ঢাকা ১১ নভেম্বর ২০২৪, ২৬ কার্তিক ১৪৩১ | বেটা ভার্সন

সিদ্দিক বাজারে ভবনে বিস্ফোরণ

মৃতের সংখ্যা বেড়ে ২২ মালিকসহ গ্রেপ্তার তিন

আর কোনো লাশ নেই : ফায়ার সার্ভিস
মৃতের সংখ্যা বেড়ে ২২ মালিকসহ গ্রেপ্তার তিন

রাজধানীর গুলিস্তানে সিদ্দিক বাজারে ভবনে বিস্ফোরণের ঘটনায় গতকাল বৃহস্পতিবার আরো একজনের লাশ উদ্ধার করা হয়েছে। এ নিয়ে বিস্ফোরণের ঘটনায় ২২ জনের লাশ উদ্ধারের তথ্য নিশ্চিত করেছে ফায়ার সার্ভিস। কুইন স্যানিটারি মার্কেট হিসেবে পরিচিত ওই ভবনটিতে আর কোনো লাশ নেই বলেও জানিয়েছে সংস্থাটি। গতকাল দুপুর ১২টার দিকে ভবনের বেজমেন্ট থেকে মেহেদী হাসান স্বপন নামে ওই ব্যক্তির লাশ উদ্ধারের পর এ তথ্য জানান ফায়ার সার্ভিসের সহকারী পরিচালক আক্তারুজ্জামান।

অন্যদিকে বিস্ফোরণে হতাহতের ঘটনায় তিনজনকে গ্রেপ্তার করেছে ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) গোয়েন্দা (ডিবি) বিভাগ। গ্রেপ্তাকৃতদের দুই দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেছেন আদালত। গতকাল ডিএমপির গোয়েন্দা শাখার প্রধান ডিআইজি হারুন অর রশীদ এ তথ্য নিশ্চিত করেছেন। গ্রেপ্তাররা হলেন ওয়াহিদুর রহমান, মশিউর রহমান ও আ. মোতালেব মিন্টু। ওয়াহিদুর রহমান ও মশিউর রহমান ভবনের মালিক এবং অপরজন ‘বাংলাদেশ স্যানিটারি’ নামে দোকানের মালিক।

গতকাল সকালে তৃতীয় দিনের উদ্ধার অভিযান শুরু করে ফায়ার সার্ভিস। দুপুরের আগে মরদেহ উদ্ধারের পর আক্তারুজ্জামান বলেন, উদ্ধার করা মরদেহের ওজন প্রায় ১২০ কেজি, এজন্য দুটি ব্যাগ ব্যবহার করতে হয়েছে, যা মেহেদী হাসান স্বপনের সঙ্গে মিলে যায়। দুর্ঘটনার তদন্ত কার্যক্রম সম্পর্কে তিনি বলেন, কাজ শুরু করেছে তদন্ত কমিটি। পাঁচ দিনের মধ্যে কমিটি তদন্ত রিপোর্ট দেবে।

লাশ উদ্ধারের পর তা ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে মরদেহের পরিচয় শনাক্ত করেন স্বপনের ভাই তানভীর হাসান। তানভীর হাসান বলেন, গত ৭ মার্চ ঘটনার পর থেকে আমার ভাই নিখোঁজ ছিলেন। আজ আমার ভাইকে পেলাম ঠিকই, কিন্তু মৃত অবস্থায়। আমার ভাই একটি স্যানেটারি দোকানে ম্যানেজার হিসেবে কাজ করতেন।

এদিকে বিস্ফোরণে আহতদের চিকিৎসায় মেডিকেল বোর্ড গঠন করা হয়েছে বলে জানিয়েছেন ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতালের পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মো. নাজমুল হক। তিনি বলেন, সিদ্দিক বাজারে আহতদের সব ধরনের চিকিৎসা সেবার ব্যবস্থা করেছি। আহত ব্যক্তিদের চিকিৎসায় একটি মেডিক্যাল বোর্ড গঠন করা হয়েছে। আমাদের এখানে ২০ জন ভর্তি ছিলেন। তাদের মধ্যে পাঁচজনকে ছাড়পত্র দেয়া হয়েছে। বর্তমানে আমাদের এখানে ১৫ জন চিকিৎসাধীন। এছাড়া শেখ হাসিনা বার্নে ৯ জন ভর্তি আছেন।

অন্যদিকে বিস্ফোরণে হতাহতের ঘটনায় অপমৃত্যু মামলা করেছে পুলিশ। গত মঙ্গলবার (৭ মার্চ) সাধারণ ডায়েরি নথিভুক্তির পর বুধবার (৮ মার্চ) বংশাল থানায় এ অপমৃত্যুর মামলা হয়।

তবে এ ঘটনায় ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) গোয়েন্দা (ডিবি) বিভাগ তিনজনকে গ্রেপ্তার করেছে। গতকাল ডিএমপির গোয়েন্দা শাখার প্রধান ডিআইজি হারুন অর রশীদ এ তথ্য নিশ্চিত করেছেন। ডিএমপি মিডিয়া অ্যান্ড পাবলিক রিলেশন্স বিভাগ আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে হারুন অর রশীদ বলেন, গ্রেপ্তাররা হলেন ওয়াহিদুর রহমান, মশিউর রহমান ও আ. মোতালেব মিন্টু। ওয়াহিদুর রহমান ও মশিউর রহমান ভবনের মালিক এবং অপরজন ‘বাংলাদেশ স্যানিটারি’ নামে দোকানের মালিক।

হারুন অর রশীদ বলেন, সিদ্দিকবাজারে বিস্ফোরণের ঘটনায় ২০ জনের বেশি মানুষ মারা গেছেন। আহত হয়েছেন শতাধিক। এ ঘটনায় একটি অপমৃত্যু মামলা হয়েছে। ঘটনার তদন্ত করছে ডিবি, সিটিটিসি ও র‍্যাবসহ অন্যান্য সংস্থা। ওই বিস্ফোরণের কী কারণ তা উদঘাটনে আমরা ভবনের মালিক, দোকান মালিকসহ বেশ কয়েকজনকে হেফাজতে এনে জিজ্ঞাসাবাদ করি। ঘটনাস্থল পরিদর্শন করা হয়েছে। ঘটনাটি ডিবি পুলিশ শুরু থেকে গুরুত্বের সঙ্গে তদন্ত করছে। তিনি বলেন, সিদ্দিকবাজারের যে ভবনটিতে বিস্ফোরণ ঘটে তার নাম কুইন স্যানিটারি মার্কেট। একসময় এটার নাম ছিল কুইন ক্যাফে। ১০তলা ভবনের প্ল্যান করা হলেও ১৯৯২ সাল পর্যন্ত বেজমেন্ট ও একতলা কমপ্লিট ছিল। বেজমেন্টে ছিল রান্নাঘর আর একতলায় ছিল খাবারের হোটেল। এই রান্নাঘরে কমার্শিয়াল গ্যাসের বড় লাইন ছিল, যা পরে লিখিতভাবে তিতাসের কাছে সারেন্ডার করা হয়। ২০০৪ সালে ভবনটির সাত তলা পর্যন্ত কমপ্লিট করা হয়। বর্তমানে একটি আন্ডারগ্রাউন্ড বেইসমেন্টসহ সাততলা পর্যন্ত ভবনটি কমপ্লিট আছে। ভবনটির প্রকৃত মালিক মরহুম হাজী মোহাম্মদ রেজাউর রহমান। ২০১১ সালে তার মৃত্যুতে তার তিন ছেলে, দুই মেয়ে এবং স্ত্রী বর্তমানে ভবনটির মালিক।

ভবন মালিক ও যারা ভাড়া নিয়ে সেখানে ব্যবসা ও বসবাস করে আসছিল তারা ঘটনার দায় এড়াতে পারে না দাবি করে হারুন অর রশীদ আরও বলেন, সেপটিক ট্যাংকি অপরিষ্কার রাখা, এসি মেরামত না করা, গ্যাসের লাইন বন্ধ না রাখার দায় এড়ানো যায় না। ভেন্টিলেশন ব্যবস্থা ছিল না, পার্কিং স্থানও ভাড়া দেয়া ছিল। সব মিলিয়ে বিল্ডিং কোড মানা হয়নি। এজন্য তিনজনকে গ্রেপ্তার করেছি।

তিনি বলেন, এখনো পর্যন্ত প্রাপ্ত তথ্য মতে কুউইন্স সেনেটারি মার্কেটের আন্ডারগ্রাউন্ড বিস্ফোরণের উৎস স্থল। বেইজমেন্টের এ আন্ডারে গ্রাউন্ড স্পেসটি রাজউকের বিধান অনুসারে খোলামেলা থাকলে সেখানে কোনো ত্রুটি দেখা দিলে তাৎক্ষণিকভাবে নিরসন করা যেত। বায়ু গ্যাসসহ অন্যান্য সমস্যারও সমাধান করা যেত। বাড়ির মালিকরা টাকার লোভে আন্ডারগ্রাউন্ড একসময় রান্নাঘর হিসেবে ব্যবহার করেছেন। সেই রান্নাঘরের গ্যাসের লাইন যথাযথভাবে অপসারণ না করে তার ওপরেই সম্পূর্ণ এয়ার টাইট এসি করা নির্মাণ সামগ্রীর মার্কেট বানিয়ে দিয়েছেন।

গোয়েন্দা প্রধান বলেন, দোকানের মালিক বিল্ডিং কোড না মেনে ভাড়া নিয়ে বেইজম্যান্টের ১ ইঞ্চি জায়গাকেও ফাঁকা না রেখে ডেকোরেশন করে দোকান বানিয়ে সেখানেই তার কর্মচারী ও ক্রেতা সাধারণের জীবন ঝুঁকির মধ্যে ফেলেছেন। এতগুলো প্রাণহানি ও সম্পদের ক্ষয়ক্ষতি তাই ভবনের মালিক এবং দোকানদারের স্বেচ্ছাচারিতা, লোভ এবং অবহেলারই ফল।

তবে রাজউকের উচিত ছিল ভবন নির্মাণে অনুমতি নেয়ার পর বিল্ডিং কোড মেনে ভবনটি নির্মাণ করা হয়েছিল কি না। যারা ভবনটি থেকে ট্যাক্স আদায় করেন তাদের উচিত ছিল, যাদের ট্রেড লাইসেন্স দিচ্ছেন, ট্যাক্স নিচ্ছেন, তারা বিল্ডিং কোড অনুস্মরণ করছে কি না! ডিবি পুলিশ ছাড়া অন্যান্য সংস্থা ঘটনার তদন্ত করছে।

এক প্রশ্নের জবাবে হারুন বলেন, ভবন মালিক, দোকান মালিক, বাসিন্দাদের তো দায় ছিলই, রাজউক ও সিটি করপোরেশনেরও উচিত, কার কী দায়, ছিল তা তদন্ত করা।

হারুন অর রশীদ আরও বলেন, ভবনটি নির্মাণে বিল্ডিং কোড মানা হয়নি। এটা রাজউকের দেখা উচিত ছিল। অনুমতি নিয়ে বিল্ডিং কোড মেনে ভবনটি নির্মাণ করা হয়েছিল কি না, তা তদন্ত করা হবে। তিনি বলেন, রাজউক, সিটি করপোরেশনসহ তিতাসের যেসব ব্যক্তির দেখার কথা ছিল তারা এগুলো দেখেছেন কি না সেটিও তদন্ত চলবে। এ সময় হারুন অর রশীদ পর্যবেক্ষণ সম্পর্কে বলেন, ১. বেইজমেন্টে কার পার্কিং থাকলে বাতাসের ভেন্টিলেশন থাকত। কোনো গ্যাস জমা হতো না। বিস্ফোরণও হয়তো হতো না। ২. সাত তলা ভবনের বেইজমেন্টসহ তিনটি ফ্লোরের কমার্শিয়াল লোকজন, বাসাবাড়ির লোকজনের পয়োবর্জ্য যেখানে জমা হয় দীর্ঘ সময় সেই জায়গা পরিষ্কার না করায় সেখানেও বায়োগ্যাসের জন্ম হতে পারে, যা বিভিন্ন কারণে বিস্ফোরিত হয়ে ব্যাপক ক্ষতির সৃষ্টি করে। ৩. একসময় এ বেইজমেন্টের রান্নাঘরে কমার্শিয়াল বড় লাইনে গ্যাস সরবরাহ করা হতো যা পরবর্তীতে বন্ধ করে দেয়া হয়। কিন্তু বাড়ির অন্যান্য ফ্লোরের ডোমেস্টিক লাইন এখনো চলমান। ফলে এ লাইন সম্পূর্ণ বন্ধ না হয়ে সেখান দিয়েও তিতাস গ্যাস লিক হতে পারে। কোনোভাবে জমা গ্যাসে স্পার্কের মাধ্যমে বিস্ফোরণের হতে পারে। ৪. ভবন মালিকদের তথ্য মতে, মূল ক্ষতিগ্রস্ত ভবন এবং তার উত্তর পাশে ব্র্যাক ব্যাংকের ভবনের মধ্যখানে সরু একটি গলি আছে। এ গলিতে পয়োবর্জ্য পদার্থের সেপটিক ট্যাংকি, এসির আউটার ইত্যাদি অবস্থিত। বিস্ফোরণে সেপটিক ট্যাংকের পাশের দেয়ালগুলো সম্পূর্ণ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। পয়োবর্জ্য পদার্থের বায়ো গ্যাসের বিস্ফোরণে এমনটি হতে পারে। ৫. ভবনটির আন্ডারগ্রাউন্ড বা বেইজম্যান্টে বড় একটি সেনেটারি দোকান, নিচতলায় পাঁচটি দোকান, দোতলাতে কাপড়ের দুটি দোকান ছিল, যেগুলোর জন্য অনেক কাঁচ এবং ইন্টেরিয়রের কাজ করা হয় এবং পাওয়ারফুল এসি ব্যবহার করা হয়। এসিগুলো সময়ে সময়ে সার্ভিসিং না করালে বা ত্রুটিপূর্ণ থাকলে তা থেকেও বিস্ফোরণের কারণ হতে পারে যেটা ২ থেকে ৩ বছর আগে গুলশানে আরব আমিরাতের ভিসা সেন্টারে ঘটেছিল। ৬. ভবনটি কোনো পরিত্যক্ত পাবলিক স্পেস/ভবন নয়। ব্যক্তি মালিকানাধীন। বিভিন্ন ব্যবসায়ীর সার্বক্ষণিক নজরদারি ও সিসি ক্যামেরার সার্ভিলেন্সে ছিল এটি। ফলে বিপুল ক্ষয়ক্ষতির জন্য যে পরিমাণ বিস্ফোরক প্রয়োজন তা এখানে সবার অজান্তে জমা রাখা প্রায় অসম্ভব। ৭. বিস্ফোরণের প্রকৃত কারণ সম্পর্কে ফায়ার সার্ভিস, বাংলাদেশ সেনাবাহিনী, ঢাকা মহানগরীর সিটিটিসির বোম্ব ডিসপোজাল টিম আলাদা আলাদা ভাবে তদন্ত করছে। বিভিন্ন দিক পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে তারা একটা যৌক্তিক সিদ্ধান্তে উপনীত হয়ে রিপোর্ট দেবেন তাতেই প্রকৃত কারণ জানা যাবে। তবে এখনো পর্যন্ত বিস্ফোরক বা সাবোটাজের কোনো আলামত সেখানে পাওয়া যায়নি। ৮. ভবনটির বিভিন্ন ফ্লোরের বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানে সিসি ক্যামেরা ছিল। সিসি ক্যামেরার ডিভিআর থেকে ফুটেজ সংগ্রহ করার চেষ্টা চলছে। ভবনের মালিক, দোকানের মালিকদের জিজ্ঞাসাবাদ করে বিস্ফোরণের কারণ জানা চেষ্টা অব্যাহত আছে।

এদিকে ক্ষতিগ্রস্ত ভবনটি ভেঙে ফেলা হবে নাকি সংস্কার করা হবে তা দ্রুত সময়েই জানানো হবে বলেছেন রাজউকের তদন্ত কমিটি সদস্য মেজর শামসুদ্দিন আহমেদ চৌধুরী। গতকাল দুপুরে সাংবাদিকদের তিনি এ কথা জানান। তিনি বলেন, বেজমেন্টসহ নিচতলার কলাম ও পিলার যেভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে দ্রুত সময়ের মধ্যেই জানানো হবে কী করা হবে। তবে ভবনটি এখন ঝুঁকিপূর্ণ। তাই প্রথমে এটাকে স্ট্যাবল (স্থিতিশীল) করতে হবে। এরপর সংস্কার করলে ভবনটি নিরাপদ হবে নাকি ঝুঁকি থাকবে তা জানানো হবে।

তিনি বলেন, ভবনের ২৪ কলামের মধ্যে ৯টি কলাম বেশ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। আমাদের তদন্ত কাজ এরই মধ্যে শুরু হয়েছে। তদন্ত করে দ্রুততম সময়ের মধ্যেই জানাতে পারব।

অন্যদিকে বিস্ফোরণে দগ্ধদের মধ্যে সর্বশেষ ১০ জন শেখ হাসিনা জাতীয় বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটে চিকিৎসাধীন ছিলেন। তার মধ্যে বুধবার দিরাগত রাতে চিকিৎসাধীন অবস্থায় একজনের মৃত্যু হয়। বাকি ৯ জন চিকিৎসাধীন। তাদের মধ্যে চারজনের অবস্থা আশঙ্কাজনক। বাকিরাও শঙ্কামুক্ত নন বলে জানিয়েছেন চিকিৎসকরা।

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত