বিদ্যুৎ খাতে চীনের দাপট

প্রকাশ : ০৭ মার্চ ২০২৩, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ

  ফারুক আলম

দেশের বিদ্যুৎ খাতে দাপট দেখাচ্ছে চীন। বর্তমানে কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণে চীনা কোম্পানিগুলো বিনিয়োগ করায় বড়সড় পরিবর্তন ঘটতে চলছে। বাংলাদেশের বিদ্যুৎ খাতে চীনা কোম্পানিগুলো বিনিয়োগ বাড়াতে চাইলে সহজেই চীনা ব্যাংকগুলো ঋণ দিচ্ছে। এরইমধ্যে পায়রা, বাঁশখালী ও বরিশালসহ বেশ কয়েকটি বড় বড় কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণে চীনা কোম্পানিগুলো বিনিয়োগ করেছে। চীনের আরো বেশকিছু প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশে বিদ্যুৎ খাতে বিনিয়োগে আগ্রহী।

পাওয়ার সেলের তথ্য অনুযায়ী, দেশে এই মুহূর্তে বিদ্যুৎ উৎপাদনে সক্ষমতা রয়েছে ২৬ হাজার ৭০০ মেগাওয়াট। আর ২০৩০ সাল নাগাদ বিদ্যুৎ উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ৪০ হাজার মেগাওয়াট। তবে বিশ্ববাজারে জ্বালানির দাম বাড়ায় বিদ্যুৎ উৎপাদনের টার্গেটে কিছুটা ব্যাঘাত ঘটতে পারে বলে মনে করছেন বিদ্যুৎ খাতের পর্যবেক্ষকরা। তারা বলছেন, চীনা উদ্যোগে নির্মিত সব বিদ্যুৎকেন্দ্র উৎপাদনে এলে মোট বিদ্যুৎ উৎপাদন সক্ষমতায় চীনের অংশ বেড়ে দাঁড়াবে ১৮ শতাংশের কাছাকাছি।

পায়রা কয়লাবিদ্যুৎ কেন্দ্র চায়না ন্যাশনাল মেশিনারি ইমপোর্ট অ্যান্ড এক্সপোর্ট করপোরেশন (সিএমসি) ও বাংলাদেশের রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন নর্থ ওয়েস্ট পাওয়ার জেনারেশন কোম্পানি লিমিটেডের (এনডব্লিউপিজিসিএল) যৌথ উদ্যোগে নির্মিত হচ্ছে। বিদ্যুৎকেন্দ্রটি পরিচালনা করছে বাংলাদেশ-চায়না পাওয়ার কোম্পানি লিমিটেড (বিসিপিসিএল)। এটি নির্মাণে ব্যয় হয়েছে প্রায় ২০ হাজার কোটি টাকা। নির্মাণ ব্যয়ের প্রায় ৮০ শতাংশ ঋণ হিসেবে দিয়েছে চীনের এক্সিম ব্যাংক ও চায়না ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক। চট্টগ্রামের বাঁশখালীতে ১ হাজার ৩২০ মেগাওয়াট কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণে ব্যয় হচ্ছে প্রায় ২৪৯ কোটি ডলার। এর মধ্যে প্রায় ১৭৬ কোটি ডলারের ঋণ অর্থায়ন হয়েছে চীনা উৎস থেকে। অর্থায়ন করছে চায়না ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক, ব্যাংক অব চায়না ও চায়না কনস্ট্রাকশন ব্যাংক।

বরিশাল ৩০৭ মেগাওয়াট কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ করা হয়েছে। এই কেন্দ্রটি নির্মাণে বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের (পিডিবি) সঙ্গে চুক্তি হয়। প্রকল্পটি যৌথভাবে বাস্তবায়ন করেছে চীনের ‘পাওয়ার চায়না রিসোর্স লিমিটেড’ ও বাংলাদেশের আইসোটেক গ্রুপ। প্রকল্পে মোট ব্যয় ধরা হয়ছিল প্রায় সাড়ে চার হাজার কোটি টাকা (৫৪০ মিলিয়ন মার্কিন ডলার)। এই প্রকল্পের অধিকাংশ বিনিয়োগ চীনা কোম্পানির। এরইমধ্যে বিদ্যুৎকেন্দ্রটি জাতীয় গ্রিডে যোগ হয়েছে। চুক্তি অনুযায়ী, সরকারকে ২৫ বছর বিদ্যুৎ সরবরাহ করবে।

বাংলাদেশে নিযুক্ত চীনের রাষ্ট্রদূত ইয়াও ওয়েন চলতি বছরের ২৩ জানুয়ারি পররাষ্ট্রমন্ত্রী একে আব্দুল মোমেনের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। সাক্ষাৎ শেষে পরাষ্ট্রমন্ত্রী সাংবাদিকদের বলেন, চীন আগামী বছরগুলোতে বাংলাদেশে আরো বিনিয়োগ করবে বলে তিনি আশা প্রকাশ করেন।

অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগের তথ্য অনুযায়ী, স্বাধীনতার পর থেকে ২০২১-২২ অর্থবছর পর্যন্ত দেশের বিভিন্ন খাতে ঋণ ও অনুদান হিসেবে মোট ১ হাজার ৭৭ কোটি ডলারেরও বেশি অর্থ বিনিয়োগের প্রতিশ্রুতি দিয়েছে চীন। এর মধ্যে প্রায় ৬৪৪ কোটি ডলার ছাড় হয়েছে। অনুদান হিসেবে এসেছে খুব সামান্য। সিংহভাগই ঋণ। এসব ঋণের সিংহভাগই এসেছে গত দুই দশকে। বাংলাদেশে কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণে চীনা কোম্পানিগুলোকে ঋণ দেয় ব্যাংক অব চায়না, এক্সপোর্ট-ইমপোর্ট ব্যাংক অব চায়না (চায়না এক্সিম ব্যাংক) ও চায়না কনস্ট্রাকশন ব্যাংক। এই তিন ব্যাংকের প্রতিটি বাংলাদেশি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানকেও ঋণ দেয়। ডলার ও জ্বালানি সংকটের বর্তমান পরিস্থিতি চলমান থাকলে ভবিষ্যতে বিদেশি ঋণ নিয়ে বিপত্তির মাত্রা বাড়তে পারে বলে আশঙ্কা করছেন দেশি-বিদেশি পর্যবেক্ষকরা। বিশেষ করে চীনা ব্যাংকগুলো থেকে গৃহীত ঋণ নিয়ে তাদের আশঙ্কা সবচেয়ে বেশি। এসব ব্যাংক ঋণের ওপর সুদহার ধার্য করে অন্যান্য উৎসের চেয়ে অনেক বেশি। ঋণের বোঝা বাড়ানোর পাশাপাশি তা দেশের বৈদেশিক রিজার্ভেও বড় চাপের কারণ হয়ে উঠতে পারে। বাংলাদেশ নর্থ-ওয়েস্ট পাওয়ার জেনারেশন কোম্পানি লিমিটেড ও চায়না মেশিনারিজ কোম্পানির (সিএমসি) জয়েন্ট ভেঞ্চারে পটুয়াখালীতে দুই ধাপে ২ হাজার ৫৬৪ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন হবে। একইসঙ্গে বাংলাদেশ রুরাল পাওয়ার কোম্পানি লিমিটেড ও চায়না মেশিনারিজ কোম্পানির (সিএমসি) জয়েন্ট ভেঞ্চারে পটুয়াখালীতে আরো ১২৪৭ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ আসবে। কক্সবাজারের মহেশখালীতে ১ হাজার ৩২০ মেগাওয়াট ক্ষমতার বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণে চীনা প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে চুক্তি করে পিডিবি। মহেশখালীতেই আরো ১২০০ মেগাওয়াট চীনা উদ্যোগে নির্মিত হচ্ছে বিদ্যুৎকেন্দ্র।

সংশ্লিষ্টদের কাছ থেকে জানা গেছে, স্বাধীনতার পরবর্তীতে দেশের বিদ্যুৎ খাতে জাপান ও রাশিয়ার প্রভাব থাকলেও ধীরে ধীরে তা কমে এসেছে। সাম্প্রতিক বছরগুলোয় চীনা প্রতিষ্ঠানগুলো আধিপত্য বিস্তার করছে। কারণ চীনে প্রচুর কয়লা খনি আছে, কয়রা উত্তোলনের পর সেগুলো বিক্রির প্ল্যাটফর্ম হিসেবে বাংলাদেশকে বেছে নিয়েছে। সেজন্য চীনা কোম্পানিগুলো বাংলাদেশের বিদ্যুৎ খাতে বিনিয়োগ প্রতিযোগিতায় নেমেছে। বিদ্যুৎ খাতে বিনিয়োগ করলে কোনো কোম্পানিগুলোর কোনো লোকসান নেই। বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের সঙ্গে চুক্তি অনুযায়ী বিদ্যুৎ উৎপাদন করলেই টাকা, আবার এসব কেন্দ্র বসে থাকলেও ক্যাপাসিটি চার্জের নামে তাদের টাকা দিতে হচ্ছে। বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ থেকে শুরু করে প্রকৌশলী পর্যায়ে সব ধরনের পদে চীনা লোকজন কাজ করছে।

বিদ্যুৎ বিভাগের বিভিন্ন সূত্র থেকে জানা গেছে, পটুয়াখালীর পায়রায় ১ হাজার ৩২০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ প্রকল্পে বিনিয়োগ করছে চীন। রুরাল পাওয়ার কোম্পানি লিমিটেডের (আরপিসিএল) ও চীনা কোম্পানি নরিনকো যৌথ বিনিয়োগ করেছে। বাংলাদেশ নর্থ-ওয়েস্ট পাওয়ার জেনারেশন কোম্পানি লিমিটেড ও চায়না মেশিনারিজ কোম্পানি (সিএমসি) একই সক্ষমতার আরো একটি বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ করছে। এছাড়া বিপিডিবির সঙ্গে যৌথভাবে বিদ্যুৎ উৎপাদনে আরো দুটি বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ চুক্তি হয়েছে। চায়নিজ কোম্পানি হুদিয়াং কোম্পানির সঙ্গে ২০১৭ সালে সমঝোতা চুক্তি স্বাক্ষর করে। চীনের হাংঝুভিত্তিক আরেকটি কোম্পানি চট্টগ্রামের মিরসরাইয়ে ১ হাজার ৩২০ মেগাওয়াট সক্ষমতার আরো একটি বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ করছে।

বিশ্লেষকরা বলছেন, দেশের বিদ্যুৎ প্রকল্পগুলোর ৬০ শতাংশ অর্থায়নই করে বাংলাদেশ সরকার। যদিও এই অর্থের বড় অংশই সরকার বিশ্ব ব্যাংক, এশিয়ান ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক, জাইকা এবং ইউএসএইড থেকে পেয়েছে। বাকি ৪০ শতাংশ এসেছে বেসরকারি বিনিয়োগ থেকে। এরমধ্যে আছে ভারতের আদানি গ্রুপও। জ্বালানি বিশেষজ্ঞ এবং বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) অধ্যাপক ড. ম তামিম আলোকিত বাংলাদেশকে বলেন, বিদ্যুৎ খাতে বিদেশি বিনিয়োগ লাগবে। এই খাতে বিনিয়োগ করলে কোনো ঝুঁকি নেই। এই বিনিয়োগ ঋণের মতো, তবে এই বিনিয়োগ থেকে সরকারকে রাজস্ব বা ডলার উপার্জন করতে হবে। বিদেশি বিনিয়োগ থেকে ডলার উপার্জনে ব্যর্থ হলে ঋণ শোধ করা যাবে না। এটি চীনের সঙ্গে কোনো সম্পর্ক নেই। যে কোনো দেশ বিদ্যুৎ খাতে বিনিয়োগ করতে পারে। তিনি আরো বলেন, সারা দেশে বিদ্যুৎ বিভাগ স্থানীয় পর্যায়ে রাজস্ব আয় করছে। তবে সেই রাজস্ব যথাযথভাবে কাজে লাগাতে হবে। বিদেশি বিনিয়োগকারীদের লাভ্যাংশ দিতে হবে। তবে বিদেশি বিনিয়োগের একটা সুবিধা হচ্ছে, আস্তে আস্তে ঋণ পরিশোধ করতে হচ্ছে। জ্বালানি বিশেষজ্ঞ বুয়েটের কেমিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের অধ্যাপক এজাজ হোসেন বলেন, বিদেশিরা যে খাতে বিনিয়োগ করবেন, সেই খাত সম্পর্কে বহুদিন বিশ্লেষণ করেন। কারণ বিদেশে অর্থ বিনিয়োগ করে ঝুঁকিতে থাকতে চায় না কোম্পানিগুলো। সেখানে বাংলাদেশে বিনিয়োগের ক্ষেত্রে সবচেয়ে নিরাপদ ও সুরক্ষিত বিদ্যুৎ খাত। এখানেই বিদেশি কোম্পানিগুলোর আগ্রহের বড় জায়গা। একটি নির্দিষ্ট সময়ের জন্য বিনিয়োগ করে তারা সেই অর্থের চেয়ে কয়েক গুণ অর্থ দেশ থেকে নিয়ে যাচ্ছে। যেটা অন্য কোনো সেক্টরে বিনিয়োগ করে তুলে নিয়ে আসা চ্যালেঞ্জ। এডিবির বিশেষজ্ঞ সিদ্দিক জোবায়ের বলেন, বর্তমানে চীন বাংলাদেশের সব থেকে বড় বাণিজ্য অংশীদার। অদূর ভবিষ্যতে বাংলাদেশ যেসব বিদ্যুৎ প্রকল্প হাতে নিতে যাচ্ছে তার ৯০ শতাংশতেই অর্থায়ন করবে চীন। তারা যদি তাদের কয়লা প্রকল্পগুলোকে নবায়নযোগ্য খাতে পরিবর্তন করতে পারে তাহলে ২০৪১ সালের মধ্যে নবায়নযোগ্য উৎস থেকে ৪০ শতাংশ বিদ্যুৎ উৎপাদন করার টার্গেট বাস্তবায়ন হবে বাংলাদেশের। চীনের বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভের (রোড বিআরআই) আওতায় বিশ্বের বিভিন্ন দেশে বিদ্যুৎ, রেল, সড়ক, সেতু, বন্দরসহ নানা ধরনের উন্নয়ন প্রকল্পে মোটা অঙ্কের অর্থায়ন করেছে চীন। বিআরআই প্রকল্পের অধীনে চীন কোম্পানিগুলো বাংলাদেশে বিনিয়োগ বাড়িয়েছে।

বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের পরিচালক (জনসংযোগ) মো. শামীম হাসান আলোকিত বাংলাদেশকে বলেন, ‘চীনের নিজস্ব কয়লা খনি আছে, কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ উৎপাদনে তাদের বিশাল অভিজ্ঞতা। সেক্ষেত্রে কয়লাবিদ্যুতে প্রভাব বিস্তার করছে চীন। কয়লা উত্তোলনে প্রতি বছর দুর্ঘটনায় চীনে বহু মানুষ মারা যায়।’