ঢাকা ২১ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ৬ আশ্বিন ১৪৩১ | বেটা ভার্সন

প্রতীক্ষার প্রহর শেষ, গ্যাস পাচ্ছে উত্তরাঞ্চলবাসী

প্রতীক্ষার প্রহর শেষ, গ্যাস পাচ্ছে উত্তরাঞ্চলবাসী

বগুড়া-রংপুর-সৈয়দপুরে মাটির নিচে গ্যাস সঞ্চালন লাইন স্থাপনের কাজ সম্পন্ন হয়েছে। এখন তিন নদীর তলদেশে পাইপলাইন এবং মিটারিং স্টেশনের কাজ শেষে উত্তরাঞ্চলে পৌঁছাবে প্রাকৃতিক গ্যাস। এর ফলে কৃষিভিত্তিক শিল্পের ব্যাপক প্রসার ঘটবে। কারণ সরকার এরইমধ্যে কৃষির ওপর জোর দিয়েছে। নতুন নতুন প্রণোদনা ঘোষণা করেছে। এতে উত্তরাঞ্চলে গ্যাস সরবরাহে বিকাশমান এ শিল্পে বড় পরিবর্তন আনবে বলে আশা করছেন ব্যবসায়ীরা।

জানা গেছে, বগুড়া-রংপুর-সৈয়দপুর গ্যাস পাইপলাইন প্রকল্পের কাজ চলতি বছরের জুনে শেষ হবে। সবকিছু ঠিক থাকলে নির্ধারিত সময়ের মধ্যে প্রকল্পের কাজ সম্পন্ন হবে। ফলে চলতি বছরেই উত্তরাঞ্চলে গ্যাস সরবরাহের সম্ভাবনা থাকছে। তবে উত্তরাঞ্চল কৃষির ওপর নির্ভরশীল হওয়ায় গ্যাস সঞ্চালনে কৃষিভিত্তিক শিল্প গড়ে উঠবে।

এ বিষয়ে বাণিজ্য মন্ত্রী টিপু মুনশি আলোকিত বাংলাদেশকে বলেন, দেশে কৃষিভিত্তিক শিল্পের প্রসার ঘটেছে। আধুনিক প্রযুক্তিতে কৃষি প্রক্রিয়াজাত পণ্য ও কৃষি যন্ত্রপাতি উৎপাদন অনেকটা এগিয়েছে। এর উদ্দেশ্য কৃষিভিত্তিক শিল্পে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন। যেখানে উত্তরাঞ্চল কৃষিনির্ভর অঞ্চল, সেখানে লাইনের মাধ্যমে গ্যাস সরবরাহের সুযোগ নিয়ে শিল্প মন্ত্রণালয় ইন্ড্রাস্টিজ নির্মাণ করবে। একইসঙ্গে কৃষি পণ্য প্রসারে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ও কাজ করবে।

সংশ্লিষ্টরা জানান, ভূমি অধিগ্রহণ জটিলতা, নদী ক্রসিং, করোনাভাইরাস ও রাশিয়া-ইউক্রেনের যুদ্ধে বিশ্বজুড়ে অর্থনৈতিক মন্দার মধ্যেও গ্যাস সঞ্চালন লাইনের কাজ এগিয়ে চলছে। গ্যাস সরবরাহে উত্তরাঞ্চলের মানুষের স্বপ্ন পূরণ, আর্থ-সামাজিক উন্নয়ন ত্বরান্বিত, গ্যাসভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপন এবং বিভিন্ন ধরনের শিল্প-কারখানা নির্মাণসহ বাণিজ্যিক কার্যক্রমের নতুন এক দিগন্ত বিকশিত হবে।

বগুড়া-রংপুর-সৈয়দপুর গ্যাস সরবরাহে শিল্প-কারখানা ও নতুন নতুন কর্মসংস্থানের বিপুল সম্ভাবনাও দেখছেন স্থানীয় ব্যবসায়ীরা। তারা বলছেন, দেশের অন্যান্য অঞ্চলের তুলনায় উত্তরাঞ্চলে শ্রমিকের মজুরি কম থাকায় পণ্য উৎপাদনে লাভবান হবেন ব্যবসায়ীরা। এখানে পণ্য উৎপাদনের ব্যয় কমবে। দেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি হারে আন্তঃআঞ্চলিক বা আন্তঃবিভাগীয় বৈষম্য কমবে।

জানা গেছে, ২০১৮ সালের অক্টোবরে ১ হাজার ৩৭৮ কোটি ৫৫ লাখ টাকা ব্যয়ে বগুড়া-রংপুর-সৈয়দপুর গ্যাসলাইন নির্মাণে সরকারি ও গ্যাস ট্রান্সমিশন কোম্পানি লিমিটেডের যৌথ অর্থায়ন করছে। এ প্রকল্প ২০২১ সালের জুনে শেষ হওয়ার কথা থাকলেও ভূমি অধিগ্রহণ জটিলতা ও করোনা মহামারির কারণে মেয়াদ বাড়িয়ে ২০২৩ সালের জুন পর্যন্ত করা হয়েছে। কোনো ধরনের সমস্যা না থাকলে নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যেই কাজ সম্পন্ন করতে চান প্রকল্পের সংশ্লিষ্টরা।

উত্তরাঞ্চলে শিল্পায়নের স্বার্থে পাইপলাইনের মাধ্যমে প্রাকৃতিক গ্যাস সরবরাহের দাবি ছিল বহু দিনের। ২০১১ সালে রংপুর সফরে গিয়ে সেই দাবি বাস্তবায়নের প্রতিশ্রুতি দেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তার প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী ২০১৮ সালে গ্যাস সরবরাহে পাইপলাইন স্থাপনের কাজ শুরু হওয়ায় খুশি উত্তরাঞ্চলবাসী। স্থানীয় শিল্পোদ্যোক্তাসহ ব্যবসায়ী মহলের দীর্ঘদিনের স্বপ্ন ছিল এ অঞ্চলে গ্যাস সরবরাহের। এজন্য বহুবার হরতাল, মিটিং মিছিলও হয়েছে। এখন সবার দাবি, বারবার প্রকল্পের মেয়াদ না বাড়িয়ে দ্রুত সময়ের মধ্যে গ্যাস সরবরাহ কার্যক্রম শুরু করা হোক।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, বগুড়া-রংপুর-সৈয়দপুর গ্যাস পাইপলাইন প্রকল্পটি শেষের দিকে থাকায় গ্যাস বিতরণ লাইন নির্মাণের পৃথক আরেকটি প্রকল্প হাতে নিয়েছে পশ্চিমাঞ্চল গ্যাস ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি লিমিটেড। এ প্রকল্পের আওতায় ১০০ কিলোমিটার থাকবে বিতরণ লাইন। এর মধ্যে রংপুর শহরে ৪৪ কিলোমিটার, পীরগঞ্জে ১০ কিলোমিটার এবং নীলফামারী ও উত্তরা ইপিজেড এলাকায় ৪৬ কিলোমিটার অংশ রয়েছে।

অর্থনীতির প্রবৃদ্ধি হারে আন্তঃবিভাগীয় বা আন্তঃআঞ্চলিক বৈষম্য থাকায় যে কোনো দুর্যোগে অর্থনৈতিক উন্নয়নে পিছিয়ে থাকা অঞ্চল বা বিভাগে দারিদ্র্যের হার বেড়ে যায়। বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সাউথ এশিয়ান নেটওয়ার্ক অন ইকোনমিক মডেলিংয়ের (সানেম) ২৩ জানুয়ারি জরিপ প্রকাশ করে। সেই জরিপে করোনা মহামারির প্রভাবে দেশে দারিদ্র্যের হার বেড়ে হয়েছে ৪২ শতাংশ। সবচেয়ে বেশি দারিদ্র্য বেড়েছে রংপুর আর রাজশাহী বিভাগে।

গত বছরের নভেম্বর ও ডিসেম্বরে দেশজুড়ে খানা পর্যায়ে টেলিফোনে পরিচালিত এই জরিপের আওতায় ছিল দেশের ৬৪ জেলায় ৫ হাজার ৫৭৭টি খানা। যে দুই মাসে জরিপ চলেছে তখন দেশে সার্বিক দারিদ্র্যের হার ছিল ৪২ শতাংশ। জরিপের তথ্য অনুযায়ী রাজশাহীতে দারিদ্র্যের হার ছিল ৫৫ দশমিক ৫ শতাংশ আর রংপুরে ৫৭ দশমিক ৫ শতাংশ। রংপুর বিভাগে দারিদ্র্যের হার সবচেয়ে বেশি। অবকাঠামোগত সুবিধার অভাব, সার্বক্ষণিক বিদ্যুৎ প্রাপ্তির অনিশ্চয়তা, পাইপলাইনে গ্যাস সরবরাহ না করায় উত্তরাঞ্চলে বড় ও মাঝারি শিল্প স্থাপনে এগিয়ে আসছেন না উদ্যোক্তরা। বিশেষ করে পাইপলাইনে গ্যাস সরবরাহ না থাকায় সেখানে গ্যাসভিত্তিক ইউরিয়া সার কারখানা, সিরামিক শিল্প, ওষুধ শিল্প, চামড়া ও চামড়াজাত শিল্প, তৈরি পোশাক শিল্প, অটো অ্যাসেম্বলিং শিল্প ইত্যাদি গড়ে উঠতে পারছে না।

উত্তরাঞ্চলে গ্যাস সঞ্চালন লাইনের বিষয়ে বিদ্যুৎ জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ নিজের ভেরিফাইড ফেইসবুক পোস্টে লেখেন, ‘উত্তরাঞ্চলের মানুষের কাছে গ্যাস পৌঁছে দেয়ার ওয়াদা করেছিলেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। আমরা সেটা বাস্তবায়নের দ্বারপ্রান্তে। বর্তমান সরকারের হাত ধরে উত্তরাঞ্চলে মঙ্গা দূর হয়েছে। এবার শিল্পায়নের পালা।’ তিনি আরো লেখেন, ‘৩০ ইঞ্চি ব্যাসের উচ্চচাপ সম্পন্ন এই পাইপলাইনের মাধ্যমে গ্যাস পৌঁছে যাবে উত্তরাঞ্চলের ১১ জেলায়। গ্যাসসংযোগকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠবে শিল্পকারখানা, ইপিজেড, গ্যাসভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র, কৃষিপণ্য সংরক্ষণের জন্য হিমাগার। বাড়বে কর্মসংস্থান। সমৃদ্ধ হবে উত্তরাঞ্চলের মানুষের জীবনমান তথা বাংলাদেশের অর্থনীতি।’

গ্যাস সংযোগকে কেন্দ্র করে অনেকে শিল্পকারখানা, বিশেষ করে কৃষিজ পণ্য সংরক্ষণাগার, গার্মেন্ট শিল্পের কাঁচামাল তৈরির কারখানা এবং ইপিজেডভিত্তিক কলকারখানা স্থাপনের পরিকল্পনা করছেন। গ্যাস আসতে দেরি হলে সে পরিকল্পনা থেকে অনেকে সরে যেতে পারেন। গ্যাস সরবরাহে দেশীয় শিল্পপ্রতিষ্ঠানের পাশাপাশি পার্শ্ববর্তী দেশ ভুটান, নেপাল, ভারতসহ কয়েকটি দেশে রপ্তানিযোগ্য কারখানা রংপুরে গড়ে তোলা যাবে।

বগুড়া-রংপুর-সৈয়দপুর গ্যাস পাইপলাইন প্রকল্পের সংশ্লিষ্টরা বলেন, এক হাজার পিএসআইজি চাপ সম্পন্ন ৩০ ইঞ্চি ব্যাসের দেড়শ’ কিলোমিটার দীর্ঘ পাইপলাইন, মিটারিং স্টেশন এবং আনুষঙ্গিক স্থাপনা নির্মাণ এই প্রকল্পের অধীনে ধরা হয়েছে। ইতোমধ্যে মাটির নিচে শতভাগ পাইপলাইন বসানো সম্পন্ন হয়েছে। বগুড়া-রংপুর-সৈয়দপুর পর্যন্ত ৮টি নদীর মধ্যে ঘাঘট দুই, যমুনাশ্বরী, চিকলী, বগুড়া ক্যানেল ও রংপুর ক্যানেলে গ্যাস পাইপলাইন স্থাপন হয়েছে। এখন শুধু করতোয়া দুই-তিন ও ঘাঘট এক নদীর তলদেশে পাইপলাইন স্থাপন হলেই প্রকল্পের সম্পন্ন কাজ শেষ।

রুটম্যাপ অনুযায়ী সঞ্চালন লাইন, ইন্ডাকশন বেন্ড, কোটিং ম্যাটেরিয়ালস, ফিটিংস, পিগ ট্রাপ, বল ভাল্ব, গেট ভাল্বসহ বিভিন্ন সরঞ্জাম সংযোগ করা হয়েছে। পাইপ লাইনের শেষপ্রান্ত নীলফামারীর সৈয়দপুর শহরের ওয়াপদা মোড়ের বাইপাস সড়ক সংলগ্ন তিন একর জায়গায় ১০০ এমএমএসসিএফডি (মিলিয়ন স্ট্যান্ডার্ড কিউবিক ফিট পার ডে) ক্ষমতাস¤পন্ন সেন্ট্রাল গ্যাস সাপ্লাই (সিজিএস) স্টেশন, রংপুরে ৫০ এমএমএসসিএফডি ক্ষমতাসম্পন্ন টিবিএস (টাউন বর্ডার স্টেশন) এবং রংপুরের পীরগঞ্জে ২০ এমএমএসসিএফডি ক্ষমতাম্পন্ন আরেকটি টিবিএস স্থাপন করা হবে।

গ্যাস ট্রান্সমিশন কোম্পানি লিমিটেডের কর্মকর্তারা জানান, পাইপলাইন স্থাপন সম্পন্নের মধ্যদিয়ে উত্তরাঞ্চলের মানুষ নিরবচ্ছিন্ন গ্যাস পাবেন। শিল্প-কারখানায় গ্যাস সংযোগ দেয়া হবে। বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপন হলে বিদ্যুতের ঘাটতি পূরণ হবে।

গ্যাস সঞ্চালন লাইন স্থাপনের কাজে নিয়োজিত সজল সরকার বলেন, উত্তরাঞ্চল বন্যাপ্রবণ এলাকা। বন্যায় গ্যাসলাইন যাতে ক্ষতিগ্রস্ত না হয় সেজন্য পাইপের ওপর ইউ আকৃতির ঢালাই দেয়া হয়েছে। এরপরও গ্যাসলাইনে কোনো সমস্যা হলে সাবসেন্টারের মাধ্যমে সরবরাহ কন্ট্রোল করে ত্রুটি সারিয়ে পুনরায় সচল করার ব্যবস্থা রয়েছে।

বগুড়া এলাকার বাসিন্দা সোহাগ মণ্ডল বলেন, স্বাধীনতার পরবর্তী সময়ে দক্ষিণাঞ্চলে গ্যাস, বিদ্যুৎ ও বড় বড় শিল্প-কারখানা গড়ে উঠলেও উত্তরাঞ্চলে হয়নি। এতে বৈষম্যের শিকার হয়েছে এই অঞ্চলের মানুষ। প্রতি বছর লাখ লাখ বেকার শিক্ষিত তরুণ কাজের সন্ধ্যানে ঢাকা ও চট্টগ্রামসহ দেশের বড় শহরে যায়। এছাড়া ওইসব শহরে জীবন ধারণের ব্যয় বেশি হওয়ায় সঞ্চয় থাকছে না কর্মজীবীদের। তবে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ সরকার উত্তরাঞ্চলে গ্যাস সঞ্চালন লাইন স্থাপন করায় এখন শিল্প-কারখানা গড়ে উঠবে, ভাগ্য বদল হবে মানুষের।

বগুড়া-রংপুর-সৈয়দপুর গ্যাস সঞ্চালন পাইপলাইন নির্মাণ প্রকল্পের প্রকল্প পরিচালক খন্দকার আরিফুল ইসলাম আলোকিত বাংলাদেশকে বলেন, ‘মাটির নিচে গ্যাস সঞ্চালন লাইনের কাজ শেষ, এখন তিনটি নদীর তলদেশে পাইপলাইন স্থাপন এবং তিনটি স্টেশন (পীরগঞ্জ-রংপুর-সৈয়দপুর) নির্মাণের কাজ বাকী আছে। তবে আশা করছি, আগামী জুনের মধ্যেই প্রকল্পের কাজ সম্পন্ন হবে।’

তিনি আরো বলেন, ‘রাশিয়া-ইউক্রেনের যুদ্ধের কারণে বৈদেশিক মুদ্রা (ডলার) বিনিময়ের হার বৃদ্ধিতে মিটারিং স্টেশন স্থাপনে বিলম্ব হচ্ছে। কারণ বিশ্ববাজারে পণ্যমূল্য বৃদ্ধি ও ডলার সংকটে আমদানির ঋণপত্র (এলসি) খোলা বন্ধ করে দিয়েছে দেশের অনেক ব্যাংক। এলসি খুললে প্রকল্পের অসম্পন্ন কাজ দ্রুতই সম্পন্ন করা যাবে।’

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত