আতঙ্ক নিয়ে ও পরিবারের লোকজনকে আতংকে রেখে কর্মজীবী মানুষকে প্রতিদিনের পথচলা শুরু করতে হয়। বিশেষ করে রাজধানীতে কখন কার জন্য ‘মরণযাত্রা’ অপেক্ষা করছে তা অনুধাবন করার মতো পরিস্থিতি এখন কেন যেন আর নেই। কোনো প্রকার পূর্ব সতর্কতা ছাড়াই মানুষকে ‘বিস্ফোরণ’ নামক দানবের মুখোমুখি হতে হচ্ছে। কোথায় কখন কোন স্থাপনায় বিস্ফোরণ ঘটবে আর কাকে প্রাণ দিতে হবে সেই ভাবনা নিয়ে মানুষ কাজে বের হচ্ছে। ঘর থেকে বের হয়ে সুস্থ ও স্বাভাবিক জীবন নিয়ে ঘরে ফেরা সম্ভব হবে কি না সেটা নিয়ে উদ্বেগ-উৎকণ্ঠায় আচ্ছন্ন মানুষ। চলতি মাসে পর পর কয়েকটি বিস্ফোরণের ঘটনা এবং এর আগেও বিস্ফোরণের মুখোমুখি হয়ে অনেকেরই প্রাণ গেছে। ঘরে-বাইরে কোনো স্থানেই মানুষ নিরাপদ অনুভব করছে না। এক অজানা আতঙ্ক মানুষকে তাড়া করে ফিরছে। বিএনপি-জামায়াত জোটের হরতাল, অবরোধ, পেট্রোল বোমা হামলা এবং যানবাহনে আগুন দেয়ার ঘটনার আতঙ্ক কাটতে না কাটতে নতুন উৎকণ্ঠা হচ্ছে বিস্ফোরণ। কোনো একটি ভবনে বিস্ফোরণ ঘটলে সেই ভবন ছাড়াও আশপাশের ভবন ও পাশের রাস্তায় পরিবহনের যাত্রী ও পথচারীর প্রাণহানির ঘটনায় মানুষ স্বাভাবিক কারণে আতঙ্কিত হচ্ছে। কে কোথায় কোন অবস্থায় এ ধরনের কঠিন পরিস্থিতির মুখোমুখি হবে তা কেউ বলতে পারছে না। কেন মানুষ ‘মরণ যন্ত্রণার’ আশঙ্কা নিয়ে জীবন-জীবিকা নির্বাহ করবে সেই প্রশ্নই আজ সামনে এসেছে। সড়ক ও নৌ এমনকি আকাশ পথে কখন কোন অবস্থায় কোন দুর্ঘটনা ঘটতে পারে সে ব্যাপারে মানুষের মধ্যে কম-বেশি একটা ধারণা থাকলেও ‘বিস্ফোরণ’ নামক নতুন আতঙ্ক এখন মানুষকে মৃত্যুর মুখে ঠেলে দিচ্ছে। বাসভবন, কারখানা কিংবা ব্যবসা-প্রতিষ্ঠানে হঠাৎ করে বিস্ফোরণ ঘটলে মুহূর্তের মধ্যে প্রচণ্ড বেগে ছুটে আসা লোহা কিংবা ইট-পাথরের আঘাতে হতাহত হওয়ার ঘটনা ঘটছে। হঠাৎ করে এমন ভয়াবহ বিস্ফোরণের প্রকৃত কারণ উৎঘাটিত হচ্ছে না। ফলে এর কোনো সমাধানও খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। এ বছরের শেষের দিকে জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। সে কারণে আওয়ামী লীগের শীর্ষ স্থানীয় নেতারা বিস্ফোরণের ঘটনার সঙ্গে বিরোধী রাজনৈতিক দলের সংশ্লিষ্টতার ‘গন্ধ’ পাচ্ছেন।
তাদের মতে বিরোধীদল রাজনীতির মাঠে আওয়ামী লীগের সঙ্গে পেরে উঠতে না পেরে ‘আত্মঘাতি’ পন্থা অবলম্বন করছে। আওয়ামী বিরোধীরা এমন নাশকতামূলক কর্মকাণ্ড ঘটাতে পারে বলে যদি আশঙ্কা থাকে, তাহলে প্রতিরোধের উপায় কি?। একটা রাষ্ট্রের চেয়ে কোনো দল বা সংগঠন বড় নয়। ব্যাপক গোয়েন্দা তৎপরতা চালিয়ে এবং নজরদারি বৃদ্ধি করে এসব নাশকতামূলক কর্মকাণ্ড প্রতিরোধ করা যায় কি না সেটা গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনায় নিতে হবে। তা না হলে নিরীহ মানুষের প্রাণহানি রোধ করা যাবে না। কোনো একটা ভবন কিংবা কারখানায় বিস্ফোরণ কি কি কারণে ঘটতে পারে সেই কারণগুলো চিহ্নিত করে ঝুঁকির্পূ ভবন ঝুঁকিমুক্ত করার কি কোনো উপায় নেই? আর কোনো একটা ভবন ঝুঁকিপূর্ণ তো আর রাতারাতি হয়নি। দীর্ঘদিন পর ভবনগুলো ব্যবহার হতে হতে এক সময় হয়তো ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে ‘বিস্ফোরণ’ বোমায় পরিণত হয়। আর তখনই ঘটে দুর্ঘটনা। ভবন নির্মাণের আগে সেটি আগুন, ভূমিকম্প কিংবা বিস্ফোরণের প্রতিরোধী কি না সেটি নিশ্চিত করার জন্য সরকারের কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠান রয়েছে। এসব প্রতিষ্ঠানের নজর এড়িয়ে এভাবে ভবনগুলো ঝুঁকিপূর্ণ হওয়ায় ঘটতে পারে আরো প্রাণঘাতি দুর্ঘটনা। ‘একটি দুর্ঘটনা, সারা জীবনের কান্না’ এই প্রতিপাদ্যকে গুরুত্ব দিয়ে অগ্রসর না হলে প্রাণহানি ও সম্পদের বিশাল ক্ষয়ক্ষতি থেকে রক্ষা পাওয়া বেশ কঠিন হবে।
চট্টগ্রামে সীমা অক্সিজেন প্ল্যান্ট, রাজধানীর বনানী, সায়েন্সল্যাব এলাকা ও সবশেষে সিদ্দিকবাজারে বিস্ফোরণের ঘটনা খুবই কাছাকাছি সময়ে ঘটেছে। এর আগে রাজধানীর মগবাজারে ভবনে বিস্ফোরণের ঘটনায়ও বাসের যাত্রীরাও হতাহত হয়েছে। এ কারণে এসব ঘটনার পেছনে সন্দেহ ও সংশয় দেখা দিচ্ছে। এসব ঘটনা কাকতালীয় হবে এমনটাও তো মনে করার বিষয় নয়।
চলতি মাসে রাজধানীসহ বন্দরনগরী চট্টগ্রাম ও পর্যটননগরী কক্সবাজারে সংঘটিত বিভিন্ন দুর্ঘটনা স্বাভাবিক নয় বলে সরকারের শীর্ষমহল এবং দেশের আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কাছে প্রতীয়মান হচ্ছে। তবে তাৎক্ষণিকভাবে এসব ঘটনাকে কেউ এখন পর্যন্ত নাশকতা হিসেবে দেখছেন না। তাহলে এসব ঘটনার পেছনে কোনো অপশক্তির সংশ্লিষ্টতা রয়েছে কি না বা কী কারণে এসব ঘটনা ঘটছে সেগুলো খতিয়ে দেখার সময় এসেছে। রাষ্ট্রীয় পর্যায় থেকে এ ব্যাপারে নির্দেশনা আসা এখন সময়ের দাবি। সরকার কিংবা ক্ষমতাসীন দলের শীর্ষ নেতারা যদি বিরোধীদের দিকে সন্দেহের তীর ছুড়ে কিংবা বিরোধীদলগুলো যদি কেবল সরকারকে দোষারোপ করে তাহলে আসল রহস্য কখনোই উদ্ঘাটিত হবে না।
গত ৪ মার্চ বিকাল সাড়ে ৪টার দিকে চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ড উপজেলার কদম রসুল এলাকায় ‘সীমা অক্সিজেন’ নামে একটি অক্সিজেন প্ল্যান্টে বিস্ফোরণ-অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় অন্তত ছয়জন নিহত এবং অপর ৩০ জন আহত হয়। প্ল্যান্টটিতে সিলিন্ডারে অক্সিজেন রিফিল করার সময় বিস্ফোরণের ফলে আশপাশের দুই কিলোমিটার এলাকার ঘরবাড়ি, দোকানপাট, কারখানাসহ বিভিন্ন স্থাপনা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। ভবনের কাঁচের জানালা, দরজা, টিনের ছাদ ও ঘর ভেঙে গেছে।
পরের দিন সকালে রাজধানীর সায়েন্স ল্যাবরেটরি ও নিউমার্কেট সংলগ্ন এলাকায় একটি বাণিজ্যিক ভবনে বিস্ফোরণের ঘটনায় তিনজন নিহত এবং আহত গয় আরো ১৪ জন। ফায়ার সার্ভিস কর্তৃপক্ষ, ঠিক কী কারণে ভবনে বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটেছে তা আনুষ্ঠানিকভাবে জানতে পারেনি। তবে কারো কারো মতে আশঙ্কা গ্যাসের সিলিন্ডার বা এসি বিস্ফোরণে এ ঘটনা ঘটতে পারে।
একইদিন দুপুরের পরে পর্যটননগরী কক্সবাজারের উখিয়া উপজেলার বালুখালী ১১ নম্বর রোহিঙ্গা ক্যাম্পে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় দুই হাজারের বেশি ঘরবাড়ি পুড়ে গেছে। এ ঘটনার একদিন পরে ৭ মার্চ রাজধানীর গুলিস্তানের সিদ্দিকবাজারে ক্যাফে কুইন ভবনে ভয়াবহ বিস্ফোরণে এ পর্যন্ত ২৩ জন মারা গেছেন। আহত হয়েছে দেড় শতাধিক। অনেকে চিকিৎসাধীন রয়েছে। নিহতের সংখ্যা আরো বাড়তে পারে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। বিস্ফোরণে পাশাপাশি দুটি বহুতল ভবনও ক্ষতিগ্রস্ত হয়। বিকট শব্দে বিস্ফোরণে ভবনের ইট-পলেস্তরা, কাঠের টুকরো বহু দূর পর্যন্ত ছিটকে পড়ে। এতে অনেকে আহত হয়েছেন।
গত কয়েকদিনে ধারাবাহিকভাবে সংঘটিত এসব দুর্ঘটনায় অনেকে বিস্ময় প্রকাশ করে বলেছেন, এসব ঘটনার কোনোটাই স্বাভাবিক কোনো ঘটনা নয়। তারা এসব অগ্নিকাণ্ড ও বিস্ফোরণের ঘটনাগুলোর কোনো কারণ বলতে না পারলেও এসব ঘটনার সুষ্ঠু তদন্তসহ বিষয়গুলো খতিয়ে দেখার কথা বলেছেন।
এটা দুর্ঘটনা কিংবা নাশকতা কি না, সেটা সরকারের পক্ষ থেকে প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশে গভীরভাবে খতিয়ে দেখা হচ্ছে। বিস্ফোরণের কারণ জানতে পরীক্ষা-নিরীক্ষা চলছে এবং সিদ্ধান্ত যত তাড়াতাড়ি আসবে ততই মঙ্গল।
ফায়ার সার্ভিস এবং বোমা নিস্ক্রিয়করণ ইউনিটসহ স্থানীয় কর্তৃপক্ষ ভয়াবহ এসব ঘটনার বিষয়ে বিশেষজ্ঞ মতামত তৈরি করতে পারবেন বলে আশা করা যায়। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, এসব ঘটনার যাতে কোনো পুনরাবৃত্তি না ঘটে, সে বিষয়ে সচেতন থাকতে হবে। এছাড়া এসব ঘটনা অন্তর্ঘাতমূলক কর্মকাণ্ড কি না সেটা নির্ণয় করতে অবশ্যই নিরপেক্ষ তদন্তের প্রয়োজন। বিশেষজ্ঞরাই তদন্ত করে বের করবেন আসল ঘটনা কী।
পুলিশের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, অনেক সময় মিথেন গ্যাস, এসির গ্যাস বা পয়োঃগ্যাস জমে এমন বিস্ফোরণ হতে পারে। এখন এটা নাশকতা না দুর্ঘটনা, বিশেষজ্ঞ দল তদন্ত শেষ করে জানাতে পারবেন। সরকারের মন্ত্রীরাও বলেছেন, এটা একটি অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা। তদন্ত করে বিস্তারিত জানা যাবে। এ ধরনের ঘটনা রোধ করতে সতর্ক থাকতে হবে। তবে যেটাই হোক প্রকৃত ঘটনা উদ্ঘাটন করে মানুষকে আস্থার জায়গায় নিয়ে আসতে হবে। মানুষের জন্য একটা পূর্ব সতর্কমূলক বার্তা দিতে হবে, তাহলেই মানুষ সতর্ক হবে ভবন নির্মাণ ও ভবন ব্যবহারে।