প্রধানমন্ত্রীর আগমন
ময়মনসিংহ ছিল উৎসবের নগরী
প্রকাশ : ১২ মার্চ ২০২৩, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ
মোজাম্মেল হক খোকন, ময়মনসিংহ
কেউ বাসে চড়ে, কেউ ট্রেনে, কেউ বা খোলা ট্রাক কিংবা পিকআপে, আবার অনেকেই পায়ে হেঁটে ময়মনসিংহ আওয়ামী লীগের বিভাগীয় সমাবেশের মাঠে যোগদান করেন জামালপুর, শেরপুর, নেত্রকোনা ও ময়মনসিংহ জেলা- মহানগর আওয়ামী লীগ ও অঙ্গ সহযোগী সংগঠনের নেতাকর্মীরা। গতকাল পুরো নগরজুড়েই নেতাকর্মীদের ঢেউ ছিল উপচেপড়া।
গতকাল সকাল থেকে বিকাল ৩টা পর্যন্ত এভাবেই নেতাকর্মীদের দলে দলে ময়মনসিংহ সার্কিট হাউজ মাঠের মহাসমাবেশস্থলে জড়ো হতে দেখা যায়।
একের পর এক ট্রেন আসতে থাকে ময়মনসিংহ রেলওয়ে জংশনে। ট্রেনের কামড়া ভর্তি মানুষ। ছাদেও তিল ধারণের ঠাঁই নেই। শেখ হাসিনা ও বঙ্গবন্ধুর স্লোগানে গ্রামের মেঠোপথ মাড়িয়ে ট্রেনগুলো এসে দাঁড়ায় স্টেশনের প্ল্যাটফর্মে। ঠাঁসাঠাঁসি করে আসা মানুষগুলোর হৃদয়ে আনন্দের সীমা ছিল না। প্রায় সাড়ে চার বছর পর ময়মনসিংহের নিজ শহরে প্রধানমন্ত্রীকে দেখতে ও আগামী দিনে শেখ হাসিনার বার্তা শুনতে ছুটে এসেছেন মানুষ। গতকাল বিশেষ ৮টি ট্রেনে বিভিন্ন এলাকা থেকে এভাবেই প্রধানমন্ত্রীর জনসভায় মানুষ আসেন। এরপর স্টেশন থেকে মিছিল নিয়ে যান সমাবেশ স্থলে। এরই মাঝে বিকাল পৌনে ৩টায় প্রধানমন্ত্রী হেলিকপ্টারে ময়মনসিংহের রফিক উদ্দিন ভূঁইয়া স্টেডিয়ামে পৌঁছান। সেখান থেকে বেলা ২টা ৫৮ মিনিটে ঐতিহাসিক সার্কিট হাউজ জনসভা মঞ্চে উঠেন প্রধানমন্ত্রী। এরপর ৩টা ২ মিনিটে আসন গ্রহণ করেন। পরে জেলা ও মহানগর আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে ফুলের তোড়া দিয়ে শুভেচ্ছা জানানো হয়। এ সময় জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি এহতেশামুল আলম ও মহানগর আওয়ামী লীগের সভাপতি মো. ইকরামুল হক টিটু এবং গণপূর্ত প্রতিমন্ত্রী শরিফ আহমেদ ও সংস্কৃতি প্রতিমন্ত্রী কেএম খালিদ তুলে দেন ফুল।
একই সঙ্গে নৌকা প্রতীকের রেপ্লিকা দেয়া হয়। পরে জাতীয় সংগীত। কোরআন তেলাওয়াতের মধ্য দিয়ে শুরু হয় ময়মনসিংহ বিভাগীয় জনসভার আনুষ্ঠানিকতা। এর আগে ৭৩টি উন্নয়ন প্রকল্প উদ্বোধন এবং ৩০টি প্রকল্পের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন। পরে বিকাল ৩টায় সার্কিট হাউজ মাঠে আওয়ামী লীগ আয়োজিত বিভাগীয় জনসভায় প্রধান অতিথির বক্তব্য দেন প্রধানমন্ত্রী। ময়মনসিংহে প্রধানমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনার আগমনে সকাল হতে উৎসবে মেতেছিল নগরী।
এদিকে জনসভায় যোগ দিতে সকাল থেকে সমাবেশস্থলে নেতাকর্মী ও সমর্থকদের ঢল নামে। ছোট ছোট মিছিল নিয়ে আসতে থাকে ময়মনসিংহ বিভাগের চার জেলার নেতাকর্মীরা। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার জনসভা উপলক্ষ্যে জামালপুর-ময়মনসিংহ, নেত্রকোনা এই তিন জেলা থেকে বিশেষ আটটি ট্রেন বিভাগীয় শহর ময়মনসিংহ উদ্দেশ্যে ছেড়ে আসতে শুরু করে সকাল থেকে। ময়মনসিংহ জেলায় যাতায়াতের জন্য গফরগাঁও-ময়মনসিংহ, নান্দাইল-ময়মনসিংহ, দেওয়ানগঞ্জ বাজার-জামালপুর-ময়মনসিংহ, নেত্রকোনা-ময়মনসিংহ, জামালপুরের সরিষাবাড়ির অ্যাডভোকেট মতিউর রহমান স্টেশন-ময়মনসিংহ, গৌরীপুর-ময়মনসিংহ, ঈশ্বরগঞ্জ-ময়মনসিংহ, জারিয়া-ঝাঞ্ঝাইল-ময়মনসিংহ রুটে ৮টি স্পেশাল ট্রেন আসতে থাকে জেলা ও উপজেলা থেকে।
জামালপুর হতে সমাবেশে যোগ দেওয়া রাসেল জানান, ট্রেনের ছাদে চড়ে এসেছেন ময়মনসিংহে প্রধানমন্ত্রীর জনসভায় যোগ দিতে। সকাল ৭টার দিকে জামালপুর থেকে ছেড়ে আসা একটি ট্রেন ময়মনসিংহে এসে পৌঁছায় ৮টায়। তিনি আরও বলেন, বঙ্গবন্ধু ও দেশরত্ন শেখ হাসিনার প্রতি ভালোবাসা থেকে দল করি। প্রধানমন্ত্রীর আগামী নির্বাচনকে সামনে রেখে কি বার্তা ও নির্দেশনা দেবেন তা শুনতে এসেছি। নেত্রীর বার্তা শুনে আগামী দিনে নৌকাকে বিজয়ী করতে সেভাবে মাঠে কাজ করব।
সরেজমিনে দেখা যায়, ময়মনসিংহ মহানগর যুবলীগের আহ্বায়ক শাহিনুর রহমান শাহীন, নান্দাইলের সংসদ সদস্য আনোয়ারুল আবেদীন তুহিন, কেন্দ্রীয় সেচ্ছাসেবক লীগের সাধারণ সম্পাদক আফজালুর রহমান বাবুর সমর্থকরা ছাড়াও বিভিন্ন থানা, ওয়ার্ড, ইউনিয়ন ও ইউনিট নেতারা এ সমাবেশে অংশ নিতে নিজেদের নেতাকর্মীদের নিয়ে সমাবেশে যোগদান করেন।
নগরীর বলাশপুর হতে সুজাউদ্দিন সুজার নেতৃত্বে পায়ে হেঁটে সমাবেশস্থলে আসেন নারী ও পুরুষ সমর্থকরা। বেলা আড়াইটার মধ্যে সমাবেশ মাঠ নেতাকর্মীদের উপস্থিতিতে কানায় কানায় ভরে যেতে দেখা গেছে। পরে সমাবেশে আসা লোকজন রাস্তায় অবস্থান নেন।
এ সময় টাউন হল এলাকায় কথা হয় ময়মনসিংহের গৌরীপুর উপজেলার নাওভাঙ্গা থেকে আসা মোহাম্মদ আলীর সাথে। তিনি বলেন, ট্রাকে করে শম্ভুগঞ্জ ব্রিজ মোড় পর্যন্ত এসেছিলাম। এরপর হেঁটে সমাবেশ পর্যন্ত এসেছি। বাপ-চাচারও আওয়ামী লীগ করছে। অহন আমরাও এইটাই করি। হের লাই¹া শেখ হাসিনার কথা হুনবার আইছি।
‘জয় বাংলা, জয় বঙ্গবন্ধু’, ‘শেখ হাসিনার আগমন, শুভেচ্ছা স্বাগতম’ এমন সেøøাগানে মুখরিত ছিল ময়মনসিংহ শহর। মুখে জয় বাংলার স্লোগান, হাতে জাতীয় পতাকার ফেস্টুন, মাথায় দলীয় ব্যান্ডের ফিতা। কারো কারো হাতে ছিল নির্বাচনি প্রতীক নৌকা। সভামঞ্চটিও করা হয়েছিল নৌকার আদলে। শহরের প্রতিটি সড়ক মুখরিত ছিল নেতাকর্মীদের উচ্ছ্বাসে। ময়মনসিংহ বিভাগের অধীন সকল জেলা, উপজেলা এমনকি গ্রামের মানুষও এসেছিলেন দেশের প্রধানমন্ত্রীকে একনজর দেখতে। তাকে স্বাগত জানাতে। তার অভিনন্দন গ্রহণ করতে। বিভিন্ন এলাকা থেকে আসা হাজার হাজার জনতার সেই স্রোত গিয়ে মিশে যায় নগরীর ঐতিহাসিক সার্কিট হাউজ মাঠে। কানায় কানায় ভরে যায় সভাস্থল। লাখো লাখো দলীয় নেতাকর্মী জনতাকে প্রধানমন্ত্রী হাত নেড়ে শুভেচ্ছা জানান। আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনে তাদের সমর্থন ও দোয়া-আর্শীবাদ কামনা করেন।
ব্রহ্মপুত্র তীরে নগরীর ঐতিহাসিক সার্কিট হাউজ ময়দানে দলের বিভাগীয় জনসভায় যোগ দিতে সকাল থেকেই ট্রেন, বাস, ট্রাকে করে বাদ্যযন্ত্র বাজিয়ে জনসভাস্থলে আসতে থাকেন আওয়ামী লীগ এবং দলের অঙ্গ ও সহযোগী সংগঠনের নেতাকর্মীরা। অনেকে আবার নেতাদের দেয়া টিশার্ট কিংবা শাড়ি পরিধান করে এসেছেন মহাসমাবেশে।
প্রধানমন্ত্রীর আগমনকে ঘিরে গত কয়েকদিন ধরে সাজসাজ রব ছিল শহরের প্রতিটি এলাকায়। ঝকঝকে-তকতকে করে সাজানো হয় ময়মনসিংহ নগরীকে। প্রধানমন্ত্রীকে শুভেচ্ছা জানিয়ে হাজার হাজার ব্যানার, ফেস্টুন, তোরণ বিলবোর্ডে ছেয়ে যায় পুরো নগর। সব মিলিয়ে উৎসবের আমেজ ছিল দলের নেতাকর্মীসহ সাধারণ মানুষের মাঝেও।
সভায় আসা এক ব্যক্তি বলেন, গত ১৪ বছরে এ অঞ্চলে বিদ্যুৎ, যোগাযোগ, শিক্ষা, স্বাস্থ্য অবকাঠামো, কৃষিসহ বিভিন্ন সেক্টরে ব্যাপক উন্নয়ন হয়েছে। আওয়ামী লীগ সরকারের টানা তিন মেয়াদে বিগত বছরগুলোয় ময়মনসিংহ মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালকে ৫০০ শয্যা থেকে বাড়িয়ে এক হাজার শয্যায় উন্নীত করেছে। আমাদের তিন দশকের দাবি ছিল একটা বিভাগের। সেটাও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দিয়েছেন। ময়মনসিংহ এত উন্নত আর কোনো সরকারের আমলে হয়নি। প্রধানমন্ত্রীর কাছে আমরা চির কৃতজ্ঞ।
প্রধানমন্ত্রীর জনসভায় যোগ দিতে আসা তৃতীয় লিঙ্গের মানুষ অভিমত ব্যক্ত করে বলেন, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আমাদের মা। তিনি আমাদের জাতি হিসেবে পরিচয় দিয়েছেন তৃতীয় লিঙ্গে অন্তর্ভুক্ত করে। জাতীয় পরিচয়পত্র দিয়েছেন, ভোট দেয়ার সুযোগ দিয়েছেন। আমরা রাস্তাঘাটে থাকতাম, তিনি আমাদেরকে জায়গা ও ঘর করে দিয়েছেন। তার প্রতি কৃতজ্ঞতা জানাতেই এবং তাকে একনজর দেখতে আমরা ছুটে আসছি জনসভায়। আবেগ আপ্লুত হয়ে এ কথা জানালেন তৃতীয় লিঙ্গের সংগঠন সেতুবন্ধন কল্যাণ সংঘের সভাপতি তনু।
তিনি জানান ‘প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে অভ্যর্থনা ও শুভেচ্ছা জানাতে আমাদের সম্প্রদায়ের মানুষ কয়েকদিন ধরেই প্রস্তুতি নিয়েছেন। প্রত্যেকেই নতুন কাপড় পরে সাজুগুজু করে এসেছে প্রধানমন্ত্রীকে একনজর দেখার জন্য। আমরা সবাই প্রধানমন্ত্রীকে কৃতজ্ঞতা জানাই এবং তার জন্য দোয়া করি।’
সালমা নামের তৃতীয় লিঙ্গের আরেকজন বলেন, ‘প্রধানমন্ত্রীকে কাছ থেকে একনজর দেখব, এ জন্য সারারাত ঘুমাতে পারিনি। তিনি আমাদের জন্য অনেক কিছু করেছেন। আমাদের পরিবারের সদস্যরা যা না করেছেন প্রধানমন্ত্রী আমাদের জন্য তার চেয়ে বেশি করেছেন। আমাদেরকে তিনি মানুষ হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছেন। তার ঋণ আমরা কোনও দিন ভুলতে পারব না। এ জন্যই সকাল সকাল সার্কিট হাউজ মাঠে আমরা সবাই ছুটে এসেছি নেত্রীকে একনজর দেখার জন্য।’
সকাল থেকেই মিছিলের নগরীতে পরিণত হয় ময়মনসিংহ। নগরীতে যানবাহন চলাচল বন্ধ ছিল। নগরীর প্রতিটি অলিগলি থেকে রাজপথে মিশে যায় নেতাকর্মীদের মিছিল। খণ্ড খণ্ড মিছিলে ভিন্ন এক আবহের সৃষ্টি হয়।