ঢাকা ২১ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ৬ আশ্বিন ১৪৩১ | বেটা ভার্সন

জামাতুল আনসার ফিল হিন্দাল শারক্বীয়া

পলাতক ২১ জঙ্গির সন্ধান নেই

পলাতক ২১ জঙ্গির সন্ধান নেই

নতুন জঙ্গি সংগঠন জামাতুল আনসার ফিল হিন্দাল শারক্বীয়ার আহ্বানে সাড়া দিয়ে ঘরছাড়া তালিকাভুক্ত ৫৫ তরুণের মধ্যে এখন পর্যন্ত ২১ জন পলাতক রয়েছে বলে জানা গেছে। তবে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর এলিটফোর্স র‍্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (র‍্যাব) দাবি করেছে, ওই জঙ্গি সদস্যরা সংগঠনটির প্রশিক্ষণ শিবিরে থাকার প্রমাণ পেয়েছে তারা। তালিকাভুক্ত ৫৫ জনের মধ্যে ৩৩ জনকে শনাক্ত করতে পেরেছে বলেও জানিয়েছে সংস্থাটির আইন ও গণমাধ্যম শাখার পরিচালক কমান্ডার খন্দকার আল মঈন। তিনি জানিয়েছেন, তাদের মধ্যে ১২ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। বাকিদেরও গ্রেপ্তারে চেষ্টা চালাচ্ছে র‍্যাব।

আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর এ সংস্থাটি আরও জানিয়েছে, র‍্যাবের অব্যাহত অভিযানে এখন পর্যন্ত নতুন জঙ্গি সংগঠনের ৫৯ জন জঙ্গি ও তাদের প্রশিক্ষণের সহায়তার অভিযোগে পার্বত্য চট্টগ্রামে বিচ্ছিন্নতাবাদী পাহাড়ি সংগঠন কুকি-চিন ন্যাশনাল ফ্রন্টের (কেএনএফ) ১৭ সদস্যকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। এছাড়া জঙ্গি সংগঠনের দুইজনকে ডির‍্যাডিকালাইজড করে তাদের পরিবারের কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে।

এদিকে সম্প্রতি গ্রেপ্তার জঙ্গিদের কাছ থেকে সংগঠনের বর্তমান আমির আনিছুর রহমান ওরফে মাহমুদ এবং দাওয়াতী শাখার প্রধান আব্দুল্লাহ মাইমুনের সদস্য ও অর্থ সংগ্রহবিষয়ক উগ্রবাদী বক্তব্য সম্বলিত ভিডিও কন্টেন্ট উদ্ধারের তথ্য জানিয়েছে এলিট ফোর্সটি।

র‍্যাব পরিচালক কমান্ডার খন্দকার আল মঈন জানান, সর্বশেষ গত ২৮ ফেব্রুয়ারি পাহাড়ে প্রশিক্ষনরত আরও চারজনকে গ্রেপ্তার করেছে র‍্যাব। তাদের মধ্যে গ্রেপ্তার আল আমিন ওরফে মিলদুকের কাছ থেকে নতুন এই ভিডিও উদ্ধার করা হয়।

গত বৃহস্পতিবার রাজধানীর কারওয়ানবাজার র‍্যাব মিডিয়া সেন্টারে এক সংবাদ সম্মেলনে খন্দকার আল মঈন আরো জানান- ২৩ জানুয়ারি গ্রেপ্তার নতুন জঙ্গি সংগঠনটির সামরিক শাখার প্রধান মাসুকুর রহমান ওরফে রনবীরের কাছ থেকে একটি ভিডিও উদ্ধার করা হয়। ওই ভিডিওতে মোট ২৯ জন জঙ্গিকে শনাক্ত করা হয়। ২৮ ফেব্রুয়ারি উদ্ধার হওয়া ৭ মিনিট দৈর্ঘ্যরে নতুন ভিডিওতে আরও ২৩ জন জঙ্গিকে শনাক্ত করা হয়। এই ২৩ জনের মধ্যে ১৯ জন জঙ্গি আগের ভিডিওতেও ছিলেন, আর চারজন নতুন জঙ্গির উপস্থিতি পাওয়া গেছে।

নতুন চারজন হলেন- শেখ আহমেদ মামুন ওরফে রমেশ, শামিম মিয়া ওরফে বাকলাই ওরফে রাজান, নিজাম উদ্দিন হিরন ও ডা. জহিরুল ইসলাম ওরফে আহমেদ। ভিডিওর তথ্য অনুযায়ী গত বছরের ৬ জুন ডা. জহিরুল মারা গেছেন। দুই ভিডিওতে জঙ্গিদের প্রশিক্ষণ ক্যাম্পে থাকা মোট ৩৩ জনকে শনাক্ত করা গেছে উল্লেখ করে কমান্ডার মঈন বলেন, এদের মধ্যে ১২ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। বাকিদের গ্রেপ্তারে অভিযান চলমান আছে।

নতুন পাওয়া ভিডিও প্রসঙ্গে র‍্যাব মুখপাত্র বলেন, মূলত অর্থ সংগ্রহ এবং সদস্য সংগ্রহের জন্য এই ভিডিওটি তৈরি করা হয়ে থাকতে পারে। অন্যদিকে দেশে বড় কোনো নাশকতার পর নিজেদের অস্তিত্ব দেশীয় ও আন্তর্জাতিক মহলে জানান দেয়াও এই ভিডিওর উদ্দেশ্য হতে পারে। সংগঠনটির আমির রাকিব বাবা দাওয়াতী শাখার প্রধান মাইমুনকে গ্রেপ্তার করতে পারলে ভিডিওটি সম্পর্কে বিস্তারিত জানা যাবে।

জানা গেছে, ভিডিও দুটির ব্যাকগ্রাউন্ড ভয়েস দিয়েছেন আল আমিন ওরফে বাহাই যিনি নারায়নগঞ্জ থেকে নিখোঁজ রিয়াসাত রায়হান ওরফে আবু বক্করের প্রাইভেট টিউটর। তার মাধ্যমেই আবু বক্কর ঘর ছাড়েন যান। আর ভিডিওটি এডিটিং করেছেন পাভেল নামে অপর এক জঙ্গি।

এক প্রশ্নের জবাবে র‍্যাবের এই কর্মকর্তা বলেন, প্রাথমিকভাবে জানা গেছে, গত নভেম্বর থেকে তাদের মোবাইল ফোনে ভিডিওটি ছিল। ভিডিওর কাজটি চলমান ছিল। কিন্তু এর মধ্যেই র‍্যাবের অভিযান শুরু হয়। এখন পর্যন্ত কোনো সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভিডিওগুলোর অস্তিত্ব পাওয়া যায়নি। তারা নিজেদের গ্রুপের মধ্যেই এগুলো সরবরাহ করেছে। কোনো নাশকতার পরে নিজেদের অস্তিত্ব জানান দিতে এটি ব্যবহৃত হতে পারত। যদিও এ বিষয়ে সংগঠনটির আমিরই সিদ্ধান্ত নেবেন বলে জানিয়েছে গ্রেপ্তাররা। তবে এখন নতুনদের উদ্বুদ্ধ করে সদস্য সংগ্রহ ও অর্থ সংগ্রহের জন্য ভিডিওটি ব্যবহৃত হচ্ছিল।

অপর এক প্রশ্নের জবাবে কমান্ডার খন্দকার আল মঈন বলেন, পাহাড়ি বিচ্ছিন্নতাবাদী সংগঠন কুকি চিন নিজেদের স্বার্থেই নতুন জঙ্গি সংগঠনকে আশ্রয়, রশদ, অস্ত্র ও প্রশিক্ষণ দিচ্ছে। এর বড় স্বার্থ অর্থ। এছাড়া, যে ৬০ থেকে ৭০ জনের যে টিম তাদের সঙ্গে যোগ দিয়েছে এতে তাদের শক্তিও বেড়েছে। এর বাইরে অন্য কোনো স্বার্থের বিষয় রয়েছে কি-না কুকি চিনের নেতৃত্ব পর্যায়ের কাউকে গ্রেপ্তার করতে পারলে জানা যাবে। নতুন জঙ্গি সংগঠনের প্রধান প্রসঙ্গে এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, পার্বত্য চট্টগ্রামে সংগঠনের সদস্যদের প্রশিক্ষণে প্রধান সমন্বয়কারী শামিন মাহফুজ। সংগঠনটি ২০১৭ তে কার্যক্রম শুরু করলেও ২০১৯-২০ এ নামকরণ করা হয়। প্রথমে সংগঠনের প্রধান বা আমির ছিলেন রক্সি। কিন্তু সর্বশেষ ২০২১ সালে রক্সি গ্রেপ্তারের পর ২০২২ সালে সবাই বৈঠক করে মাহমুদকে আমিরের দায়িত্ব দেয়া হয়। যখন রক্সিকে গ্রেপ্তার করা হয় তখন নতুন জঙ্গি সংগঠনের বিষয়ে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কাছে সুস্পষ্ট তথ্য ছিল না। তাকে সে সময় অন্য জঙ্গি সংগঠনের সদস্য হিসেবে গ্রেপ্তার করা হয়।

নতুন সংগঠনের নাশকতার পরিকল্পনা রয়েছে কি না- জানতে চাইলে তিনি বলেন, সর্বশেষ যে চারজনকে গ্রেপ্তার করা হয় তাদের সমতলে আত্মগোপণের নির্দেশনা ছিল। এজন্য তারা চারদিন ধরে পাহাড় থেকে হেঁটে বান্দরবান শহরে আসে। তাদের বিচ্ছিন্নভাবে চট্টগ্রামে যাওয়ার পরিকল্পনা ছিল। এখন তাদের কি শুধু আত্মগোপন নাকি অন্য কোনো নাশকতার পরিকল্পনা ছিল পরবর্তী জিজ্ঞাসাবাদে নিশ্চিত হওয়া যাবে। র‍্যাবের ভাষ্য, আটককৃতরা সহপাঠী, নিকটাত্মীয়, স্থানীয় পরিচিত ব্যক্তি বা বন্ধু-বান্ধবের মাধ্যমে উগ্রবাদে প্ররোচিত হয়ে জঙ্গি সংগঠনে যোগ দেন বলে প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে জানিয়েছেন। এরপর তারা বিভিন্ন সময়ে তথাকথিত হিজরতের উদ্দেশ্যে স্বেচ্ছায় নিখোঁজ হন। ‘হিজরতে’র প্রথমে তাদেরকে সংগঠনের বিভিন্ন পর্যায়ের সদস্যদের তত্ত্বাবধানে রেখে পটুয়াখালী ও ভোলার চর এলাকা, ঢাকা ও কুমিল্লাসহ দেশের বিভিন্ন এলাকায় শারীরিক কসরত, জঙ্গিবাদবিষয়ক বিভিন্ন প্রশিক্ষণ, তাত্ত্বিক ও মনস্তাত্ত্বিক জ্ঞান প্রদান করা হয়।

র‍্যাব জানায়, প্রাথমিক প্রশিক্ষণ শেষে তাদের সমতল থেকে পাহাড়ে সামরিক প্রশিক্ষণের জন্য পাঠানো হয় এবং শূরা সদস্য রাকিবের মাধ্যমে পার্বত্য অঞ্চলের বাকলাই পাড়া হয়ে কেটিসি পাহাড়ে প্রশিক্ষণ শিবিরে পৌঁছায়। পার্বত্য অঞ্চলে বিভিন্ন ধরনের সশস্ত্র প্রশিক্ষণ, বোমা তৈরি বিষয়ক প্রশিক্ষণ ও প্রতিকূল পরিবেশে টিকে থাকার বিভিন্ন প্রশিক্ষণ গ্রহণ করে।

আটকদের জিজ্ঞাসাবাদের বরাত দিয়ে র‍্যাব আরো জানায়, বিভিন্ন সময় কেএনএফ’র নাথান বম, বাংচুং, রামমোয়, ডিকলিয়ান, পাহল এবং কাকুলীসহ অনেকেই প্রশিক্ষণ ক্যাম্পে আসতেন। প্রশিক্ষণের জন্য অস্ত্র ও অন্যান্য রসদ তারা অর্থের বিনিময়ে কেএনএফ সদস্যদের কাছ থেকে সংগ্রহ করতেন এবং কেএনএফের সদস্যরা বিভিন্ন সময়ে জঙ্গি সংগঠনের সদস্যদের সশস্ত্র প্রশিক্ষণ দিতেন। পরবর্তীতে পার্বত্য অঞ্চলে র‍্যাবের অভিযান শুরু হলে তারা সংগঠনের আমিরের নির্দেশে কয়েকটি গ্রুপে বিভক্ত হয়ে পার্বত্য অঞ্চলে আত্মগোপন করেন। ছোট ছোট গ্রুপে সাইজামপাড়া, মুন্নুয়াম পাড়া, রোয়াংছড়ি, পাইক্ষং পাড়া, তেলাং পাড়াসহ পার্বত্য অঞ্চলে বিভিন্ন স্থানে আত্মগোপন করেন।

র‍্যাব জানায়, জঙ্গিরা চার দিন আগে সমতলে আসার উদ্দেশ্যে পাহাড়ের গহীন থেকে হেঁটে বান্দরবানের টঙ্কাবতী এলাকায় আসেন। পরে সিএনজিযোগে চট্টগ্রাম-কক্সবাজার মহাসড়কে আসার পথে পটিয়া বাইপাস এলাকা থেকে চারজনকে আটক করা হয়। এ সময় ৪-৫ জন পালিয়ে যায়।

গত ২৩ আগস্ট কুমিল্লা থেকে আট তরুণ নিখোঁজ হয়। ওই ঘটনায় পরিবারগুলো থানায় সাধারণ ডায়েরি করে। এরপর দেশব্যাপী চাঞ্চল্যের সৃষ্টি হয়। এর পরিপ্রেক্ষিতে র‍্যাব নিখোঁজদের উদ্ধারে নজরদারি বৃদ্ধি করে। নিখোঁজ তরুণদের উদ্ধার কার্যক্রম পরিচালনা করতে গিয়ে র‍্যাব জামাতুল আনসার ফিল হিন্দাল শারক্বীয়া নামে নতুন জঙ্গি সংগঠনের তথ্য পায়। এই সংগঠনের সদস্যরা পার্বত্য চট্টগ্রামের বিচ্ছিন্নতাবাদী সংগঠনের সহায়তায় সশস্ত্র প্রশিক্ষণ গ্রহণ করছে বলে জানতে পারে।

গত ২০ অক্টোবর রাঙ্গামাটির বিলাইছড়ি ও রোয়াংছড়ি থেকে নতুন এই জঙ্গি সংগঠনের সাতজন এবং পাহাড়ি বিচ্ছিন্নতাবাদী সংগঠনের তিনজনকে আটক করা হয়। তাদের কাছ থেকে পাওয়া তথ্যের ভিত্তিতে র‍্যাব বিভিন্ন সময়ে রাঙ্গামাটি ও বান্দরবানের বিভিন্ন পাহাড়ি এলাকায় অভিযান চালায়। গত ১১ জানুয়ারি বান্দরবানের থানচি ও রোয়াংছড়ি থেকে পাহাড়ে প্রশিক্ষণরত পাঁচ সদস্যকে এবং ২৩ জানুয়ারি কক্সবাজারের কুতুপালং রোহিঙ্গা ক্যাম্প-সংলগ্ন এলাকা থেকে জঙ্গি সংগঠনটির শূরা সদস্য ও সামরিক শাখার প্রধান রনবীর ও বোমা বিশেষজ্ঞ বাশারকে গ্রেপ্তার করা হয়। তাছাড়া ৭ ফেব্রুয়ারি থানচির রেমাক্রী ব্রিজ সংলগ্ন এলাকা থেকে বিপুল পরিমাণ দেশি-বিদেশি অস্ত্র, বোমা তৈরির সরঞ্জামা, গোলাবারুদ ও সাত লক্ষাধিক টাকাসহ জঙ্গি সংগঠনের ১৭ জন এবং পাহাড়ি বিচ্ছিন্নতাবাদী সংগঠনের তিনজনকে আটক করে র‍্যাব।

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত