এসেনসিয়াল ড্রাগস

উৎপাদন ছাড়াল হাজার কোটি টাকার

ঘুরে দাঁড়ানোর কারিগর অধ্যাপক ডা. এহ্সানুল কবির জগলুল

প্রকাশ : ১৬ মার্চ ২০২৩, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ

  এএইচএম ফারুক

দায়িত্ব নিয়ে বার্ষিক ৩০০ কোটি টাকার উৎপাদন থেকে বাড়িয়ে হাজার কোটি টাকা ছাড়িয়ে সফলতা দেখিয়েছেন এসেনসিয়াল ড্রাগস কোম্পানি লিমিটেডের (ইডিসিএল) ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) অধ্যাপক ডা. এহ্সানুল কবির জগলুল। এরইমধ্যে সরকার মালিকানাধীন এ প্রতিষ্ঠানটি ওষুধের গুণগতমানের দিক থেকে আস্থা কুড়িয়েছে দেশি-বিদেশি প্রতিষ্ঠানের কাছেও। করোনা মহামারিতে যখন দেশ ও বিশ্ব স্থবির হয়ে পড়ে, তখনও উৎপাদন অব্যাহত রেখেছে। বর্তমানে বিনামূল্যে প্রতিদিন অন্তত দেড় কোটি মানুষের ওষুধের চাহিদার যোগান দিচ্ছে প্রতিষ্ঠানটি।

সম্প্রতি প্রতিষ্ঠানটিতে চাকরিসহ বিভিন্ন আর্থিক বিষয়ে অনিয়মের অভিযোগ ওঠে। ক্যান্টিন বন্ধ থাকাকালেও ভর্তুকির বিল তোলাসহ কয়েকটি বিষয়ে অডিটে আপত্তি উঠে। এসব বিষয়ে জানতে চাইলে অভিযোগ অস্বীকার করে এমডি অধ্যাপক ডা. এহ্সানুল কবির জগলুল দৈনিক আলোকিত বাংলাদেশকে বলেছেন- সব তদন্ত শেষ হলে আমার প্রতিষ্ঠানে কোনো বড় ধরনের অনিয়মের অভিযোগ থাকবে না। তিনি বলেন- আমি নিজেও ৮ ঘণ্টা প্লাস অফিস করি। সব বিষয়ে আমি তিক্ষè দৃষ্টি রাখি। আমার প্রতিষ্ঠানের সব কিছু স্বচ্ছ কাচের মতো পরিষ্কার। আমি দায়িত্ব নিয়ে বাৎসরিক ৩০০ কোটি টাকার উৎপাদন থেকে বাড়িয়ে হাজার কোটি টাকা ছাড়িয়েছি। এটা যদি কোনো বেসরকারি কোম্পানি হতো তাহলো এর মূল্যমান হতো ৩০০০ কোটি টাকার সমান।

করোনাসহ জীবন রক্ষাকারী গুরুত্বপূর্ণ ভ্যাকসিন ও নিত্য নতুন ওষুধ উৎপাদনের বিশদ পরিকল্পনা নিয়ে এগিয়ে যাচ্ছেন বলে জানালেন এমডি অধ্যাপক ডা. এহ্সানুল কবির জগলুল। তিনি আরো বলেন- গত ফেব্রুয়ারিতে বগুড়ায় ফোর্থ জেনারেশনের ‘সেফালোস্পোরিন’ অ্যান্টিবায়োটিক তৈরি প্রকল্পটি স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক উদ্বোধন করেছেন। এটি ছিল ইডিসিএলের স্বপ্নের প্রজেক্ট। বর্তমানে সেখানে জীবন রক্ষাকারি মূল্যবান ‘সেফালোস্পোরিন’ গ্রুপের অ্যান্টিবায়োটিক ইনজেকশন উৎপাদন হচ্ছে। এখানে স্টেরাইল অ্যান্টিবায়োটিক বা ইনজেকশন পূর্ণমাত্রায় উৎপাদন শুরু হয়েছে। এছাড়াও এই প্রজেক্টে সিরিয়াস রোগের তাৎক্ষণিক প্রয়োজনে ব্যবহার হয় এমন সেফট্রাইক্সেন, সেফুরোক্সাইম, সেফটাজিডিম ও সেফরাডিনের মতো ১২টি জীবন রক্ষাকারী স্টেরাইল অ্যান্টিবায়োটিক উৎপাদনের উদ্যোগ নেয়া হয়েছে।

অধ্যাপক জগলুল আরো বলেন- একই সঙ্গে গোপালগঞ্জে দেশের সর্ববৃহৎ ভ্যাকসিন প্ল্যান্ট তৈরির কাজ চলমান রয়েছে। বর্তমানে কোভিড-১৯ ছাড়াও আরো ১০ প্রকার ভ্যাকসিন বিদেশ থেকে আমদানি করার ফলে এ খাতে প্রচুর বৈদেশিক মুদ্রা ব্যয় করতে হচ্ছে। কিন্তু দেশের ভ্যাকসিন প্ল্যান্টে উৎপাদন শুরু হলে বৈদেশিক মুদ্রা সাশ্রয় এবং ভবিষ্যতে সেখানেই সব ধরনের ভ্যাকসিন তৈরি করা সম্ভব হবে।

জানা গেছে, ভ্যাকসিন তৈরিতে প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনার পর গত বছরের মাঝামাঝি সময় গোপালগঞ্জে ইডিসিএল কারখানার সক্ষমতাকে বিশেষ বিবেচনায় নেয় স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়। দায়িত্বশীলদের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী ভ্যাকসিন উৎপাদন কার্যক্রম শুরু করার লক্ষ্যে স্বল্পমেয়াদি পদক্ষেপ হিসেবে সরকারকে কার্যকর ও নিরাপদ ভ্যাকসিন সরবরাহের জন্য ফেইস-১ ফর্মুলেশন ফিল্ড ফিনিশিং অ্যান্ড প্যাকেজিং ইউনিট স্থাপনের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়েছে। গোপালগঞ্জ প্রকল্পে আরডিপিপি পুনরায় সংশোধন করে ভ্যাকসিন উৎপাদন ইউনিট অন্তর্ভুক্ত করে কাজটি বাস্তবায়নের সিদ্ধান্ত হয়েছে।

ইডিসিএল সূত্রে জানা গেছে সাড়ে ৬ একর জমি অধিগ্রহণ জটিলতার জট খুলতেই দুই বছর চলে গেছে। জমির অধিগ্রহণ ব্যয় ধরা হয়েছে ৩০ কোটি টাকা। যা পরবর্তীতে সমন্বয় করার শর্তে এরইমধ্যে ব্যয় হয়েছে। ওই টাকা ইডিসিএলের নিজস্ব তহবিল থেকে পরিশোধ করা হয়েছে বলেও জানালেন এমডি ডা. জগলুল।

এমডি জানান- ভ্যাকসিন কারখানার জন্য যে পরিকল্পনা নেয়া হয়েছে তাতে ৩৫০ মিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ করবে এশিয়ান উন্নয়ন ব্যাংক (এডিবি)। এডিবি সরকারকে উন্নয়ন প্রকল্প প্রস্তাব (ডিপিপি) দিতে বললে আন্তর্জাতিক টেন্ডার আহ্বান করা হয়। পরবর্তীতে প্রায় সাড়ে ৩ কোটি টাকায় ফিনল্যান্ডের একটি কোম্পানিকে ডিপিপির দায়িত্ব দেয়া হয়েছে।

অধ্যাপক ডা. এহসানুল কবির জগলুল বলেন, ভ্যাকসিন কারখানার জন্য জমি অধিগ্রহণের কাজ শেষ হয়েছে। এ কাজে দীর্ঘ দুই বছর পরিশ্রম করতে হয়েছে। তিনি বলেন, ভ্যাকসিন কারখানার জন্য নির্ধারিত জায়গা ছাড়তে রাজি না হওয়া ৯ জনের সঙ্গে মামলার লড়াই করতে হয়েছে। সেখানে দেওয়ানি মামলা হয়েছিল।

এহসানুল কবির জগলুল আরো বলেন, ভ্যাকসিন উৎপাদনের জন্য একটা কারখানা করা কিন্তু চাট্টিখানি কথা নয়। এখানে বিশাল কর্মযজ্ঞ আছে। কারখানা স্থাপনের জন্য জমির পাশাপাশি টাকারও প্রয়োজন আছে। এজন্য যে পরিকল্পনা নেয়া হয়েছে তাতে ৩৫০ মিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ করবে এডিবি। এ বিষয়ে চুক্তি হয়েছে।

সাম্প্রতিক অনিয়মের বিষয়ে এসেনসিয়াল ড্রাগসের এমডি অধ্যাপক ডা. এহসানুল কবির জগলুল আলোকিত বাংলাদেশকে বলেন- আমার সময়ে অনিয়ম-দুর্নীতির মাধ্যমে একজনকেও চাকরি দেয়া হয়নি। এমনকি আমি চ্যালেঞ্জ করলাম আমার একজন মাত্র আত্মীয় ছাড়া, যদি দ্বিতীয় কাউকে এখানে চাকরি দেয়ার প্রমাণ দেখাতে পারেন তবে আমি সব অভিযোগ মাথা পেতে নেব। তাও সে একজন ফার্মাসিস্ট হিসেবে যোগ্যতার ভিত্তিতে চাকরি পেয়েছে।

তিনি আরো বলেন- ইডিসিএল দীর্ঘদিন খুড়িয়ে খুড়িয়ে চলা একটি রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান ছিল। কিন্তু বর্তমান সরকারের সময়ে লাভজনক একটি প্রতিষ্ঠানে রূপ নিয়েছে। কাজের পরিবেশ ও ওষুধের গুণগত মান বৃদ্ধিতে প্রতিনিয়ত কাজ করে যাচ্ছে প্রতিষ্ঠানের সর্বস্তরের কর্মকর্তা-কর্মচারী ও শ্রমিকগণ। করোনাকালে যখন সব কিছু স্থবির, তখনও মানবসেবার কথা মাথায় রেখে দিন-রাত ওষুধ উৎপাদন করেছে ইডিসিএল। তখন উৎপাদন অব্যাহত রাখতে বিশেষ ব্যবস্থায় শ্রমিকদের খাবারদাবারের ব্যবস্থা করতে হয়েছে।

অপর এক প্রশ্নের জবাবে ইডিসিএল এমডি বলেন- শ্রমিকদের কাজের পরিবেশ, শারিরীক ও মানসিক স্বাস্থ্যের মানোন্নয়নে তাদের প্রণোদনা এবং উৎসাহমূলক পরিবেশ তৈরি করা হয়। এজন্য যে ব্যয় হয়- তা অপচয় নয় বরং বিনিয়োগ। তিনি আরো বলেন- একটি প্রতিষ্ঠান পরিচালনায় বিভিন্ন সময় বিভিন্ন তথ্যউপাত্ত নিয়ে নানা প্রশ্ন উত্থাপিত হয় এবং পর্যায়ক্রমে সেগুলোর জবাবও দাখিল করা হয়। তথ্যপ্রমাণের ভিত্তিতে সেগুলো নিষ্পত্তিও হয়। যেমন- গত ২০২০-২১ অর্থবছরের স্বাস্থ্য অডিট অধিদপ্তর কর্তৃক সরকারি নিরীক্ষায় প্রাথমিকভাবে ৫১টি অডিট মেমো ইস্যু করা হয়, যার মধ্যে ২৪/০৫/২০১২ইং তারিখে অনুষ্ঠিত ‘সিন অ্যান্ড ডিসকাশন’ সভায় ২৪টি অডিট আপত্তি নিষ্পত্তি করে চূড়ান্তভাবে ২৬টি অডিট আপত্তি ‘অডিট ইন্সপেকশন রিপোর্ট’-এর অন্তর্ভুক্ত করা হয়। যার মধ্যে ২৩টি এসএফআই এবং ৩টি নন এসএফআই আপত্তি। এসএফআই ২৩টি আপত্তির ব্রডশিট জবাব স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের স্বাস্থ্যসেবা বিভাগে প্রেরণ করা হয়। যার মধ্যে ১০টি আপত্তি নিষ্পত্তির সুপারিশ মন্ত্রণালয় কর্তৃক স্বাস্থ্য অডিট অধিদপ্তরে প্রেরণ করা হয়েছে ও ১৩টি আপত্তির ওপর পুনঃজবাব প্রদানের জন্য ইডিসিএলকে পত্র প্রেরণ করা হয়।

তদন্তের বিভিন্ন ধাপ আছে। একটা বড় প্রতিষ্ঠান চালাতে কিছু ভুল ত্রুটি থাকতে পারে। কিন্তু সরকারি নিরীক্ষা রিপোর্টের আপত্তিসমূহ নিষ্পত্তির কার্যক্রম একটি চলমান প্রক্রিয়া। তদন্ত শেষ হলে এই প্রতিষ্ঠানে বড় ধরনের কোনো অনিয়ম দুর্নীতির অভিযোগ টিকবে না বলে জানান এমডি অধ্যাপক ডা. এহ্সানুল কবির জগলুল।