপ্রতিনিধিরা। তার আগে আহ্বায়ক, দুর্বল ও মেয়াদোত্তীর্ণ কমিটি বিলুপ্ত করে ত্যাগী-পরীক্ষিত নেতাদের দিয়ে পূর্ণাঙ্গ ও শক্তিশালী কমিটি গঠনের আহ্বান জানান তারা। এছাড়া আগামীতে আসন সমঝোতার ভিত্তিতে নির্বাচনে অংশগ্রহণের গুঞ্জন প্রসঙ্গটিও তুলে ধরেন জনপ্রতিনিধিরা। এ সময় আগামীতে শেখ হাসিনার অধীনে কোনো সমঝোতা কিংবা আসন ভাগাভাগির নির্বাচনে বিএনপি অংশগ্রহণ করবে না বলে দলের হাইকমান্ড থেকে আশ্বস্ত করা হয়। এর আগে বিভিন্ন বিভাগের মতবিনিময় সভায় জনপ্রতিনিধিরা আগামীতে ঢাকায় কঠোর আন্দোলনের পরামর্শ দেন।

সর্বশেষ গত শুক্রবার ঢাকা বিভাগের জনপ্রতিনিধিদের সভায় বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. আব্দুল মঈন খান বলেন, আমরা যে আন্দোলন করছি, এই আন্দোলনে ইনশাআল্লাহ আমরা সফলতা অর্জন করব। আমরা এই সরকারের অবসান ঘটিয়ে এখানে একটি গণতান্ত্রিক সরকার প্রতিষ্ঠা করতে পারব। চলমান কর্মসূচি কোন পর্যায়ে নিয়ে গেলে বর্তমান সরকারের অবসান ঘটানো যাবে- এ বিষয়ে জনপ্রতিনিধিদের মতামত কামনা করেন তিনি।

এদিকে গতকাল শুক্রবার জাতীয় প্রেসক্লাবের সামনে এক অনুষ্ঠানে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য গয়েশ্বর চন্দ্র রায় বলেন, গণতন্ত্র ও ভোটাধিকার প্রতিষ্ঠায় ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ সরকারের পতন ঘটানো বিএনপির মূল দাবি হওয়া উচিত।

দেশের রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক পরিস্থিতি তুলে ধরে গয়েশ্বর রায় বলেন, এখন আমাদের মুখ্য দাবি হওয়া দরকার রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা থেকে এই সরকারকে প্রত্যাহার করতে হবে, এই সরকারকে সরাতে হবে। জনগণের ভোটের অধিকার নিশ্চিত করে সুষ্ঠু ও অবাধ এবং অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের মধ্যদিয়ে দেশে একটি জনগণের সরকার প্রতিষ্ঠা করা এখন অপরিহার্য।

চলমান গণতান্ত্রিক আন্দোলনে সবাইকে অংশ নেয়ার আহ্বান জানিয়ে গয়েশ্বর রায় বলেন, দেশের কথা চিন্তা করেন, ১৯৭১ সালের মতো গণতন্ত্রের বিরুদ্ধে অবস্থানকারীদের রুখে দাঁড়ান। ১৯৭১ সালে গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের স্বপ্ন নিয়ে মুক্তিযুদ্ধ করেছি; সেই গণতন্ত্রের জন্য আমরা এখন যুদ্ধ করছি। এই যুদ্ধে অংশগ্রহণ করবেন, নাকি বিরোধিতা করবেন? অংশগ্রহণ করলে ভালো, না করলে ১৯৭১ সালের মতো রাজকারের খাতায় নাম লেখাবেন।

আন্দোলন প্রসঙ্গে বিএনপির কেন্দ্রীয় একজন নেতা জানান, আগামী কোরবানির ঈদের পর চূড়ান্ত আন্দোলন হবে। এর আগে চলমান ইস্যুভিত্তিক বিভিন্ন কর্মসূচির পাশাপাশি দল গোছানোর কাজ চলবে। ইউনিয়ন জনপ্রতিনিধিদের সঙ্গে চলমান মতবিনিময় কার্যক্রমও এই দল গোছানোর অংশ বলে তিনি উল্লেখ করেন।

বিএনপির যুগপৎ আন্দোলনের শরিক জাতীয় গণতান্ত্রিক পার্টির (জাগপা) সভাপতি খন্দকার লুৎফর রহমান আলোকিত বাংলাদেশকে বলেন, আমাদের দাবি আদায়ের জন্য আগামীতে কঠোর আন্দোলন হবেই। চলমান আন্দোলন আস্তে আস্তে কঠোরের দিকে এগিয়ে যাবে। তৃণমূল পর্যন্ত নেতাকর্মীরা আন্দোলনের জন্য প্রস্তুত বলেও মন্তব্য করেন তিনি।

এদিকে এখন আর নানা দফার পরিবর্তে দুই দফার ভিত্তিতে কঠোর আন্দোলনের রোডম্যাপ শুরু করা জরুরি বলে মন্তব্য করেন ১২ দলীয় জোট নেতা, বাংলাদেশ লেবার পার্টির চেয়ারম্যান ডা. মোস্তাফিজুর রহমান ইরান। আলোকিত বাংলাদেশকে তিনি বলেন, এখন একটাই টার্গেট হওয়া উচিত-নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে আগামী জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠান। আর এই নির্বাচনের করতে হলে অবশ্যই খালেদা জিয়ার মুক্তি জরুরি। তাই খালেদা জিয়ার মুক্তি ও নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে নির্বাচনের এই দুই দফার ভিত্তিতে আন্দোলনে নামতে হবে।

তিনি আরো বলেন, এখন কোন পন্থী বাছ-বিচার না করে নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে নির্বাচন প্রত্যাশী সবাইকে নিয়ে আন্দোলন করতে হবে। যেহেতু বিএনপির পক্ষ থেকে জাতীয় সরকারের কথা বলা হয়েছে, তাই নির্বাচনের আগেই যারা জাতীয় সরকার ইস্যু নিয়ে কথা বলছে তারা মূলত একটি ভিন্ন পরিস্থিতি সৃষ্টি করে অশুভ শক্তিকে ক্ষমতায় আনতে চায়। এ বিষয়ে বিএনপিকে সতর্ক থাকতে হবে।