চট্টগ্রাম বন্দরে সক্ষমতা বেড়েই চলেছে

সিসিটি পিসিটিতে ভিড়ছে বেশি ড্রাফট ও বড় দৈর্ঘ্যরে জাহাজ

প্রকাশ : ০৫ মার্চ ২০২৩, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ

  সাইফুদ্দিন তুহিন, চট্টগ্রাম

চট্টগ্রাম বন্দরের সক্ষমতা বেড়েইে চলেছে। সেই সঙ্গে বাড়ছে উৎপাদনশীলতা। কনটেইনার হ্যান্ডেলের রেকর্ড গড়ছে। ভিড়ছে ১০ মিটার ড্রাফট ও ২০০ মিটার দীর্ঘ জাহাজ। চলতি বছরেই বন্দরে বেশি ড্রাফটের (জাহাজের পানির লেভেল থেকে নিচ অংশ পর্যন্ত) জাহাজ ভেড়া শুরু হয়। চিটাগাং কনটেইনার টার্মিনাল (সিসিটি) ও নতুন পতেঙ্গা কনটেইনার টার্মিনালে (পিসিটি) ভিড়ছে বেশি ড্রাফটের জাহাজ। এতে জাহাজ থেকে পণ্য খালাসের সময় কমছে। পাশাপাশি পণ্য খালাসের পর বড় জাহাজগুলো বন্দর ত্যাগ করছে দ্রুত সময়ে। পণ্য খালাসের জন্য বহির্নোঙরে আর অপেক্ষা করতে হচ্ছে না। বর্তমান ধারা অব্যাহত থাকলে চট্টগ্রাম বন্দরের সক্ষমতা আরো কয়েকগুণ বাড়বে বলে মনে করছেন ব্যবহারকারীরা। বন্দর সংশ্লিষ্টরা জানান, এক সময় ৯ থেকে সাড়ে ৯ মিটার মিটার ড্রাফটের বেশি জাহাজ জেটিতে ভিড়তে পারতনা। ২০০ মিটার দীর্ঘ জাহাজ ভেড়ানোর ক্ষেত্রেও বাধা ছিল। বন্দরের অনুমোদিত ড্রাফটের বেশি জাহাজ ভেড়ানো হলে চ্যানেলে আটকে যাওয়ার শঙ্কা থাকে। পাশাপাশি বেশি দৈর্ঘ্যরে জাহাজ ভেড়ানো হলেও ঝুঁকি থাকে। কিন্তু বেশি ড্রাফট ও বেশি দৈর্ঘ্যরে জাহাজ সরাসরি ভেড়াতে না পারলে বহির্নোঙরে পণ্য লাইটারেজ কাজে সময় ক্ষেপন হয়। এতে আমদানিকারদের ব্যয় বাড়ে। পণ্যবাহী জাহাজ বন্দর ত্যাগ করতেও দেরি হয়ে যায়। বন্দর ব্যবহারকারীদের দীর্ঘদিনের দাবি ছিল বেশি ড্রাফট ও বেশি দৈর্ঘ্যরে জাহাজ ভেড়ানোর উদ্যোগ নেয়ার। বন্দর কর্তৃপক্ষ ব্যবহারকারীদের প্রত্যাশা পূরণে নানা পরিকল্পনা হাতে নেয়। ইতিমধ্যে বন্দর চ্যানেল বেশি ড্রাফটের জাহাজ ভেড়ানোর উপযোগী করা হয়। চলতি বছরই প্রথমবারের মতো বেশি ড্রাফট এবং বেশি দৈর্ঘ্যরে জাহাজ ভেড়ানো হয়। গেল ১৬ জানুয়ারি সকালে চট্টগ্রাম বন্দরের সিসিটির (চট্টগ্রাম কনটেইনার টার্মিনাল) ১ নম্বর জেটিতে ভিড়ানো হয় এমভি কমন এটলাস নামে একটি জাহাজ। মেঘনা গ্রুপের আমদানি করা জাহাজটি ৬০ হাজার ৫০০ মেট্রিক টন চিনিবাহী ছিল। মার্শাল আইল্যান্ডসের পতাকাবাহী জাহাজটি ১৯৯ দশমিক ৯৯ মিটার দীর্ঘ এবং প্রস্থ ৩২ দশমিক ২৬ মিটার। বন্দরে বড় জাহাজ ভেড়ানো ক্ষেত্রে সক্ষমতা বাড়াতে কর্তৃপক্ষকে সহায়তা করেছে যুক্তরাজ্য-ভিত্তিক পরামর্শদাতা এইচআর ওয়ালিংফোর্ড। ২০০ মিটার দৈর্ঘ্যরে জাহাজ ভেড়ানোর ফলে আকার ভেদে কনটেইনার জাহাজের ক্ষেত্রে এক হাজার থেকে এক হাজার একশ কনটেইনার (প্রতিটি ২০ ফুট দৈর্ঘ্যরে) বেশি পরিবহন করা যাবে। এভাবে বাল্ক কার্গো জাহাজে ১৫ থেকে ২০ হাজার মেট্রিক টন খোলা পণ্য বেশি পরিবহন করা সম্ভব হবে।

চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের সচিব মো ওমর ফারুক বলেন, বেশি ড্রাফটের বেশি দৈর্ঘ্যরে জাহাজ ভেড়াতে ব্যবহারকারীদের দীর্ঘদিনের দাবি ছিল। নানা পরিকল্পনা হাতে নেয়ার পর বন্দর কর্তৃপক্ষ ব্যবহারকারীদের সেই দাবি পূরণ করতে সক্ষম হয়েছে। বর্তমানে ২০০ মিটার দৈর্ঘ্য এবং ১০ মিটার গভীরতার জাহাজ ভেড়ানো হচ্ছে। এটা চট্টগ্রাম বন্দরের সক্ষমতা বৃদ্ধিতে একটি নতুন অধ্যায়ের সূচনা। সিসিটির পাশাপাশি এখন পতেঙ্গা কনটেইনার টার্মিনালেও বেশি ড্রাফট এবং বেশি দৈর্ঘ্যরে জাহাজ ভিড়ছে। ভবিষ্যতে আরো জেটিতে ১০ মিটার ড্রাফটের জাহাজ ভেড়ানোর পরিকল্পনা আছে।

চট্টগ্রাম চেম্ববারের সাবেক পরিচালক মাহফুজুর রহমান শাহ বলেন, চট্টগ্রাম বন্দরে বেশি ড্রাফটের জাহাজ ভেড়ানোর দাবি ছিল দীর্ঘদিনের। এখন সেই দাবি পূরণ হয়েছে। বন্দর জেটিতে বেশি ড্রাফটের জাহাজ ভেড়ানোর সুযোগ বাড়ায় বিপুল পরিমাণ কনটেইনার এবং খোলা কার্গো পরিবহন করা সম্ভব হবে। এতে পণ্য আমদানি-রপ্তানিতে ব্যয় কমবে।

গেল বছরের ডিসেম্বর পর্যন্ত চট্টগ্রাম বন্দরে সাড়ে ৯ মিটার গভীরতা এবং ১৯০ মিটার দীর্ঘ জাহাজ প্রধান জেটিতে ভেড়ানোর অনুমোদন ছিল। এসব জাহাজে ২ হাজার ৫০০ থেকে ২ হাজার ৬০০ কনটেইনার বহন করা যায়। ১০ মিটার গভীরতার জাহাজগুলোর মাধ্যমে বন্দরে ৩ হজার ৮০০ থেকে ৪ হাজার কনটেইনার বহন করা যায়।

এদিকে চট্টগ্রাম বন্দরের নতুন নির্মিত পতেঙ্গা কনটেইনার টার্মিনালে (পিসিটি) প্রথমবারের মতো ভিড়েছে ২০০ মিটার দীর্ঘ জাহাজ এম ভি মেঘনা ভিক্টোরি। ২৫ ফেব্রুয়ারি বিকেল ৩টায় চট্টগ্রাম বন্দরের বহির্নোঙ্গর থেকে পিসিটিতে নিয়ে আসা হয় জাহাজটি। এই জাহাজটিও ছিল দেশের বৃহৎ শিল্প গ্রুপ মেগনা গ্রুপের।

গ্রুপের সংশ্লিষ্টরা জানান, ১৩ দশমিক ২ মিটার ড্রাফ্ট ও ২০০ মিটার দৈর্ঘ্যরে এম ভি মেঘনা ভিক্টোরি বহির্নোঙ্গরে পণ্য খালাসের পর জাহাজটির ড্রাফট কমিয়ে এনে পিসিটিতে আনা হয়েছিল। এম ভি মেঘনা ভিক্টোরি কানাডার ভ্যাঙ্কুয়েভার বন্দর থেকে ৬২ হাজার ৫০০ মেট্রিক টন গম নিয়ে গত ১৬ ফেব্রুয়ারি চট্টগ্রাম বন্দরের বহির্নোঙ্গরে কুতুবদিয়া এলাকায় পৌঁছায়। পরে জাহাজটির গম খালাস করা হয়।

চট্টগ্রাম বন্দর কর্মকর্তারা জানান, নবনির্মিত পতেঙ্গা কনটেইনার টার্মিনালে (পিসিটি) বর্তমানে শুধু সরকার আমদানিকৃত চাল খালাস করা হচ্ছে। পতেঙ্গা কনটেইনার টার্মিনাল পরিচালনার জন্য এখনো কোনো অপারেটর নিয়োগ দেয়া হয়নি। আপাতত চট্টগ্রাম বন্দরের ব্যবস্থাপনায়ই জাহাজে পণ্য লোড-আনলোড করা হচ্ছে। চট্টগ্রাম বন্দরে গেল ১৫ জানুয়ারি বড় জাহাজ ভেড়ানোর আনুষ্ঠানিক কার্যক্রম শুরু হয়। পিসিটি নির্মাণ শেষ হয় গত বছরের ডিসেম্বরে। এই টার্মিনাল সরকার পিপিপি পদ্ধতিতে বিদেশের কোনো প্রতিষ্ঠানকে পরিচালনার দায়িত্ব দিতে পারে। তারা দায়িত্ব নেওয়ার পর আধুনিক ইকুইপমেন্ট যুক্ত করবে। এরপর পুরোদমে টার্মিনালটি অপারেট শুরু হবে।

এই জেটিতে কোনো ইকুইপমেন্ট নেই। তাই গিয়ারড জাহাজ (নিজস্ব ক্রেনযুক্ত জাহাজ) ভিড়বে পিসিটিতে। গিয়ারলেস (ক্রেনবিহীন) জাহাজ আপাতত ভিড়ছে না। জিসিবি (জেনারেল কার্গো বার্থ), সিসিটি (চিটাগাং কনটেইনার টার্মিনাল) ও এনসিটির (নিউমুরিং কনটেইনার টার্মিনাল) পর যাত্রা শুরু হয় পতেঙ্গা কনটেইনার টার্মিনালের (পিসিটি)। চট্টগ্রাম বন্দরে ১৯৭৫ সালে ১৬০ মিটার দৈর্ঘ্যরে জাহাজ ও ৭ দশমিক ৫ মিটার ড্রাফটের জাহাজ ভিড়তে পারত। পরে ১৯৮০ সালে ১৭০ মিটার দীর্ঘ ও ৮ দশমিক ৫ মিটার ড্রাফট, ১৯৯০ সালে ১৮০ মিটার দীর্ঘ ও ৮ দশমিক ৫ মিটার ড্রাফট, ১৯৯৫ সালে ১৮৬ মিটার দীর্ঘ ও ৯ দশমিক ২ মিটার ড্রাফট, ২০১৪ সালে ১৯০ মিটার দীর্ঘ ও ৯ দশমিক ৫ মিটার ড্রাফটের জাহাজ ভেড়ানোর ঘোষণা দেওয়া হয়েছিল। এবার ১০ মিটারের জাহাজ ভিড়ল বন্দরে।

বন্দরের হাইড্রোগ্রাফিক বিভাগের এক কর্মকর্তা জানান, পতেঙ্গার ড্রাইডক প্রান্ত থেকে বোট ক্লাবের আগ পর্যন্ত অংশে পতেঙ্গা কনটেইনার টার্মিনালের জেটির দৈর্ঘ্য ৪০০ মিটার। পতেঙ্গা বোট ক্লাব ও চিটাগাং ড্রাইডকের মাঝের ২৬ একর জায়গায় চারটি জেটির সমন্বয়ে গড়ে তোলা হয়েছে পিসিটি। তিনটি জেটি (প্রতিটি ২০০ মিটার দীর্ঘ) কনটেইনার হ্যান্ডলিংয়ের জন্য এবং বাকি একটি ডলফিন জেটি (২২০ মিটার দীর্ঘ)। ডিপিএম (সরাসরি সংগ্রহ পদ্ধতি) পদ্ধতিতে এই প্রকল্পের কার্যাদেশ পায় বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর ইঞ্জিনিয়ারিং কোর। বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর ইঞ্জিনিয়ারিং কোর ২০১৭ সালে এর নির্মাণকাজ শুরু করলেও ২০২২ সালের শুরুতে তা চালুর কথা ছিল। পরে ডিসেম্বরে চালুর ঘোষণা দেওয়া হয়। ২০২১ সালের ডিসেম্বরেও তা সচল করতে না পারায় ২০২২ সালের জুনে চালুর ঘোষণা দেওয়া হয়। এরপর জুলাইতে পরীক্ষামূলকভাবে চালুর জন্য প্রস্তুত হয়েছিল। এর ধারাবাহিকতায় গত বছরের ১৫ ডিসেম্বরে পরীক্ষামূলকভাবে জাহাজ ভেড়ানো হয় পিসিটিতে। এখন পুরোদমে বড় দৈর্ঘ্যরে জাহাজ ভিড়ছে পিসিটিতে।